ফলাফলের হাসি-কান্না

ঢাকার রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ থেকে জিপিএ–৫ পেয়েছে তাহারাত আমিন। ছেলের ভালো ফলের খবর মা জানাচ্ছেন স্বজনকে। মায়ের আনন্দ দেখে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ল সন্তানও। ছবি: তানভীর আহাম্মেদ
ঢাকার রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ থেকে জিপিএ–৫ পেয়েছে তাহারাত আমিন। ছেলের ভালো ফলের খবর মা জানাচ্ছেন স্বজনকে। মায়ের আনন্দ দেখে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ল সন্তানও। ছবি: তানভীর আহাম্মেদ
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হলো গত বুধবার। ফল আশানুরূপ হোক বা না হোক, দৃষ্টি থাকতে হবে সামনের দিকে। সামনে কেবল ভর্তি পরীক্ষা নয়, জীবনের আরও পরীক্ষা বাকি!
সাকিব বিন রশীদ

অভিনন্দন সবার জন্য
সাকিব বিন রশীদ, টেন মিনিটস স্কুলের প্রধান প্রশিক্ষক ও ব্র্যাক শিক্ষা প্রকল্পের উপব্যবস্থাপক

‘জিপিএ–৫ পাওনি? এই রেজাল্ট দিয়ে কী করবা?’
‘অমুক কিন্তু ঠিকই গোল্ডেন পেয়েছে। ওর পা ধুয়ে পানি খাও।’
‘তুমি তো গোল্ডেন পেয়েই গেছ, তোমার তো আর চিন্তা নাই।’

জিপিএ–৫ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার এক আরাধ্য সোনার হরিণ। এই বস্তু যদি একবার আপনি হাতে পেয়ে যান, তাহলে আপনার জীবনে আর কোনো চিন্তা নেই! সারা জীবন পায়ের ওপর পা তুলে খেতে পারবেন। অন্যদিকে যদি জিপিএ–৫ না পান, তাহলে আপনি রাতারাতি দেশের তৃতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হবেন। মা–বাবার অযোগ্য সন্তান। সমাজের কলঙ্ক। জিপিএ–৫ নিয়ে অনেক অভিভাবক ও ‘পাশের বাসার মানুষেরা’ এত বেশি ভাবেন; এরপরও যে একটা জীবন আছে, সেই জীবনেও অনেক কিছু করার আছে, সেটা তারা বেমালুম ভুলে যান।

জিপিএ–৫ নিয়ে আমাদের এই আদিখ্যেতা বাস্তবতা থেকে কয়েক শ মাইল দূরে। জীবনের লম্বা দৌড়ে এইচএসসি বড়জোর প্রথম ধাপ। একটু ভেঙে বলি।

ফল প্রকাশের পর বরিশাল সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীদের সেলফি। ছবি: সাইয়ান

প্রিয় শিক্ষার্থীরা, তোমাদের জীবনে পড়াশোনার উদ্দেশ্য কী? একজন ভালো মানুষ হওয়া, ভালো একটা চাকরি বা ব্যবসা করা। এসো দেখি, এসব উদ্দেশ্য অর্জনে জিপিএ–৫–এর ভূমিকাটা কী। ভালো মানুষ তুমি নিঃসন্দেহে জিপিএ–৫ ছাড়াও হতে পারবে। ব্যবসা করতেও জিপিএ–৫ লাগে বলে কখনো শুনিনি। প্রশ্ন হচ্ছে চাকরি নিয়ে। জিপিএ–৫ ছাড়া চাকরি পাওয়া যাবে? তুমি যখন চাকরি খুঁজতে যাবে, তখন তোমাকে সিভি তৈরি করে চাকরিদাতার হাতে দিতে হবে। সেখানে চাকরিদাতা তোমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফল দেখবেন, তোমার সহ-শিক্ষা কার্যক্রম কেমন ছিল তা দেখবেন, তুমি কম্পিউটারে কতটা পারদর্শী, তা-ও দেখবেন। তোমার সিভিতে এইচএসসির রেজাল্ট পড়ে থাকবে তলানিতে। যদি উল্লিখিত বিষয়গুলো দারুণ থাকে, তাহলে চাকরিদাতার চোখ ওই তলানি পর্যন্ত যাবেও না। আর ওগুলোর অবস্থা যদি খারাপ থাকে, তাহলে তলানিতে পড়ে থাকা জিপিএ–৫ তোমার কোনো কাজে আসবে না। ইন্টারভিউ বোর্ডের জন্যও একই কথা সত্য। তোমাকে যখন কঠিন কঠিন প্রশ্ন করা হবে, তখন কি তুমি বলতে পারবে, ‘স্যার, আমি আসলে উত্তরটা জানি না। তবে এসএসসি বা এইচএসসিতে কিন্তু আমি জিপিএ–৫ পেয়েছিলাম!’

