সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নারী উদ্যোক্তাদের উপস্থিতি বাড়ছে। ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) তথ্য বলছে, এখন দেশে প্রায় ২০ হাজার ফেসবুক পেজে কেনাকাটা চলছে। এর মধ্যে ১২ হাজার পেজ চালাচ্ছেন নারীরা।
ফেসবুককে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে স্বল্প পুঁজিতেই উদ্যোক্তা হয়ে উঠছেন নারীরা। ই-ক্যাবের তথ্যমতে, গত এক বছরে ই-কমার্স খাতে লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ঈদসহ যেকোনো উৎসবে এ লেনদেন বাড়ে।
নারী উদ্যোক্তাদের কেউ পোশাক, কেউ গয়না, কেউ হাতে তৈরি জিনিস, কেউ তৈরি খাবারসহ নানা পণ্য বিক্রি করছেন। অনেকে দেশীয় সংস্কৃতিকে তুলে ধরার কাজ করছেন। কেউ শৌখিন পণ্য নিয়ে ব্যবসায় নেমেছেন। এই নারীরা শিক্ষিত। সংসারের চাপসহ নানা সমস্যায় অনেকের পক্ষে চাকরি করা সম্ভব হয়নি। অনেকে নিজে কিছু করবেন বলে বদ্ধপরিকর। ফলে সংসার সামলানোর পাশাপাশি স্বাধীন এ ব্যবসায় আগ্রহ বাড়ছে নারীদের।
ইসলামপুরের সরু গলি থেকে শুরু করে এখন লন্ডনসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই সুনাম কুড়িয়েছে আঁখি’স কালেকশন। আঁখি’স কালেকশনের উদ্যোক্তা সালমা রহমান আঁখি বললেন, ‘কলেজে পড়া অবস্থায় বুটিক হাউস দিই। ইসলামপুর, মিরপুর, মোহাম্মদপুর থেকে পোশাক এনে বিক্রি করি। এখন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি বলেই মনে করি।’
মা-মেয়ে মিলে ফেসবুকে ‘সাবেরেং’ নামে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর খাবারের ব্যবসা শুরু করেছেন পারাহিতা চাকমা ও তাঁর মা দেবলক্ষী চাকমা (৫৫)। মা খাবার রান্নার বিষয়টি দেখভাল করেন। একটি কলেজের প্রশাসনিক বিভাগে কর্মরত পারাহিতা বললেন, ‘মায়ের ইচ্ছাতে তাঁকে সঙ্গে নিয়ে মিরপুরের নিজের বাসায় বসে ফেসবুকে নতুন এই উদ্যোগ চালু করে বেশ সাড়া পাচ্ছি।’
উদ্যোক্তারা ঘরে বসে ব্যবসা করছেন, একইভাবে ক্রেতারাও ঘরে বসে পণ্য পছন্দ করে কল করে অথবা খুদে বার্তা পাঠিয়ে পছন্দের পণ্যটি হাতে পাচ্ছেন। তবে অনলাইনে এ ধরনের ব্যবসায় ক্রেতারা ঠকছেন বলেও অভিযোগ আছে। ফেসবুকে এক পণ্য দেখিয়ে ক্রেতার কাছে অন্য পণ্য পাঠিয়ে দেওয়ার পর ক্রেতারা কোনো প্রতিকারও পাচ্ছেন না।
কিছু অভিযোগ থাকলেও ই-কমার্সে নারী উদ্যোক্তাদের আগ্রহ বাড়ার বিষয়টিকে ইতিবাচক বলে উল্লেখ করছেন ই–কমার্সের সঙ্গে যুক্ত সংশ্লিষ্টরা। বর্তমানে প্রযুক্তির সুবিধায় নারীদের ঘরে বসে কাজ করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে এফ-কমার্স বা ফেসবুকভিত্তিক ব্যবসা। অনলাইনভিত্তিক ক্রেতা হিসেবেও নারীর সংখ্যাই বেশি।
>দেশে প্রায় ২০ হাজার ফেসবুক পেজে কেনাকাটা চলছে
