বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ১৩ ঘণ্টা

আজ বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। সে দিন বিমানে লন্ডন থেকে বঙ্গবন্ধুর সহযাত্রী হয়েছিলেন ভারতীয় কূটনীতিক শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জি। তাঁর অন্তরঙ্গ স্মৃতিচারণ

অবিস্মরণীয় সেই বিমানযাত্রা: দেশে ফেরার পথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাশে ভারতীয় কূটনীতিক শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জি
অবিস্মরণীয় সেই বিমানযাত্রা: দেশে ফেরার পথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাশে ভারতীয় কূটনীতিক শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জি

১০ জানুয়ারি, ১৯৭২। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডন থেকে দিল্লি হয়ে ফিরলেন স্বাধীন বাংলাদেশে। ব্রিটিশ এয়ার ফোর্সের বিশেষ বিমানে বঙ্গবন্ধুর সহযাত্রী হলেন তাঁর ভারতীয় কূটনীতিক শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জি। কেমন ছিল ১৩ ঘণ্টার সেই সফরের অভিজ্ঞতা? দক্ষিণ লন্ডনের বাসায় বসে ঐতিহাসিক সেই বিমানযাত্রার গল্প শোনালেন শশাঙ্ক ব্যানার্জি।
শুরু হলো পরিচয়পর্ব দিয়ে। ‘পূর্ব পাকিস্তানের ভারতীয় দূতাবাসের তখন কাজ করছি রাজনৈতিক কর্মকর্তা হিসেবে। থাকি ইত্তেফাক অফিসের লাগোয়া চক্রবর্তী ভিলায়। ১৯৬২ সালের কথা। দিনটি ছিল বড়দিন। মাঝরাতে আমার বাসায় হঠাৎ কড়া নাড়ল কেউ। নানা শঙ্কা মাথায় নিয়ে দরজা খুললাম। দেখি, দরজার কাছে একটা ছেলে দাঁড়ানো। বয়স ১৪-র বেশি হবে না। ছেলেটা খবর দিল, ইত্তেফাক-সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া আমাকে দেখা করতে বলেছেন। মাথায় হাজারো ভাবনা নিয়ে দেখা করতে গেলাম। সেখানেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রথম দেখলাম।’
ইন্ডিয়া, মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশ লিবারেশন অ্যান্ড পাকিস্তান বইয়ে এ নিয়ে কিছুটা স্মৃতিচারণও করেছেন শশাঙ্ক ব্যানার্জি। লিখেছেন, ‘মানিক মিয়া আমার সঙ্গে হাত মেলালেন। তারপর ঘুরলেন পাশে বসা ভদ্রলোকের দিকে। তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে হাত নাড়লেন। কিন্তু এই মানুষটির চেহারা ছিল আমার চেনা। তাঁর বহু ছবি আমি পত্রিকায় দেখেছি। শুধু আমার নয়, তিনি ছিলেন সবার কাছে পরিচিত এক মুখ। এভাবেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। স্বীকার করতেই হবে, প্রথম দেখাতেই তিনি আমাকে মুগ্ধ করেছিলেন।’
এর পর এল মুক্তিযুদ্ধ এবং অনেক প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশের বিজয়। এই পুরো সময়জুড়ে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। ‘পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে শেখ মুজিব লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে এলেন। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর পরামর্শে তাঁকে দিল্লি হয়ে বাংলাদেশে পৌঁছে দিতে সহযাত্রী হই আমি।’ স্মৃতিচারণ করেন শশাঙ্ক ব্যানার্জি।
৯ জানুয়ারি ১৯৭২, ভোর ছয়টা। লন্ডন হিথ্রো বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে পৌঁছালেন বঙ্গবন্ধু। তাঁকে স্বাগত জানালেন ব্রিটিশপররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ বিভাগের কর্মকর্তা ইয়ান সাদারল্যান্ড ও লন্ডনে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার আপা বি পন্থ। আমাকে দেখে আবেগাপ্লুত শেখ মুজিব বলেন, ‘ব্যানার্জি, এখানেও আছেন!’
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে শেখ মুজিবের বৈঠকের ব্যবস্থা করে দিলেন ইয়ান। আর ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ করিয়ে দেন আপা বি পন্থ। ৩০ মিনিট ধরে চলে ইন্দিরা-মুজিব টেলিফোন আলাপচারিতা।

শশাঙ্ক ব্যানার্জির লেখা দুটি বই

ঘণ্টাখানেক পরে ইন্দিরা গান্ধী আবার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলেন। ইন্দিরা গান্ধীর সম্মতিতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন বাংলাদেশে যাত্রাপথে সহযাত্রী হলেন শশাঙ্ক ব্যানার্জি। সঙ্গে ছিলেন, সে সময়ের ভারতীয় হাইকমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি ভেদ মারওয়া। আরও ছিলেন স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেন ও তাঁর স্ত্রী হামিদা হোসেন।
বিমানে তাঁরা পাশাপাশি আসনে বসলেন। সামনের টেবিলে বঙ্গবন্ধুর প্রিয় সুগন্ধময় এরিনমোর তামাক, আর সেই বিখ্যাত পাইপ। উৎফুল্ল মুজিবের তখন দেশে ফেরার তর সইছে না।

