লিফটের মধ্যে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় লিফট বন্ধ হয়ে অন্ধকার হয়ে এসেছে। আপনার পাশের মানুষ স্বাভাবিকভাবে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু আপনি ভয়ে কাতর। আপনি এতটাই ভয় পেলেন যে আপনার মনে হচ্ছে দম বন্ধ হয়ে মারা যাবেন। আপনার এই মানসিক অবস্থাকে অন্ধকারভীতি (অ্যাক্লুও ফোবিয়া) বলে।
যেকোনো ফোবিয়া একধরনের মানসিক অবস্থা। অতি সামান্য বিষয়েও কারও ভীতি (ফোবিয়া) থাকতে পারে।
ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সুলতানা আলগিন বললেন, ‘ফোবিয়া জন্মগতভাবে কারও সঙ্গে থাকে না। কোনো বিষয়ে অতিরিক্ত ভয় পাওয়ার পেছনে অতীতের কোনো ঘটনা থাকে। যে জিনিসকে মানুষ ভয় পায়, তার সঙ্গে অতীতের সেই ঘটনা মিলিয়ে সে এক মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে পড়ে। সেই মানসিক যন্ত্রণা থেকে তৈরি হওয়া আতঙ্ককে আমরা ফোবিয়া বলি। আবার অনেক সময় ফোবিয়া অন্যান্য রোগের উপসর্গও হতে পারে।’
বিশেষজ্ঞরা ফোবিয়ার ৩টি ধরন নিয়ে আলোচনা করেন। স্পেসিফিক ফোবিয়া, সোশ্যাল ফোবিয়া আর অ্যাগ্রোফোবিয়া।
১. সুনির্দিষ্ট জিনিসের ওপর ভীতি
নির্দিষ্ট কোনো বস্তু, জায়গা বা পরিস্থিতিকে অতিরিক্ত মাত্রায় ভয় পেলে তাকে সুনির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর ভীতি (স্পেসিফিক ফোবিয়া) হিসেবে দেখা হয়। এ ধরনের সমস্যার মধ্যে পশু–পাখিকে ভয় পাওয়া, অন্ধকার ভয় পাওয়া, উচ্চতাভীতি, ইনজেকশনভীতির মতো বিষয়গুলোকে দেখা যায়।
উচ্চতাভীতি
ছাদে দাঁড়িয়ে নিচে রাস্তার দিকে তাকালে মনে হয় পড়ে যাব। উঁচু জায়গায় গেলে আমরা অনেকেই ভয় পাই। বিশেষত সেখান থেকে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকলে বা সেখানে নিরাপত্তা কম থাকলে এটা প্রায় সবারই হয়। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে এই ভয় মারাত্মক আকার ধারণ করে। প্রবল উচ্চতাভীতি আছে, এমন কেউ কোনো কারণে অতিরিক্ত উচ্চতায় উঠে গেলে তাঁদের প্যানিক অ্যাটাক হওয়ার আশঙ্কা থাকে। দ্রুত সেখান থেকে সরিয়ে নিতে না পারলে অতিরিক্ত অস্থিরতায় তাঁরা অসুস্থ হয়ে যেতে পারেন।
রক্তভীতি
সবজি কাটতে গিয়ে হাত সামান্য কেটে গিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। সেই রক্ত দেখেও অনেকে অজ্ঞান হয়ে যান। এটাও সুনির্দিষ্ট জিনিসের ওপর ভীতির একটি প্রকার। যাঁরা রক্ত দেখে ভয় পান, তাঁরা হিমোফোবিয়ায় ভুগছেন। এ ধরনের লোকজনের রক্ত দেখার সঙ্গে সঙ্গে একধরনের অস্বস্তি তৈরি হয়, সেখান থেকে প্যানিক অ্যাটাক হওয়ারও আশঙ্কা থাকে।
