প্রযুক্তি হতে হবে মঙ্গলের জন্য

>

অনেক পরিশ্রম করে আলিবাবা নামের প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছেন জ্যাক মা। বিশ্ববাজারে যে প্রতিষ্ঠানটি চীনের ঝান্ডা তুলে ধরেছে সগর্বে। জ্যাক মা ২০১৩ সাল পর্যন্ত এর মুখ্য নির্বাহী ছিলেন। এরপর পালন করেছেন চেয়ারম্যানের গুরুদায়িত্ব। সেপ্টেম্বরের ১০ তারিখে তাঁর বয়স ৫৫ হলো। ঠিক সেদিন নিজের শহর হাংঝোউয়ে জমকালো অনুষ্ঠানের মঞ্চে উঠে বিদায় বললেন আলিবাবাকে। সেদিন একই সঙ্গে আলিবাবার ২০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীও পালন করলেন এর ৬০ হাজার কর্মী। বিদায়বেলায় আলিবাবার পথচলার গল্প বললেন জ্যাক মা, আলোকপাত করলেন ভবিষ্যৎ প্রযুক্তিতে।

জ্যাক মা
জ্যাক মা

জ্যাক মা
আজকের এই দিনটির জন্য ১০ বছরের বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করছি। দিনটি যে এত দ্রুত আর চমৎকারভাবে এসে যাবে, তা সত্যিই আশা করিনি। এই প্রতিষ্ঠান যাঁরা গড়ে তুলেছেন, তাঁদের ধন্যবাদ জানাই। আলিবাবার সব কর্মী, বন্ধু, ফেলে আসা সুবর্ণ সময়, এই দেশ এবং অসাধারণ এই শহরকেও ধন্যবাদ। যেকোনো অনুষ্ঠান সফল করার ব্যাপারে আলিবাবার কর্মীরা সিদ্ধহস্ত। আমাদের মতো পেশাদারির সঙ্গে অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পারে, এমন আর কোনো প্রতিষ্ঠান খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। অনেকেই ভাবেন, আলিবাবা এমন এক প্রতিষ্ঠান, যেখানে কাজই সব। তবে আমাদের প্রতিষ্ঠানের মূলমন্ত্রের সঙ্গে এটাও সংগতিপূর্ণ: ওয়ার্ক হার্ড প্লে হার্ড। ১৮ বছর ধরে এভাবেই উদ্​যাপন করে আসছি আমরা। আশা করি, আলিবাবার ৩০ বছর পূর্তিতে পৃথিবীতে আমরা আরও অনেক রোমাঞ্চের জন্ম দেব।

বছর ১৫ আগে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলাম, আলিবাবা যেন ১০২ বছর টিকে থাকে। সেটিকে এখন তিন শতকে বিস্তৃত করছি। তো ওই লক্ষ্য ঠিক করার পর থেকে ভাবছিলাম, এটা আমরা অর্জন করব কীভাবে? অনেকেই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্যকে স্রেফ ফাঁকা বুলি হিসেবে ধরে নেয়। যা হোক, আলিবাবার কর্মীরা জানতেন, লক্ষ্যের ওপর বিশ্বাস রাখলে তা বাস্তবে রূপান্তর করা সম্ভব। একটি প্রতিষ্ঠানকে সচল রাখতে কী করতে হয়, তা বোঝার জন্য আমরা আরও অনেক প্রতিষ্ঠানে ঢুঁ মেরেছি এবং খেয়াল করে দুটি মৌলিক পথের খোঁজ পেয়েছি: প্রথমটি হলো প্রতিষ্ঠাতার পরবর্তী প্রজন্মের হাতে ব্যবসা বুঝিয়ে দেওয়া। দ্বিতীয়টি হলো পেশাদার ব্যবস্থাপক খুঁজে বের করা। কিন্তু আমরা তৃতীয় পথ বেছে নিয়েছি। আর সেটি হলো নিজেদের কর্মীদের গড়ে তোলা এবং প্রতিষ্ঠানের নিয়মকানুন ও সংস্কৃতির মাধ্যমে সাফল্যের ধারা নিশ্চিত করা। আর এ কারণেই ১০ বছর ধরে আমি এই দিনটির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি।