শশাঙ্ক ব্যানার্জির লেখা

আপ্লুত কণ্ঠে তিনি বলে উঠলেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ।’ তিনি ধন্যবাদ জানালেন দীর্ঘদিন তাঁকে সহযোগিতার জন্য। বললেন, ‘ব্যানার্জি, এবার একটি বিশেষ সহযোগিতা চাই।’ শশাঙ্ক বললেন, ‘আয়ত্তের মধ্যে হলে অবশ্যই চেষ্টা করব।’ ধীর লয়ে মুজিব বললেন, ‘দিল্লিতে ইন্দিরার সঙ্গে বৈঠকের আগেই তাঁর কাছে একটি খবর পৌঁছানো দরকার। বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় মিত্রবাহিনী সদস্যদের ৩১ মার্চ ১৯৭২ সালের মধ্যে ভারতে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি চূড়ান্ত করতে হবে।’ তিনি বলেন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর এ বিষয়ে কথা হয়েছে। ভারতীয় মিত্রবাহিনী চলে গেলে বাংলাদেশ ব্রিটিশ সরকারের স্বীকৃতি পেতে আর কোনো বাধা থাকবে না।
মধ্যপ্রাচ্য থেকে জ্বালানি নিয়ে বিমানটি আবার উড়তে শুরু করেছে। বঙ্গবন্ধু জানালা দিয়ে শ্বেতশুভ্র সাদা মেঘের দিকে অপলক তাকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পর দাঁড়িয়ে গাইতে লাগলেন, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’। তাঁর চোখ ভরে উঠেছে জলে। তিনি বললেন, ‘ব্যানার্জি, আপনিও ধরুন। রিহার্সেল দিয়ে নিই।’ তাঁরা দুজনে মিলে গানটা গাইলেন। বঙ্গবন্ধু চোখের পানি লুকানোর চেষ্টা করে বললেন, ‘যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য আরও কঠোর সংগ্রাম অপেক্ষা করে আছে। বুকে শুধু একটাই বল, আমার দেশের আপামর মানুষ।’
শশাঙ্ককে অবাক করে দিয়ে বঙ্গবন্ধু হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘এ গানটি হবে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। কেমন হবে বলেন তো?’ শশাঙ্ক জবাব দিলেন, ‘ইতিহাসে তাহলে প্রথমবারের মতো দুটি দেশের জাতীয় সংগীতের লেখক হবেন একই ব্যক্তি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।’
বিমানের যাত্রাপথে বঙ্গবন্ধুকে কলকাতা হয়ে দেশে ফেরার অনুরাধ জানিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের বার্তা এল। কলকাতাবাসী বঙ্গবন্ধুকে দেখতে চায়। তিনি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ফিরতি বার্তায় জানালেন, স্বাধীনতাসংগ্রামে কলকাতাবাসীর সহযোগিতা তাঁকে কৃতজ্ঞ করেছে। কিন্তু দিল্লি হয়ে ঢাকা ফিরতে তাঁর তর সইছে না। তবে শিগগিরই তিনি কলকাতা আসবেন। বার্তা পাঠিয়ে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘পথ তো মনে হয় ফুরাতে চাইছে না। স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্ত আকাশ, মানুষ, প্রকৃতি আমাকে ডাকছে। এ যে কী অনুভূতি, আমি বোঝাতে পারব না!’
শশাঙ্ক ব্যানার্জি বললেন, ‘দিল্লি অবতরণের তখন আর সময় বেশি বাকি নেই। পাইলট আমাদের দুটি ছবি তুলে দিলেন। শেখ মুজিবের সঙ্গে তোলা সেই ঐতিহাসিক ছবিটি এখনো খুব যত্ন করে তুলে রেখেছি।’
দিল্লিতে শেখ মুজিবকে স্বাগত জানালেন ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার সরণ সিংসহ আরও অনেকে। রাষ্ট্রপতি ভবনে বঙ্গবন্ধুর জন্য কলকাতা থেকে আনা গুড়ের সন্দেশ, সমুসা, শিঙ্গাড়া আর দার্জিলিং চা তাঁকে তৃপ্তি দিয়েছিল। মুজিব-ইন্দিরা বৈঠকে তিন মাসের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনাদের ফিরিয়ে আনার বিষয়টি নিয়ে কথা হয়।
১০ জানুয়ারি ১৯৭২। দুপুরে বিমান থেকে ঢাকায় নামলেন স্বাধীন বাংলাদেশের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জনস্রোত আর মানুষের স্লোগানে মুখরিত চারপাশ। সোচ্চার ধ্বনি উঠছে, ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘জয় মুক্তিযুদ্ধ’। বিমানবন্দর থেকে পল্টন ময়দান—এক বিপুল জনসমুদ্র। শশাঙ্ক বলেন, ‘সে এক অভূতপূর্ব মুহূর্ত, চারদিকে মুক্তি আর মহানেতাকে ফিরে পাওয়ার আনন্দ। আজও চোখে লেগে আছে মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনটি।’
শশাঙ্ক ব্যানার্জি বললেন, ‘লন্ডনে ফিরে অনেক দিন আর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু তাঁর গল ব্লাডার অপারেশন করতে সপরিবারে লন্ডনে যান। জার্মানি থেকে তড়িঘড়ি ফিরে হাসপাতালে তাঁকে দেখতে যাই। বেগম মুজিব আমার স্ত্রীকে ঢাকাই জামদানি উপহার দিলেন। সেই ছিল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার শেষ দেখা। তাঁর দরাজ কণ্ঠ আর উদাত্ত আহ্বানের ধ্বনি এখনো আমার কানে বাজে। সেটা কখনোই হারিয়ে যায়নি।’