প্রবাসী শিশুদের বাংলা শেখায় টিংকার্স

অনলাইনের মাধ্যমে চলে ক্লাস
ছবি: টিংকার্সের সৌজন্যে

ভাষা শেখা একটি সহজাত প্রক্রিয়া। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজের মাতৃভাষা বাংলা আমরা রপ্ত করে ফেলি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই। কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে প্রবাসী বাংলাদেশিরা আছেন, তাঁদের সন্তানদের বেলায় ব্যাপারটা এত সহজ নয়। কারণ, তাঁদের সন্তানেরা বেড়ে ওঠেন একেবারেই ভিন্ন পরিবেশে। তাহলে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই শিশুরা তাদের মাতৃভাষা শিখবে কীভাবে? সমস্যাটা উপলব্ধি করেছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন তরুণ। সমাধানও খুঁজেছেন তাঁরা। আর এভাবেই জন্ম হয়েছে ‘টিংকার্স আমার ভাষা’ নামের একটি উদ্যোগের।

শুরুর গল্প

স্কুলজীবন থেকেই তিন বন্ধু মুনেম শাহরিয়ার, রুহুল আমিন ও মেহেদী হাসানের কম্পিউটার প্রযুক্তির প্রতি আলাদা টান। এই টানই তাঁদের একবিন্দুতে মিলিয়েছে। ভর্তি হয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে। প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহ আর একটা কিছু করার তাগিদ থেকে যখন ভাবছিলেন কী করা যায়, তখনই এক প্রবাসী বড় ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ‘আইডিয়া’টা মাথায় আসে। প্রবাসী সন্তানদের বাংলা ভাষা শেখানোর এই আইডিয়া বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশিপ সেন্টারের (বিওয়াইএলসি) একটি প্রতিযোগিতায় পুরস্কার জিতে নেয়। পুরস্কারের প্রাপ্ত অর্থ থেকে তিন বন্ধু দাঁড় করিয়ে ফেলেন একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠান। এরপর এমপাওয়ার এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড, ডাটাবার্ড লাঞ্চপ্যাড, বঙ্গবন্ধু ইনোভেশন গ্র্যান্ডসহ বেশ কয়েকটি জায়গা থেকে পেয়েছেন পুরস্কার ও তহবিল।

বাঁ থেকে মেহেদৗ হাসান, রুহুল আমিন ও মুনেম শাহরিয়ার

কেমন চলছে কার্যক্রম

যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জার্মানি, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডসহ নানা দেশের শিশু-কিশোর-তরুণদের বাংলা ভাষা শেখাতে কাজ করছে এই তরুণদল। একজন শিক্ষক বাংলাদেশে বসেই অনলাইন ভিডিও কলিংয়ের মাধ্যমে প্রবাসী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন। প্রতি ক্লাসের পর শিক্ষার্থীকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় একটি ভিডিও লেসন অথবা কিছু প্রিন্টযোগ্য উপকরণ। ওয়ান-টু-ওয়ান টিউটোরিং, বিভিন্ন বই, প্রিন্টযোগ্য ওয়ার্কশিট, গেম, ভিডিও, অডিও, নানা শিক্ষা উপকরণ দিয়ে বাসায় বাংলা চর্চা করতে পারে শিক্ষার্থীরা। বর্তমানে ১০০ শিক্ষার্থী ও ৩৫ জন শিক্ষক নিয়ে চলছে এই কার্যক্রম। সাপ্তাহিক বা মাসিক ভিত্তিতে ক্লাস বা প্যাকেজ আকারে শিশুদের জন্য টিংকার্সের এই সেবা নিতে পারেন প্রবাসী অভিভাবকেরা। যার জন্য মাসে ৪০-১০০ মার্কিন ডলার খরচ করতে হয়।

শুধু ভাষা শেখানো নয়, প্রবাসী শিশুদের বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি আরও বেশি আগ্রহী করতেও কাজ করছে টিংকার্স। তাই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস তো বটেই; পয়লা বৈশাখ, পয়লা ফাল্গুনের মতো উৎসবগুলোও অনলাইনে শিশুদের সঙ্গে নিয়ে উদ্‌যাপন করেন তাঁরা।