বন্ধুর সঙ্গে আনন্দের ভাগাভাগি সিলেট সরকারি মহিলা কলেজে। ছবি: আনিস মাহমুদ

কিন্তু ভাই, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হলে তো ভালো জিপিএ লাগে। হ্যাঁ। অবশ্যই লাগে। কিন্তু জিপিএর ঘাটতি যে ভালো প্রস্তুতি দিয়ে মেটানো যায় না, তা কিন্তু না। আজ থেকে ৮ বছর আগে যেদিন আমার এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়, সেদিন আমার বন্ধুরা সবাই বাসায় জিপিএ–৫ নিয়ে ফিরেছিল। আমি পারিনি। আমার ঝোলায় ছিল ৪.৭। চতুর্থ বিষয় বাদ দিলে ৪.১। হিসাব করে বুঝতে পারি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০ নম্বরের মূল্যায়নে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের ফলের ওপর যেই ৮০ নম্বর, সেখানে আমার আছে মাত্র ৭০.২৮। আমার বেশির ভাগ বন্ধুরই তখন ৮০। আমি প্রায় ১০ নম্বর পিছিয়ে আছি। তাই ঠিক করলাম, বন্ধুদের তুলনায় দ্বিগুণ পড়তে হবে, দ্বিগুণ খাটতে হবে। বন্ধুরা সিনেমা দেখতে যাচ্ছে, আমি যাচ্ছি না। বন্ধুরা ঢাকার বাইরে বেড়াতে যাচ্ছে, আমি যাব না। মাথার পেছনে ওই ১০ নম্বরের পিছিয়ে থাকা। মনকে বুঝ দেওয়া, ‘এই তিনটা মাস ভালোমতো খাটলে ওদের সঙ্গে সব সময়ই ঘুরতে যাওয়া যাবে। মাত্র তো তিনটা মাস।’

দিনাজপুরের হলিল্যান্ড কলেজে শিক্ষার্থীদের মিষ্টিমুখ। ছবি: রাজিউল ইসলাম

জীবনে কোনো দিন এতটা জোর দিয়ে পড়িনি, যতটা ওই তিন মাসে পড়েছি। এইচএসসির ফল প্রকাশের আগে ভাবতেও পারিনি, আমি ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম ২০০–এর মধ্যে থাকব। অথচ ১০ নম্বর পিছিয়ে গিয়েও শেষ পর্যন্ত ১১৬তম হলাম। এর জন্য সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব আমি দিই ওই ১০ নম্বর পিছিয়ে থাকাকে। সেই পিছিয়ে থাকা আমার মধ্যে অদ্ভুত একটা জেদ তৈরি করেছিল। ‘এই দশমিক ৩ নম্বর আমার জীবনের গতিপথ নির্ধারণ করে দেবে? হতেই পারে না।’ কচ্ছপ আর খরগোশের সেই গল্পটা মনে আছে? ওই ১০ নম্বর আমাকে দৌড়ের কচ্ছপ বানিয়ে দিয়েছিল। স্লো অ্যান্ড স্টিডি। রেস তো জিতবই, নাকি?