১২ হাজার পেজ চালাচ্ছেন নারীরা
এক বছরে ই-কমার্স খাতে লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা
ঈদসহ যেকোনো উৎসবে এই লেনদেন বাড়ে
অনলাইন উদ্যোগে আরেক সফল নারী তোহফাতুল জান্নাত। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যবিদ্যা বিষয়ে পড়াশোনা করার সময়ই যুক্ত হন অনলাইন ব্যবসায়। তারপর চাকরি করলেও ব্যবসা বন্ধ করেননি। গৃহসজ্জার (এনটেরিয়র) ফার্ম দেওয়ার পাশাপাশি শোরুম দিয়েছেন রাজধানীর অভিজাত শপিং মলে। অনলাইনে তাঁর পেজের নাম ‘ক্যারিড অ্যাওয়ে বাংলাদেশ’। একজন সহকারী নিয়ে নিজের নকশা করা পোশাক বিক্রি করেন। তাঁর মতে, ক্রেতার চাহিদাকে গুরুত্ব দিতে হবে। ঢাকা বা ঢাকার বাইরের ক্রেতার সন্তুষ্টি ও বিশ্বাস অর্জন করতে না পারলে এ ব্যবসায় ভালো করা যায় না।
হুর নুসরাত নামের ব্যবসার উদ্যোক্তা নুসরাত আক্তার জানালেন, শুধু চার বোন হওয়ায় চলার পথে অনেক বাধাবিপত্তি এসেছে। ২০১৪ সালে ব্যবসা শুরুর আগে ডিজিটাল মার্কেটিং বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে ফেসবুকে পেজ তৈরি করেন। হাতে থাকা ১ হাজার ২০০ টাকা নিয়ে শুরু করা ব্যবসায় এখন ১৫০ জন তাঁতীর কাছ থেকে পোশাক নিয়ে দেশে–বিদেশে দিনে প্রায় ২০০ পোশাক বিক্রি করা হচ্ছে। গয়নাও বিক্রি করেন তিনি।
বিক্রয় ডটকমের বিপণন প্রধান ঈশিতা শারমিন বললেন, অনলাইন শপিং সাইটসহ ফেসবুক পেজের মাধ্যমে এখন অনেক নারী উদ্যোক্তা ব্যবসা করছেন। ইলেকট্রনিকস, লাইফ স্টাইল পণ্য আবার কেউ জমি ব্যবসার সঙ্গেও যুক্ত হচ্ছেন। অল্প পুঁজিতে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছাড়াই ব্যবসা করা যাচ্ছে।
রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার মাহমুদা সুলতানা নিয়মিত অনলাইনে কেনাকাটা করেন। তিনি বলেন, ‘অনলাইনে কেনাকাটা নিয়ে অনেকে প্রতারণার শিকার হলেও নিজে কখনো সমস্যায় পড়িনি।’
তবে মিরপুর ১০ নম্বরের ইলিয়াস কবির তাঁর স্ত্রীর জন্য ফেসবুকে থ্রিপিস কিনতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হন। সঠিক পণ্য মেলেনি, পণ্যের দাম নিয়েও মনে সংশয় ছিল।
ই-ক্যাবের যুগ্ম সম্পাদক নাসিমা আক্তার বললেন, ই-ক্যাবের ফেসবুক গ্রুপে অভিযোগ দিলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কেউ প্রতারিত হলে প্রথমে ই-ক্যাবের পক্ষ থেকে ক্রেতা ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলা হয়। এ ছাড়া কেনাকাটায় প্রতারণার শিকার হলে থানায় আইনি ব্যবস্থা নেওয়ারও সুযোগ আছে। নারী উদ্যোক্তাদের নিজেদের ব্যবসার স্বার্থেই এ বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে, যাতে কোনো ক্রেতা প্রতারণার শিকার না হন।