‘টিংকার্স আমার ভাষা’র সহপ্রতিষ্ঠাতা মুনেম শাহরিয়ার বলেন, ‘আমরা যদি শিশুদের আনন্দ দিতে না পারি, তাহলে আসলে কখনোই অনলাইনে ভাষা শেখানোর মতো জটিল কাজটা করা সম্ভব না। ওরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। তাই আমরা সব সময় শিশুদের বাঙালি সংস্কৃতি সম্পর্কে জানাতে চেষ্টা করি।’

শিক্ষক, অভিভাবকেরা যা বলছেন

যাত্রা শুরুর পর থেকে শিক্ষক হিসেবে টিংকার্সের সঙ্গে আছেন ফারহা মেহজাবিন। তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, জন্মের পর থেকে ভিন্ন একটি পরিবেশে বেড়ে ওঠা শিশুদের অনলাইনে বাংলা শেখানো কতটা চ্যালেঞ্জের? ফারহা বলেন, ‘সত্যি বলতে শুরুর দিকে কাজটি আমার জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল। কিন্তু
আমি যখন ৪-৫টি ক্লাস নিয়ে ফেললাম, তখন দেখলাম শিশুরাও আমার সঙ্গে কমফোর্টেবল হয়ে উঠছে। তখন বুঝতে পারলাম, গতানুগতিকভাবে শেখানোর মানসিকতা নিয়ে ওদের সঙ্গে না বসে বরং গল্পচ্ছলে, মজা করে শেখালে সেটা বেশি কাজে দেয়। প্রতিটা ক্লাসে আমরা তাই গল্প বলতে চেষ্টা করি, বাস্তব উপকরণ দেখিয়ে শিখনটাকে আরও সহজ করে তুলি।’

সাজ্জাদ খান নামের এক প্রবাসী বাংলাদেশি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন থেকে তাঁর সন্তানকে টিংকার্সে দিয়েছেন বাংলা ভাষা শেখাতে। বলছিলেন, ‘অনলাইনে একটা বাচ্চাকে নতুন ভাষা শেখানো সত্যিকার অর্থেই কঠিন কাজ। টিংকার্স সেই কঠিন কাজটিই করছে।’

ভবিষ্যৎ ভাবনা

টিংকার্সের এই উত্তরণ কাছ থেকে দেখেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তানভীর হোসেন। তিনি বলেন, ‘রুহুল, মুনেম ও মেহেদী তিনজনই উদ্যমী ছাত্র। তারা প্রথম বর্ষ থেকেই বিভিন্ন ইনোভেটিভ আইডিয়া নিয়ে কাজ করত। ওরা যখন চতুর্থ বর্ষে পড়ে, তখন “বর্ণমালা এআর” নামে একটা প্রকল্পে আমি নির্দেশনা দিয়েছিলাম। সেটিই হয়তো পরে তাদের টিংকার্স গড়তে উৎসাহ দিয়েছে। ওদের কার্যক্রম সত্যিই প্রশংসনীয়। আমি ওদের সাফল্য কামনা করি।’

মুনেম শাহরিয়ারের সঙ্গে কথা হচ্ছিল টিংকার্সের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে। তিনি বলেন, ‘টিংকার্স একটি শিক্ষাপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান। আমরা তাই শিক্ষা নিয়েই আমাদের কাজগুলো ছড়িয়ে দিতে চাই আরও বিস্তৃত পরিসরে। ধীরে ধীরে আমরা দেশের শিক্ষাক্ষেত্রের জন্যও বই, অ্যাপ, সফটওয়্যার, রোবোটিকস যন্ত্রপাতি, ইত্যাদি শিক্ষা উপকরণ নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছি। শিশুরা যেন ছোটবেলা থেকেই প্রযুক্তিগত জ্ঞান লাভ করতে পারে, আমরা সেদিকেও নজর দিচ্ছি।’