ড্রামের তালে মেতেছিলেন রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থীরা। ছবি: শহীদুল ইসলাম

তোমার জিপিএর ঘরে ৫–ই থাকুক আর ৩–ই থাকুক, এটা তোমার জীবনকে নির্ধারণ করে দেবে না। আজকের পর তোমার জীবনেও সেটা একটা সংখ্যা হয়েই রয়ে যাবে। যারা জিপিএ–৫ পেয়েছ, আমি তোমাদের অর্জনকে ছোট করে দেখছি না। তবে এখানেই থেমে যেয়ো না। আত্মতুষ্টিতে ভুগো না। আরও অনেকটা পথ বাকি। যে শক্ত মাটি তুমি পায়ের নিচে পেয়েছ, সেটাকে কাজে লাগিয়ে অনেক দূর এগিয়ে যাও। আর যারা জিপিএ–৫ পাওনি, তোমাদের এই পিছিয়ে থাকাকে অনুপ্রেরণায় পরিণত করো। নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করো, ‘এই একটা সংখ্যা আমার জীবনকে নির্ধারণ করে দেবে? হতেই পারে না!’

কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার সোনার বাংলা কলেজের শতভাগ শিক্ষার্থী পাস করেছেন। ছবি: প্রথম আলো

আর শেষ অনুরোধটা অভিভাবকদের জন্য। আপনার সন্তানের ফল যতই খারাপ হোক, সে এখনো আপনার সন্তান। ওর জীবনের এই কঠিন মুহূর্তে আপনার সমর্থন ওর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। আপনি যদি এই সময়ে ওকে আরও বেশি অপমান করেন, আপনার হতাশার বোঝা ওর কাঁধে চাপিয়ে দেন, তাহলে সামনে যে বড় লড়াইটা বাকি আছে, সেটাতে ও আরও বেশি পিছিয়ে পড়বে। কথায় কথায় ওকে অন্যের সঙ্গে তুলনা করবেন না। ‘অমুক গোল্ডেন ফাইভ পেল, তুই পেলি না কেন?’ এমন কথা কখনো বলবেন। আপনার সন্তানই হয়তো জীবনে এমন অনেক কিছু অর্জন করবে, যা সেই ‘অমুক’ কল্পনাও করতে পারেনি।

যারা এইচএসসিতে ভালো ফল পেয়েছ, তাদের অভিনন্দন। যারা পাওনি, তাদেরও অভিনন্দন। জীবন জয়ের দৌড়ে তোমাদের সবার জন্য শুভকামনা।

জিপিএ-৫ পাইনি, তবে...

সবার কথা বলার ধরন পাল্টে গিয়েছিল
সাব্বির হাসান, চতুর্থ বর্ষ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

এইচএসসি পরীক্ষায় আমার প্রস্তুতি ভালোই ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বন্ধুরা সবাই জিপিএ-৫ পেলেও আমি পাইনি। তখন চেনা-অচেনা যাঁদের সঙ্গেই দেখা হয়েছে, আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করেছি, সবারই আমার সঙ্গে কথা বলার ধরন পাল্টে গেছে। খুব হতাশ হয়েছি।

ঢাকার নটর ডেম কলেজে ক্যামেরায় ধরা পড়লেন দুই বন্ধু। ছবি: আবদুস সালাম

গণিতে আশানুরূপ ফল পাইনি। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল বিভাগে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার যোগ্যতাও ছিল না। প্রথমবার কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাইনি। আরও হতাশ হয়েছি। কোথাও ভর্তি হতে না পারার লজ্জায় এক বছর কোনো সামাজিক অনুষ্ঠান বা আত্মীয়স্বজনের বাসায়ও যাইনি। হাতে গোনা দু-একজন ছাড়া কোনো বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। নিজেকে পুরোপুরি গুটিয়ে নিই। তবে একসময় মনে হয়েছে, এভাবে বসে থাকলে সবাই আমাকে অথর্ব ভাববে। লোকজনের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে ভালো প্রস্তুতি নিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছিলাম। দ্বিতীয়বারে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) ভর্তির সুযোগ পাই।

২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক প্রথম বর্ষে ভর্তি হই শাবিপ্রবির ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগে। যেকোনো সফটওয়্যারের ফ্রন্ট অ্যান্ড ডিজাইনে (সাধারণের চোখে দৃশ্যমান অংশ) পারদর্শী ছিলাম। বিভাগের দুই বড় ভাই আবু সাবিক মাহদী ও কাজী মাঈনুল এবং পদার্থবিজ্ঞানের রাফি আদনান ভাইয়ের সঙ্গে দল গঠন করে গত বছর নাসা স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জে অংশ নিই। প্রাথমিক পর্যায়ে বাছাই প্রতিযোগিতা হয় নানা দেশের বিভিন্ন শহরে। আমার দল ‘অলীক’ সিলেট থেকে অংশ নেয়। জাতীয় পর্যায়ে বিজয়ী হই। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছয়টি বিভাগে ২৫টি দলকে ফাইনালিস্ট হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আমরা সেখানে স্থান করে নিয়েছিলাম। পরে আমাদের ক্যাটাগরিতে আমরা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হলাম।