সিদ্ধান্তটি আমি হুট করে নিইনি, এমনকি কোনো রকম চাপের কারণেও নয়। অনলাইনে গুজব আছে, আমি কোনো কিছু নিয়ে ভীত। আলিবাবার কর্মীরা কখনোই কোনো কিছুতে ভীত নন। ভবিষ্যতের ওপর আমাদের ভীতি নয়, ভক্তি আছে।

আজকের এই দিনটি আমার অবসরের কথা বলবে না বরং আলিবাবায় আমার উত্তরাধিকার প্রকল্পের সূচনার কথা মনে করিয়ে দেবে। আজকের দিনটি এক ব্যক্তির পথ বেছে নেওয়ার কথা বলবে না, বলবে প্রতিষ্ঠানটির নিয়ম–শৃঙ্খলার সাফল্যের গাথা। মৌলিক কিছু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এই পৃথিবী, যার প্রভাব পড়ছে সবার ওপর। বিশ্বায়নের কারণে সামনে দাঁড়াচ্ছে অনেক চ্যালেঞ্জ। নতুন প্রযুক্তি এবং চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য-ঝঞ্ঝার কারণে বাড়ছে দুশ্চিন্তা। এর সঙ্গে প্রাকৃতিক পরিবেশের অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে একটা সংকেতই পাচ্ছি—শিগগিরই নতুন যুগ আসছে। যেসব ঝুটঝামেলা এবং দ্বিধায় আমরা আজ ভুগছি, আমার ধারণা, এসব স্বল্পমেয়াদি।

ভবিষ্যতে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে তিনটি বড় লক্ষ্যের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। টেকসই উন্নতি, ব্যাপকতা এবং পরোপকার। প্রযুক্তি এই তিন লক্ষ্য অর্জন করতে না পারলে দুনিয়া আরও গোলমেলে হয়ে উঠবে। যাবতীয় মুশকিলের আসান হবে নিজেকে বদলাতে পারলে। অন্যের বদলের মধ্য দিয়ে সমাধান সম্ভব নয়। অনেকেই বলেন, আমার দৃষ্টিভঙ্গি সব সময় বৃহৎ। আমি নাকি সবকিছু গোটা মানবজাতির দৃষ্টিতে দেখি। তবে আমি জেনেবুঝে এমনটা করিনি।

আমাদের প্রজন্ম সর্বকালের সবচেয়ে সৌভাগ্যবান। আমাদের প্রজন্ম সবচেয়ে দীর্ঘ শান্তিপূর্ণ এক সময় কাটিয়েছে। এর সঙ্গে সাংস্কৃতিক বিপ্লব এবং মহৎ কিছু সংস্কারের স্বাদও পেয়েছে। আমরা শিল্প–বাণিজ্যের অর্জনগুলো দেখেছি। আবার তথ্যচালিত যুগে পা রাখার চ্যালেঞ্জও আঁচ করেছি। আমরা দুটি যুগের মধ্য দিয়ে গেছি, আমরা ঝামেলা না পোহালে কে পোহাবে? তবে কেবল এ অভিজ্ঞতা থাকলেই চলবে না, নিজেদের বদলাতে হবে।

একুশ শতকে আপনি কেমন মানুষ বা কোন প্রতিষ্ঠানের কর্মী, তা কোনো ব্যাপারই নয়। উদারতাই মহাশক্তি। অনেকেই বলেন, আমার কপালটা খুব ভালো ছিল। কিন্তু আদতে আর দশটা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে আলিবাবার ভুলের পরিমাণ কম নয়। তবে আমরা অনেক সঠিক সিদ্ধান্তও নিয়েছি। কারণ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমরা ব্যবসার কথা বিবেচনা না করে সিদ্ধান্ত নিইনি। গত ২০ বছরে যেসব জটিল সিদ্ধান্ত আমরা নিয়েছি, তা কেবল অর্থের জন্যই ছিল না।

