প্রথম বর্ষের বাধাগুলো

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর নতুন পরিবেশের সঙ্গে অনেকে মানিয়ে নিতে পারেন না। স্বপ্ন িনয়ের আয়োজনে মডেল হয়েছেন কণা, শুভ, সাকিব, জয়া ও মুমু । ছবি: উজ্জ্বল সাহা
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর নতুন পরিবেশের সঙ্গে অনেকে মানিয়ে নিতে পারেন না। স্বপ্ন িনয়ের আয়োজনে মডেল হয়েছেন কণা, শুভ, সাকিব, জয়া ও মুমু । ছবি: উজ্জ্বল সাহা
শুরু হচ্ছে নতুন একটি শিক্ষাবর্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে চোখে পড়ছে অনেক নতুন মুখ। তাঁদের কারও কারও মুখে শঙ্কার ছায়া—নতুন পরিবেশ, জীবনের নতুন এক মোড়; মানিয়ে নিতে পারব তো? প্রথম বর্ষে সচরাচর যেসব সমস্যার মুখোমুখি হন শিক্ষার্থীরা, এমন কিছু সমস্যা ও তার সমাধান নিয়ে এবারের  প্রতিবেদন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন এক ছাত্র। নতুন বন্ধুদের সঙ্গে ক্লাস করছেন, হলে থাকছেন। একদিন ক্লাস শেষে হলে ফিরে দেখলেন, ঘরের সব ওলট-পালট হয়ে গেছে। দরজায় তালা ছিল ঠিকই, অথচ জামাকাপড়, বই থেকে শুরু করে টেবিল, খাট—জায়গা বদল করে ফেলেছে সব!

ঠিক এই অভিজ্ঞতাই হয়েছিল গুগলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুন্দর পিচাইয়ের। তিনি ছিলেন ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (আইআইটি) খড়গপুরের ছাত্র। ২৩ বছর পর নিজের ক্যাম্পাসে এসেছিলেন সমাবর্তন বক্তা হয়ে। বলেছিলেন, ‘আমাদের সময় র​্যাগিং সেভাবে ছিল না। তবে “সেন্ট্রাল গ্র্যাভিটি চেঞ্জ” বলে একটা ব্যাপার ছিল। এখনো কি আছে?’ আইআইটিতে নতুন ছাত্রদের ভড়কে দিতে সিনিয়ররা বাইরে থেকে লাঠি ঢুকিয়ে ঘরের সব ওলট-পালট করে দিতেন। এর নাম দেওয়া হয়েছিল ‘সেন্ট্রাল গ্র্যাভিটি চেঞ্জ’।

অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের জন্য এ ধরনের বিড়ম্বনার ‘সংস্কৃতি’ থাকে। প্রশাসনের কড়া নজর সত্ত্বেও কোথাও কোথাও বিড়ম্বনা মাত্রা ছাড়ায়। অনেক স্বপ্ন নিয়ে একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে পা রাখেন। কিন্তু কখনো কখনো সিনিয়রদের অত্যাচার, পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারা কিংবা আরও নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে প্রথম বর্ষেই তিনি মুষড়ে পড়েন। প্রথম বর্ষে ছাত্রছাত্রীরা সাধারণত কী ধরনের সমস্যায় পড়েন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে আমরা সেটা জানতে চেষ্টা করেছি।

কয়েকটি প্রচলিত সমস্যা

একা তো কখনো থাকিনি

এ বছর মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়েছেন খুলনার ইশমাম সাকীব। ছেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়বেন, মা-বাবা খুব খুশি। একই সঙ্গে তাঁদের মনে ভর করেছে দুশ্চিন্তা। ছেলে কখনো মা-বাবাকে ছেড়ে একা থাকেননি। নতুন পরিবেশের সঙ্গে তিনি মানিয়ে নিতে পারবেন তো?

বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের শুরুতে যাঁদের ঠিকানা বদল হয়, বাক্সপেটরা কাঁধে নিয়ে যাঁরা ক্যাম্পাসের হলে এসে ওঠেন, তাঁদের অনেকেই মনঃকষ্টে ভোগেন। গণরুমের জীবন মানতে কষ্ট হয়। (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় ৭১ হলে যেমন ‘গেমস রুম’কে গণরুম বানানো হয়েছে , সেখানে একসঙ্গে থাকেন প্রায় ২৫০ শিক্ষার্থী)। গরমে অতিষ্ঠ হয়ে নির্ঘুম রাত কাটে। হলের ডাইনিংয়ের খাবার সামনে রেখে চোখে পানি আসে কারও কারও। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী বলছিলেন, ‘গণরুমে এত মানুষ! ঘুমাতে পারতাম না, পড়ালেখা করতে পারতাম না। ছুটিতে বাসায় গেলে আর ক্যাম্পাসে ফিরতে ইচ্ছা করত না। মনে হয়েছিল এখানে আমার আর পড়া হবে না।’

ক্লাসে কিছুই বুঝি না

স্কুল-কলেজের পড়ালেখা আর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখায় বিস্তর ফারাক। সন্ধ্যা হলে কেউ পড়তে বসতে বলবেন না। এখানে নিজের দায়িত্ব পুরোপুরি নিজের ওপর। শিক্ষকদের লেকচার শুনে ক্লাসে ঠিকঠাকমতো নোট নেওয়া, পরীক্ষার জন্য একটু একটু করে প্রস্তুত হওয়া, অনেকের কাছেই কঠিন মনে হয়।

একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রায়হানুল রাফি এসেছেন বরিশাল থেকে। বাংলা মাধ্যম স্কুল-কলেজে পড়েছেন। এসএসসি-এইচএসসিতে ইংরেজি বিষয়ে এ প্লাস পেয়েছেন। কিন্তু ইংরেজিতে ক্লাস লেকচার শোনার অভ্যস্ততা তাঁর ছিল না। রাফি বলেন, ‘টিচারদের লেকচারের সঙ্গে আমি তাল মেলাতে পারতাম না। মনে হতো সবাই স্যারের কথা বুঝতে পারছে, শুধু আমিই পারছি না। হয়তো কিছু একটা বুঝলাম না, প্রশ্ন করার সাহস হতো না। যদি প্রশ্ন করতে গিয়ে ভুল কিছু বলে ফেলি? প্রথম দুই সেমিস্টারে আমার রেজাল্টও তাই ভালো হয়নি।’

সিনিয়র ভয়ংকর

হলের রাজনীতি, ‘বড় ভাই’দের অত্যাচার, জোর করে মিটিং-মিছিলে ধরে নিয়ে যাওয়া—এসব অনেক ক্যাম্পাসেরই নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অনেক সময় দেখেও দেখে না। কখনো কখনো প্রতিকার চেয়ে হিতে বিপরীত হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের এই নতুন পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেন না নবাগত অনেকে। ছবি: স্বপ্ন নিয়ে

‘র​্যাগিং’ প্রতিরোধে প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়েই কড়া নিয়মকানুন রয়েছে। গত বছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে র​্যাগিং বন্ধে প্রশাসনকে কঠোর হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যান্টি র​্যাগিং সেল আছে। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে র​্যাগিং বন্ধের জন্য পোস্টারও চোখে পড়ে। কিন্তু নিয়মের ফাঁক গলে অনেক ক্যাম্পাসেই এটি ‘ঐতিহ্য’ বলে বিবেচিত। ‘আমাদের সঙ্গেও তো এমন হয়েছিল’—এই অজুহাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের একেকটি ব্যাচ ঐতিহ্য ধরে রাখাটা ‘দায়িত্ব’ বলে মনে করে। মজার ছলেই হয়তো নবাগত এক ছাত্রকে কিছু অপ্রীতিকর কোনো কথা বললেন সিনিয়রদের কেউ, তাতে নতুন আসা শিক্ষার্থীর মনে বড় প্রভাব পড়তে পারে। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার অনুরোধে বললেন, ‘যেদিন প্রথম ক্লাস করতে গিয়েছি, সেদিনই সিনিয়ররা মিলে সবার সামনে নাচতে বলেছিলেন। পরে আস্তে আস্তে তাঁদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক হয়ে গেছে। কিন্তু এই অস্বস্তি কাটাতে আমার অনেক সময় লেগেছে।’

পরিবেশের সঙ্গে মানাতে পারছি না

‘ছোটবেলা থেকে আমার হলে থাকার ইচ্ছা ছিল। বড় ভাইয়া-আপুদের কাছে কত গল্প শুনেছি! কিন্তু আমার নিজের হলজীবনের শুরুটা খুব খারাপ কেটেছে। হলে আমার রুমমেট মাদকাসক্ত ছিল। দলবল নিয়ে সে রুমে আসত। আমি পড়তেও পারতাম না, ঘুমাতেও পারতাম না। পরে ক্যাম্পাসের বাইরে একটা মেস নিয়ে থাকতে হয়েছে।’—একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের মন্তব্য। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জানানোর চেষ্টা করেননি? প্রশ্ন করেছিলাম তাঁকে। বললেন, ‘যেখানে আমাকে চার বছর পড়ালেখা করতে হবে, সেখানে শত্রু তৈরি করে কী লাভ?’

ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে কষ্ট হওয়ার পেছনে আছে আরও নানা কারণ। কারও কথায় আঞ্চলিকতার টান আছে বলে সহপাঠীদের টিপ্পনী শুনতে হয়, কেউ বন্ধুদের কাছ থেকে পান ‘খ্যাত’ উপাধি। সবার মনোজগৎ এক নয়, ছোট ছোট কথায় অনেক সময় মনে বড় দাগ কাটে। প্রথম বর্ষের এই সংবেদনশীল সময়টাতে ভেঙে পড়েন অনেক শিক্ষার্থী। এসব কারণে প্রথম বর্ষেই এক বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাওয়ার ঘটনাও প্রায়ই শোনা যায়।

সমাধান কী?

সমাধানের খোঁজে আমরা বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেছি। সবাই-ই বললেন, একজন নবাগত ছাত্রকে একটি সুন্দর পরিবেশ দেওয়ার দায়িত্ব মূলত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। তবে বিশ্ববিদ্যালয় তো কেবল পড়ালেখা শেখার জায়গা নয়, এখানে জীবনের পাঠও নিতে হয়। ছোট-বড় ধাক্কা খেয়েই ছাত্রছাত্রীরা বাধা অতিক্রম করতে শেখে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মাহমুদা আকন্দ বললেন, যেকোনো সমস্যায় সহায় হতে পারেন শিক্ষকেরা। তিনি বলেন, ‘অনেক সময় হয়তো আমি প্রশাসনিকভাবে কোনো প্রতিকার পাচ্ছি না। আমার যেই শিক্ষককে পছন্দ, যাঁকে আমি বিশ্বাস করতে পারি, তাঁর সঙ্গেই যেন মন খুলে কথা বলি। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে কাউন্সেলিংয়ের সুবিধা আছে, ছাত্র উপদেষ্টা আছেন। তাঁদের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে।’

বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের শুরুতে যাঁদের ক্লাসের সঙ্গে তাল মেলাতে কষ্ট হয়, তাঁদের প্রশ্ন করার মানসিকতা গড়ে তোলার পরামর্শ দিলেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক মো. মোফাচ্ছেল হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমরা যখন ক্লাস নিই, অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীই আলোচনায় অংশ নেয় না। স্কুল-কলেজ থেকে ক্লাসে চুপ করে থাকার অভ্যস্ততা নিয়ে ছেলেমেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে। সমস্যা হলে বলতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন থাকে। জড়তা কাটানোর জন্য, ক্যাম্পাসে একটা পরিবার গড়ে তোলার জন্য ছাত্রছাত্রীরা এই সংগঠনগুলোতে যোগ দিতে পারে।’

নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ফার্মেসি বিভাগের ছাত্র অর্ণব পালের কথা অনুপ্রেরণাদায়ক হতে পারে। অর্ণব কক্সবাজারের ছেলে। প্রমিত বাংলায় কথা বলেন। শুরুতে শহরের পরিবেশে মানাতে পারেননি। বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে সময় লেগেছে। এখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সংগঠনের ভাইস প্রেসিডেন্ট। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অনুষ্ঠানে মঞ্চে দাঁড়িয়ে অর্ণব যখন লোকগান করেন, তাঁর গানের সঙ্গে মেতে ওঠে পুরো ক্যাম্পাস। অর্ণব বলছিলেন, ‘যারা একসময় আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করেছে, আমি তাদের সঙ্গেই মিশতে চেষ্টা করেছি। বুঝতে চেষ্টা করেছি ওরা কেমন, ওরা কী চায়। আমার ভালো দিকগুলো রেখে আমি ওদের ভালো দিকগুলো নিতে চেষ্টা করেছি। পরে ওরাই আমাকে আমার সমস্যাগুলো ধরতে সাহায্য করেছে।’