নারীমঞ্চ

ফিলিপাইনের ক্যাটামিন এখন ইউপি সদস্য

নির্বাচিত ইউপি সদস্য ক্যাটামিন
 ছবি: আনোয়ার হোসেন

১৪ নভেম্বর বিকেলে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার রাধাকানাই ইউনিয়নের কোদালিয়াপাড় গ্রামে ছিল মানুষের জটলা। জটলার মধ্যমণি রাধাকানাই ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নবনির্বাচিত একজন নারী সদস্য। ১১ নভেম্বর তিনি ভোটে বিজয়ী হওয়ার পর ভোটারদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করতে এসেছেন। জটলার ভেতর দেখা যায় ওই নারী সদস্যকে ঘিরে কয়েকজন সাংবাদিককে।

একজন নারী ইউপি সদস্যকে ঘিরে এমন জটলার কথা শুনে বিস্মিত হওয়ারই কথা। তবে ইউপি সদস্য বাংলাদেশের অন্য ১০ জন নারী ইউপি সদস্যের মতো নন। ওই নারী ফিলিপাইনের। সঠিকভাবে বাংলা ভাষাটা শিখে নেওয়ার আগেই তিনি মানুষের মন জয় করেছেন। এই জনপ্রতিনিধির নাম জিন ক্যাটামিন প্রেট্রিয়াকা। তাঁর স্বামীর নাম জুলহাস উদ্দিন। জিন ক্যাটামিন প্রেট্রিয়াকার নতুন নাম জেসমিন আক্তার জুলহাস।

বিয়ের অনুষ্ঠানে ক্যাটামিন–জুলহাস দম্পতি

শুরুর গল্পটা প্রায় এক যুগ আগের। জিন ক্যাটামিন প্রেট্রিয়াকা ফিলিপাইনের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মৎস্যবিজ্ঞানে স্নাতক হয়ে সিঙ্গাপুরে একটি কোম্পানিতে চাকরি নেন। সেখানে চাকরি করতেন রাধাকানাই ইউনিয়নের দবরদস্তা গ্রামের জুলহাস উদ্দিন। দুই বছর এক প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সময় তাঁদের মধ্যে ভালো বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এরপর ক্যাটামিন সিঙ্গাপুরের চাকরি ছেড়ে চলে যান নিজের দেশ ফিলিপাইনে। কিছুদিন পর জুলহাসও দেশে ফিরে আসেন। তবে বন্ধুত্বের সুবাদে তাঁদের মধ্যে প্রায়ই যোগাযোগ হতো। কিছুদিন পর জুলহাস একদিন ক্যাটামিনকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। পরিবারের সম্মতিতে রাজি হন ক্যাটামিন প্রেট্রিয়াকা। বিয়ে করার জন্য জুলহাস যান ফিলিপাইনে। সেখানে যাওয়ার পর জিন ক্যাটামিন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। বিয়ের পর জিন ক্যাটামিন চলে আসেন ফুলবাড়িয়ার রাধাকানাইয়ের স্বামীর বাড়িতে। সেটা বছর দশেক আগের ঘটনা।

জুলহাস উদ্দিন আর জিন ক্যাটামিন দুজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল বাংলাদেশে আসার পর অনেকটা অথই জলে পড়ে যান জিন ক্যাটামিন। সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা দেশের আচার-সংস্কৃতি আর ভাষার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াটা ছিল খুব কঠিন। তবে পরিবার ছেড়ে এত দূর আসার কারণে গ্রামের মানুষের ভালোবাসা একটু বেশিই যেন পেয়েছিলেন জিন ক্যাটামিন। সব সময় গ্রামের নারীরা তাঁকে ঘিরে রেখে মন ভালো রাখার চেষ্টা করতেন। এভাবেই গ্রামের সব পরিবারের প্রিয় ভাবি হয়ে ওঠেন জিন ক্যাটামিন। ধীরে ধীরে শুরু হয় ক্যাটামিনের বাংলা ভাষা শিক্ষা। ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হতে শুরু করেন বাংলাদেশের একজন গ্রাম্যবধূ হিসেবে। বৈবাহিক সূত্র বাংলাদেশের নাগরিকত্বও পেয়েছেন।

জিন ক্যাটামিন বলেন, বাংলা ভাষা শেখাটা খুব কঠিন ছিল। ১০ বছর পর এখন সবার কথা বুঝতে পারি সহজেই। তবে বাংলা বলাটা এখনো অনেক কঠিন মনে হয়। নির্বাচনের বিষয়ে ক্যাটামিন বলেন, ‘গ্রামের মানুষের ভালোবাসা আমি পেয়েছি শুরু থেকেই। তবে কোনো দিন নির্বাচন করে জনপ্রতিনিধি হব, এটা ভাবিনি। কেন জানি না প্রতিবেশীরা খুব অনুরোধ করল আমি যেন নির্বাচন করি। ভালো না খারাপ হবে, তা না ভেবে মানুষের অনুরোধ রাখতেই নির্বাচন করেছি।’

জুলহাস উদ্দিনের কথাতেও একই সুর—মানুষের অনুরোধ রক্ষার জন্য স্ত্রীর নির্বাচনে রাজি হয়েছেন তিনি। নির্বাচনে মানুষের যে ভালোবাসা পেয়েছেন, সেটি ভুলবার নয়। মানুষের কল্যাণ করাই যেন হয় তাঁর প্রধান কাজ।

বাংলাদেশে আসার পর কখনো আর ফিলিপাইনে যাওয়া হয়নি ক্যাটমিনের। ওই দেশ থেকে তাঁর কোনো স্বজনও কখনো আসেনি বাংলাদেশে। এ দেশে সবার ভালোবাসা পেলেও মাঝেমধ্যে স্বজনদের জন্য মন কাঁদে তাঁর।

রাধাকানাই ইউনিয়নের ১, ২ ও ৩ নম্বর সংরক্ষিত নারী সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন জিন ক্যাটামিন প্রেট্রিয়াকা। গত রোববার বিকেলে ওই ওয়ার্ডের কোদালিয়াপাড় গ্রামের কয়েকজন নারী জানান, জিন ক্যাটামিন বিদেশি হওয়া তিনি বাংলাদেশের গ্রামের নারীদের মতো নয়। তবে আসার পর থেকে প্রতিদিন বাঙালি নারী হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছেন।

১০ বছরের দাম্পত্যজীবনে জিন ক্যাটামিন প্রেট্রিয়াকা আর জুলহাস উদ্দিনের দুই সন্তান। জুলহাস উদ্দিন ব্যবসা করেন আর জিন ক্যাটামিনা ঘরের কাজেই ব্যস্ত থাকেন।