মৌসুমীর আগেই ঢালিউডে ওমর সানীর অভিষেক। চলচ্চিত্রে একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে ভালোবাসার সম্পর্ক। এরপর হুট করেই বিয়ে করে ফেলেন তাঁরা। এরই মধ্যে ২৫ পেরিয়েছে তাঁদের বিয়ের বয়স। মৌসুমী–ওমর সানীর প্রথম পরিচয়, প্রেম-ভালোবাসা ও বিয়ের গল্প শুনল প্রথম আলো
কেয়ামত থেকে কেয়ামত ছবির মহরতে দুজনের প্রথম দেখা। তত দিনে ওমর সানীর প্রথম সিনেমা মুক্তি পেলেও মৌসুমীর তখনো শুটিংই শুরু হয়নি। তাঁদের প্রথম কথা হয় মৌসুমীর বাসায়। সেটা ১৯৯২ সালের ঘটনা। কেয়ামত থেকে কেয়ামত তখনো রিলিজ হয়নি। নতুন একটি সিনেমায় ওমর সানীর বিপরীতে মৌসুমীকে নিতে চাইলেন পরিচালক শেখ নজরুল ইসলাম । সে বিষয়ে কথা বলতেই সানীকে নিয়ে মৌসুমীর বাসায় হাজির হলেন পরিচালক। মৌসুমীরা তখন মোহাম্মদপুরের হুমায়ুন রোডে থাকেন। ড্রয়িংরুমে বসার ২০ মিনিট পর মৌসুমী এসে বসলেন।
সানীর উদ্দেশে বললেন, ‘সানী ভাই, আপনার চাঁদের আলো তো আমরা সবাই দেখলাম। বেশ ভালো করেছেন। কিন্তু আমি তো এই ছবিটা করতে পারছি না। অন্য কমিটমেন্ট আছে।’ মন খারাপ করে বাসায় ফিরলেন নায়ক।
১৯৯৩ সালে মুক্তি পায় কেয়ামত থেকে কেয়ামত। ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর ওমর সানী ও মৌসুমীকে নিয়ে একটি সিনেমা বানানোর পরিকল্পনা করে চার–পাঁচজন প্রোডাকশন ম্যানেজার। মোহাম্মদপুরে একটি শুটিং স্পটে ওমর সানীর সঙ্গে দেখা করেন তাঁরা।
বললেন, ‘আমরা একটা সিনেমা বানাব, দোলা। নাম শুনেই ওমর সানী বললেন, ‘না না। নারীপ্রধান ছবি করব না।’ ওমর সানীর চার-পাঁচটি ছবি তখন সুপারহিট। না বলার পরও গল্পটা শুনে ভালো লাগল, রাজি হয়ে গেলেন সানী। দোলা সিনেমা দিয়ে জুটি গড়লেন মৌসুমী–সানী।
সিলেটে আউটডোরে শুটিং করতে গিয়ে দুজনের মনোমালিন্য হলো। কাজ শেষ করে ঢাকায় ফিরলেন তাঁরা। ওমর সানী বলেন, ‘এরপর কেন জানি মেয়েটার জন্য মায়াই লাগল। যে বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে বেশি ধাক্কা দিয়েছিল, সেটা ওর (মৌসুমীর) ব্যক্তিত্ব। ওই সময় অন্য যাঁরা কাজ করতেন, তাঁদের থেকে আলাদা। তাঁর বাবাও ছিলেন খুব স্মার্ট ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। পুরো পরিবারের প্রতি আলাদা একটা শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হলো। ভেতরে-ভেতরে হয়তো ভালোবাসাও জন্মে গেল।’
দোলার পর রায়হান মুজিবের আত্ম অহংকার–এর শুটিং করতে জৈন্তাপুরে গিয়েছিলেন মৌসুমী ও ওমর সানী। তত দিন দুজনের মধ্যে বোঝাপড়া বেড়েছে। এই ছবির শুটিং সেই বোঝাপড়াকে আরও দৃঢ় করেছে। এই শুটিংয়ের সময়ও তাঁদের মধ্যে রাগারাগি, মান–অভিমান যেমন হয়েছে, তেমনি অনেক মজাও হয়েছে।