গত ১০ সেপ্টেম্বর, জন্মদিনে আনুষ্ঠানিকভাবে আলিবাবাকে বিদায় জানালেন জ্যাক মা। ছবি: সংগৃহীত

সত্যিই, সামনে চীনের জন্য বিশাল সুযোগ। এত জনসংখ্যার দেশ খুব বেশি নেই। কমই আছে সমন্বিত ব্যবসার এমন অবকাঠামো। সবচেয়ে বড় সুযোগ তো বসে আছে চীনের নিজস্ব চাহিদার ভেতরেই। চাহিদা বৃদ্ধি পেলে কেবল চীন নয়, গোটা দুনিয়ার অর্থনীতিই চাঙা হয়ে উঠবে। এই চাহিদা বৃদ্ধির জন্য যে উদ্দীপনা প্রয়োজন তা সরকারি ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করছে না, বাজারকেন্দ্রিক একটি অর্থনীতি হলেই যথেষ্ট। আজ আমরা চীনের মানুষেরা দারুণ আত্মবিশ্বাসী। যদিও বিশ্ব আমাদের অন্য চোখে দেখে। চীন, আমাদের প্রযুক্তি ও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভয় পায় বলেই এভাবে দেখে। আমি বিশ্বাস করি, প্রযুক্তি হতে হবে মঙ্গলের জন্য। প্রযুক্তি যেন মানুষের মনে হতাশার বদলে আশার জন্ম দেয়। আমি এটাও আশা করি, আলিবাবা ভবিষ্যৎ বিশ্বায়নের নতুন ঢেউয়ে গা ভাসাবে। বিশ্বজুড়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে পণ্য বিপণনে সহযোগিতা করবে এবং আর্থিক সহযোগিতার হাতও বাড়িয়ে দেবে।

আমার একবার গ্রিনিচ মানমন্দির ঘুরে আসার সুযোগ হয়েছিল। গোটা ছায়াপথে আমি সূর্য কিংবা পৃথিবী খুঁজে পাইনি। ঠিক সেই মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিল, আমরা আসলে কিছুই না। পৃথিবীতে কত কিছু আছে, যা আমি উপভোগ করতে চাই এবং এমন অনেক কিছুই আছে, যেগুলো খুব ভালো বা সঠিক নয়, সেগুলো নিয়েও কাজ করতে আগ্রহী।

২০১৩ সালে আমি মুখ্য নির্বাহীর পদ ছেড়ে দিয়েছি। তবে ছেড়ে দেওয়ার পরের ছয়টি বছর যে এতটা ব্যস্ততায় কাটবে, তা কখনো ভাবিনি। একইভাবে চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে দেওয়া মানেই অবসরে যাওয়া নয়। আমি থেমে যাব না এবং আলিবাবা আমার অনেকগুলো স্বপ্নের একটি মাত্র। শিক্ষা, পরিবেশ রক্ষা এবং জনহিতকর আরও অনেক কাজ করতে চাই। ফলে কত যে জায়গা আছে, যেখানে আমি যাওয়ার জন্য মুখিয়ে আছি।

আজকের পর থেকে জীবনের নতুন এক অধ্যায় শুরু করব। আমি সজীবতা ভালোবাসি। আমি অবসর চাই না এবং এত কম বয়সে মাঠও ছাড়তে চাই না। জীবনটা উপভোগ করতে আমি কেবল আরেক মহাজগতে প্রবেশ করতে চাইছি। পাহাড় যেমন ক্রমেই আকাশমুখী, জলধারা যেমন বহমান, তেমনি ভবিষ্যতের কোনো এক সময় আমাদের আবার দেখা হবে, নিশ্চয়ই হবে!

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মাহফুজ রহমান
সূত্র: কিউজেড ডটকম