পরীক্ষার ফল তো একটা না একটা কিছু হবেই। আমি মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর পড়াশোনার পাশাপাশি কারও কোনো কাজে বিশেষ পারদর্শিতা বা ইচ্ছা থাকলে সেটাকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। আন্তর্জাতিক কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে গেলে কেউ জিজ্ঞেস করবে না, এসএসসি বা এইচএসসিতে তোমার জিপিএ কত ছিল। অতএব দৃষ্টির সীমানা বড় করলে ক্ষতি কী!

ঢাকার ভিকারুন নিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দৃশ্য। ছবি: সাইফুল ইসলাম

হারানোর কিছু ছিল না
অনন্যা ইসলাম, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের স্নাতক

আমার ছোটবেলা কাটে কুষ্টিয়ায়। কুষ্টিয়া সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি দিই। সেবার সব বন্ধু জিপিএ–৫ পেলেও আমি পেলাম ৪.৮১। বাসা থেকে তেমন কিছু বলল না যদিও। তবে একমাত্র মেয়েকে নিয়ে বাবা-মায়ের স্বপ্ন ছিল অনেক। তাঁদের হতাশা, দুঃখ ঠিকই টের পেলাম। আশপাশের সবাই বলতে লাগল, ‘এসএসসিতেই বিজ্ঞান বিভাগে ভালো করলে না, এইচএসসি তো আরও কঠিন। বিভাগ বদলে ফেলো।’

ছোটবেলা থেকে ইচ্ছা ছিল স্থাপত্যে পড়ার। ভালো আঁকতাম। বাবা ভীষণ উৎসাহ দিতেন। যা করতে চাই, তাতেই পাশে থাকতেন। বিভাগ পরিবর্তন করলে নিজের স্বপ্ন পূরণ সম্ভব না। তাই বিজ্ঞান বিভাগেই থেকে গেলাম। জীবনের এই সিদ্ধান্ত নেওয়া একটা মফস্বলের মেয়ের জন্য সহজ ছিল না। তখন পড়াশোনার চেয়েও বড় দুশ্চিন্তার জায়গা ছিল, ‘লোকে কী বলবে’! নিজেকে বোঝালাম, না পারলেও চেষ্টা করি। হলে হবে, না হলে নেই।

এইচএসসিতেও খুব ভালো ফল হলো না। এবার পেলাম ৪.৩০। এই জিপিএ নিয়ে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য পড়তে না পারলেও সুযোগ ছিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকে স্থাপত্যে ভর্তি হলাম। জীবনের মোড়টা বাঁক নেয় তখন থেকেই। বাংলা মাধ্যম থেকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা বা মফস্বলের ছোট্ট আঙিনা পেরিয়ে এই বড় শহরটা অচেনা ছিল, কঠিন ছিল। আমি চেষ্টা ছাড়িনি। স্থাপত্যবিষয়ক সব কর্মশালা, প্রতিযোগিতা আর বিভিন্ন আয়োজনে অংশ নিতাম। প্রচুর খাটতাম। ভাবতাম, যা হারানোর হারিয়েছি, আমার তো আর হারানোর কিছু নেই! তাই ছুটতাম—শেখার জন্য। জানার জন্য।

২০১৬ সালে আর্ক এশিয়া স্টুডেন্ট জাম্বুরিতে বাংলাদেশ থেকে প্রতিনিধি হিসেবে অংশ নিলাম হংকংয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিআইআরডিআইডির প্রশিক্ষণে গিয়েছিলাম ভারতের চেন্নাইয়ে। এই লেগে থাকার ফলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিনস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি। পুরস্কার জিতেছি সত্যজিৎ রায়ের বাড়ির নকশা করেও।