৩ নভেম্বর মৌসুমীর জন্মদিন। ২ নভেম্বর শুটিং শেষ করে রাত সাড়ে দশটার দিকে সানীকে দাওয়াত দিতে গেলেন নায়িকা, ‘হিরো, কালকে আমার জন্মদিন। দুপুরে আমার সঙ্গে খাবেন।’
দাওয়াত পেয়ে চিন্তাতেই পড়ে গেলেন সানী, ‘মৌসুমীকে কী দেওয়া যায় ভাবছিলাম। এমন অজপাড়াগাঁ, কিছুই তো নেই। গলায় তখন সাড়ে তিন–চার ভরি ওজনের একটা স্বর্ণের চেইন ছিল। হঠাৎ সেটা খুলে ওর হাতে দিয়ে দিলাম। বললাম, আমি তোমায় কি যে দেব? এখানে তো ফুলটুলও কিছুই নেই। ও তো হতবাক। বললাম, এটাই তোমার উপহার। আমি তোমাকে দিচ্ছি, তুমি এটা রাখো। মা আমাকে এই চেইনটা দিয়েছিলেন।’
সিলেটে শুটিং শেষ করে তাঁরা ঢাকায় চলে আসেন। যে যাঁর মতো শুটিংয়ে ব্যস্ত। একদিন সকালে ওমর সানীর তেজতুরী বাজারের বাড়ির সামনে এসে থামে একটি মাইক্রোবাস। ঘোমটা পরা একটি মেয়ে সানীর মায়ের সঙ্গে দেখা করেন। সেই মেয়েটি ছিল মৌসুমী। তাঁকে দেখে ওমর সানীও অবাক। ওমর সানী বললেন, ‘মৌসুমী এসে আমাকে জানাল, “সানী ভাই, আপনাকে নিয়ে আমি একটা দুঃস্বপ্ন দেখছি। ভাবলাম, এফডিসিতে ঢোকার আগে আপনার সঙ্গে দেখা করে যাই।” তখনই বুঝেছিলাম, কিছু একটা হয়তো হচ্ছে।’
দিনে দিনে ভালো লাগা বাড়তে লাগল। একসময় সেই ভালো লাগা চেপে রাখতে না পেরে মায়ের কাছে বলে বসলেন ওমর সানী। এদিকে সাংবাদিকেরাও তাঁদের প্রেমের সম্পর্ক আঁচ করতে পারেন। আত্ম অহংকার মুক্তির পর একটি ম্যাগাজিনে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে ওমর সানী মুখ ফসকে বলে ফেলেন, ‘আমি ওকে (মৌসুমী) ভালোবাসি। ও আমাকে ভালোবাসে কি না জানি না।’ ওমর সানীর সাক্ষাৎকার পড়ে মৌসুমী অবাক । সানীকে বললেন, ‘এটা বলা কি আপনার ঠিক হলো?’ সানীর উত্তর, ‘বলেছি তো বলেছিই। ঠিক হইছে কি না, জানিটানি না। কইয়াই তো ফালাইছি। ভালোবাসা না হইলে যাও, তুমি তোমার মতো কাজ করো, আমি আমার মতো। মানুষ যদি কিছু বলে আমারে বলবে।’
তত দিনে ওমর সানীর মা মৌসুমীকে ভীষণ পছন্দ করে ফেলেছেন। ছেলের বউ যে বানাবেন, এ কথা বলেও দিয়েছেন। মৌসুমীর শুটিংয়ে মাঝেমধ্যে তাঁর নানিও আসতেন। সানীর মায়ের সঙ্গে মৌসুমীর নানির একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাঁরা দুজনই উদ্যোগী হলেন। মৌসুমী বললেন, ‘নানি বলতেন, ছেলেটাকে আমার পছন্দ। ওর সঙ্গে তোকে বিয়ে দেব। তিনিই ছিলেন দুই পরিবারের মূল মধ্যস্থতাকারী।’ তবে মৌসুমীর মা কখনোই চাননি, ফিল্মের কেউ তাঁর মেয়েকে বিয়ে করুক। এরপর একটা পর্যায়ে তিনিও রাজি হলেন।