পানিভীতি
অনেকেই পুকুর, নদী বা সমুদ্রের পানি দেখলে ভয় পান। পানি দেখলে এমন ভয় পাওয়াকে হাইড্রোফোবিয়া বলে। সমুদ্রবিলাসে গিয়ে সবাই সমুদ্রের পানিতে নেমেছেন, কিন্তু আপনি আতঙ্কে পানির সামনে যেতে পারছেন না। মনে হয় পানিতে নামলে ফিরে আসতে পারবেন না।
একাকীত্বভীতি
অটোফোবিয়া বা মনোফোবিয়া হলো একা বা একাকী হওয়ার ভয়। এমনকি বাড়ির মতো একটি স্বাচ্ছন্দ্যময় জায়গায় তাঁরা একা বোধ করেন। অটোফোবিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা নিরাপদ বোধ করার জন্য তাঁদের আশপাশে অন্যান্য ব্যক্তির প্রয়োজন বলে মনে করেন। শারীরিকভাবে নিরাপদ বোধ করলেও, মানসিকভাবে তাঁরা ভয়ে থাকেন।
তেলাপোকাভীতি
আপনার পড়ার টেবিলের ওপর হঠাৎ একটি তেলাপোকা এসে পড়ল। আপনি পড়িমরি করে দিলেন ছুট। অথবা চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুললেন। যাঁরা তেলাপোকা বা পোকামাকড় দেখে অতিমাত্রায় ভয় পান, সেটাকে এন্টোমোফোবিয়া বলে।
এ ছাড়া অনেক ফোবিয়া আছে, যা স্পেসেফিক ফোবিয়ার মধ্যে পড়ে।
২. সামাজিক ভীতি
যেখানে লোকজন সেখানেই আস্বস্তি, সেখানেই ভয়। মানুষের সঙ্গে কথা বলতে সংকোচ বোধ করা। ভয় পেয়ে জনসমাবেশ এড়িয়ে যেতে চলতে থাকেন অনেকে। এ ধরনের মানুষ কোথাও গেলে সারাক্ষণ তাঁর মনে হয় কেউ তাঁর চলাফেরা পর্যবেক্ষণ করছেন। তাঁর দিকে তাকিয়ে আছেন বা তাঁর সমালোচনা করছেন।
মানুষের সঙ্গে কথা বলতে গেলে মনে হয় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। মানসিকভাবে খুব অস্বস্তিতে থাকেন এ ধরনের লোকজন। তাঁদের এই অস্বস্তি মূলত সামাজিকভীতি (সোশ্যাল ফোবিয়া) হিসেবে দেখা হয়। যা প্রকাশ পায় শারীরিক উপসর্গের মধ্য দিয়ে। এর মধ্যে আছে বুক ধড়ফড় করা, শ্বাসকষ্ট, দমবন্ধ ভাব, বুকে চাপ অনুভব, ব্যথা, হাত-পা কাঁপা, মুখ শুকিয়ে আসা, মাথা ঝিমঝিম করা, মাথাঘোরা, অতিরিক্ত ঘেমে যাওয়া, পেটের মধ্যে অস্বস্তিবোধ, বমিবমি ভাব ইত্যাদি।
৩. অ্যাগ্রোফোবিয়া
অ্যাগ্রোফোবিয়ায় আক্রান্তরা খোলা জায়গায় যেতে ভয় পায়। কোনো একটা সমস্যায় পড়লে, ভয় পেয়ে সেখান থেকে বের হয়ে আসতে পারেন না। এ ধরনের মানুষ মূলত কোনো সমস্যায় পড়লে তার সমাধান করার চেয়ে সেখান থেকে পালিয়ে আসাকে ভালো মনে করেন। ভিড় এড়িতে তাঁরা বাসা থেকে বের হতে চান না। দিনের পর দিন বাসায় থেকে তাঁরা একা হয়ে পড়েন, যা থেকে বিষণ্নতা (ডিপ্রেশন) তৈরি হতে পারে।