মানুষের মুখ অবশ্য বন্ধ হয়নি। কটাক্ষ করে অনেকে বলত, ‘মেয়ে স্থাপত্যে পড়ে, তার ওপর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে!’ পড়াশোনা শেষে শুধু চাকরি পাওয়া না, ভালো জায়গায় চাকরি পাওয়া ছিল চ্যালেঞ্জ। আমার থিসিস প্রকল্প ছিল আগা খান একাডেমি। মূলত এই ইনস্টিটিউট প্রকল্পে ভালো ফলের সুবাদেই চাকরি পেয়ে যাই বিশ্বের এক নম্বর এনজিও—ব্র্যাকে। এখন ব্র্যাক শিক্ষা উন্নয়ন ইনস্টিটিউটে আছি স্থপতি হিসেবে। জিপিএ-৫ না পাওয়ায় হাল ছেড়ে দিলে হয়তো হারিয়েই যেতাম। জীবনযুদ্ধটা অনেক বড়। জিপিএ-৫ এ তা শেষ হয় না, হয়নি।

এইচএসসিতে পেয়েছিলাম ৪.১
সাদমান আহমেদ, ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

যদিও আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে (আইবিএ) আবেদন করার পর প্রায় তিন বছর পেরিয়ে গেছে, এখনো মনে হয় এই তো সেদিনের কথা। কদিন আগেই বুঝি আমি ভর্তি পরীক্ষার হলে বসে ছিলাম! আমি বলব না আমার যাত্রাটা খুব কঠিন ছিল। কিন্তু খুব সহজও নিশ্চয়ই ছিল না।

উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হতে না–হতেই আমি একটা বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম। খুব ভালোভাবে বুঝতে পারছিলাম, আমার ফল ভালো হবে না। অতএব আমি আমার সামনে দুটো লক্ষ্য ঠিক করলাম। প্রথমত, এসএটি পরীক্ষা দেব। দ্বিতীয়ত, আইবিএতে চেষ্টা করব। দুটো পরীক্ষাই অনেকটা কাছাকাছি ধরনের। অতএব এই সুযোগে নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করে নেওয়াই যায়।

আমি চট্টগ্রামের ছেলে। স্পষ্ট মনে আছে, আমার অনেক বন্ধুই বলেছিল, আইবিএর জন্য চেষ্টা করাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। কেননা তখন সবাই দলে দলে একই কোচিং সেন্টারে ভর্তি হচ্ছিল। আমার মনে হলো, আমি একটা ভেড়ার পালের অংশ। মনে হলো, একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি। কিন্তু আমি হাল ছাড়লাম না। অঙ্কে কাঁচা ছিলাম। প্রথম দিন, স্রেফ ২০টা সমস্যার সমাধান করতে আমার প্রায় আড়াই ঘণ্টা লেগে গিয়েছিল। খুব যে অনুশীলন করেছি তা নয়। কিন্তু আমি প্রতিদিনই অনুশীলন করতাম। জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়টায় এগোনোর জন্য নিজের মতো করে একটা পদ্ধতি বেছে নিয়েছিলাম। প্রতিদিন ছোট ছোট লক্ষ্য ঠিক করতাম, প্রতিদিনই এই ছোট্ট লক্ষ্যটা অর্জনের চেষ্টা করতাম।

মনে আছে, যখন জানলাম এইচএসসিতে ৪.১ পেয়েছি, একা একা আমি আমার ঘরে বসে ছিলাম। আমার আসলে প্রতিদিন অনুশীলন করা আর কিছু করার ছিল না। বন্ধুরা একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিচ্ছে, অন্যদিকে আমার আহছানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার যোগ্যতাও ছিল না। আমি কেবল অনুশীলন করেই গেছি, করেই গেছি। এর ফলে যা হয়েছে—আমার গতি বেড়েছে, আরও নিখুঁতভাবে সমস্যার সমাধান করতে শিখেছি।

দিনরাতের খাটনি সার্থক হলো তখন, যখন শুনলাম আইবিএর ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে আমার রোল নম্বরটাও আছে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করানোর জন্য দ্বিতীয়বার আমাকে ফলটা দেখতে হয়েছে। আমি এক দিনও অনুশীলন বাদ দিইনি, এটাই সবচেয়ে বড় কথা। তাই সবার জন্য আমার পরামর্শ হবে একটাই—অনুশীলন।