তত দিনে মৌসুমী–ওমর সানীর বাসার ঠিকানা বদলে গেছে। মহাখালী ডিওএইচএসের ৩২ নম্বর রোডে থাকেন মৌসুমী আর ওমর সানী ৩১ নম্বর রোডে। একদিন সানীদের বাসায় মৌসুমীকে নিয়ে হাজির তাঁর নানি। সানীর মাকে বললেন, এক্ষুনি কাজি ডাকেন, আজই ওদের বিয়ে দেব।’ কাজি ডেকে সেদিনই বিয়ে হলো। দিনটা ছিল ১৯৯৫ সালে ৪ মার্চ। মৌসুমী ও ওমর সানীর বিয়ের খবর কেউ জানতেন না। ওমর সানী বলেন, ‘বিয়ের পর দুজনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম কাজ চালিয়ে যাব, তাই কাউকে জানাইনি।
তবে দুজন পরিচালক বিয়ের খবরটা জানতেন।’ বিয়ের কয়েক মাস পর দুজনে জানতে পারেন, মা–বাবা হতে যাচ্ছেন তাঁরা। কেউ কেউ ওই সময় মৌসুমীর মা হওয়ার বিষয়টিকে সমর্থন করেননি। তবে মৌসুমী ছিলেন অনড়। ওমর সানী বললেন, ‘ছেলে ফারদীনের পৃথিবীতে আসার ঘোষণার পর থেকেই আমি একজন মা মৌসুমীকে দেখলাম। সে অন্য এক মৌসুমী। শ্বশুর চাইলেন এই সময়ে বিয়ের কথা জানাতে। এদিকে দু্ই পরিচালক এ জে মিন্টু ও দেলোয়ার জাহান ঝন্টু সাহেব দুজনেই বললেন, “আপাতত জানাইয়ো না। এটা বাংলাদেশ, বুঝোই তো।” কিন্তু আমরা সিদ্ধান্ত নেই, জানলে জানুক, তাতে কী। ফারদীন গর্ভে আসার চার মাস পর বিয়ের অনুষ্ঠান করি আমরা।’
মৌসুমীর গায়েহলুদ হয় তাঁর বাড়ির ছাদে আর ওমর সানীরটা বাসার ভেতরে। ওমর সানী বললেন, ‘৩ আগস্ট ১৯৯৫ সালে রাওয়া ক্লাবে আমাদের বউভাত হয়। আগের দিন বরযাত্রী হয়ে যেতে হয় শেরাটন হোটেলে। মৌসুমীর চাওয়া ছিল, আমি যেন ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে যাই। তাঁর ইচ্ছার প্রতি সম্মান দেখিয়ে আমি তাই-ই করি। আমার সেই গাড়িতে বাপ্পারাজ, অমিত হাসানসহ আরও অনেকে ছিল। ঘোড়ার গাড়ির পেছনে ওই সময়ে ১১৭টা প্রাইভেট কারের বহরও ছিল। যদিও এখন এটা কিছুই না। এত গাড়ির কারণে মহাখালী ডিওএইচএস থেকে শেরাটন পর্যন্ত রাস্তা প্রায় ব্লক হয়ে গিয়েছিল বলা যায়। আমি যখন বিজয় সরণিতে ঘোড়ার গাড়িতে, তখন শেষ গাড়িটি আমার বাসার সামনে।’
সংসারের ২৫ বছর কবে পার হয়েছে টেরই পাননি মৌসুমী ও ওমর সানী। সানী বলেন, ‘মনে হয়, এই তো কদিন আগে বিয়ে হয়েছে।’ মৌসুমী জানান, বিয়ের আগে তাঁদের খুব একটা প্রেম করা হয়নি। তাঁরা প্রেম করেছেন বিয়ের পর। মৌসুমী বলেন, ‘শুধু দাম্পত্যে নয়, যেকোনো সম্পর্কেই বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা থাকতে হবে। বন্ধুত্বের মধ্যেও তা-ই। বন্ধুকে ভালো না বাসলে, শ্রদ্ধা না করলে বন্ধুত্ব টিকবে না।’