প্রথম প্রতিরোধে তিনি বাজালেন পাগলা ঘণ্টা

১৯৭১ সালে আব্দুল আলী ছিলেন পুলিশের কনস্টেবল। ২৫ মার্চ রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে অবস্থান করছিলেন। পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ আঁচ করতে পেরে বাজিয়েছিলেন পাগলা ঘণ্টা। এই ঘণ্টার শব্দ শুনেই সালামি গার্ডে জড়ো হয়েছিলেন পুলিশ সদস্যরা। তারপর অস্ত্রাগারের তালা ভেঙে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন তাঁরা। এটিই ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধের ঘটনা। ২০১৭ সালে প্রকাশিত লেখাটি ঈষৎ সংক্ষেপিত আকারে পুনঃপ্রকাশ করা হলো।

৭১ বছর বয়স আব্দুল আলীর। একহারা গড়ন। পাঞ্জাবির ওপর পরেছেন কালো কোট। বুক পকেটে তিনটা কলম। আগের দিন ঢাকায় এসেছেন, দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তি তাঁর চোখে-মুখে স্পষ্ট।

এক রাতে দিনের সূর্যের মতোই তিনি তেজদীপ্ত হয়ে উঠেছিলেন। মৃত্যুভয় অগ্রাহ্য করে বাজিয়েছিলেন পাগলা ঘণ্টা। তখন তিনি ২১ বছরের টগবগে তরুণ। রাতটি ছিল ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। কালরাত। অসহায় বাঙালির ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের রাত।

কী ঘটেছিল সেদিন? মনের প্রশ্ন মনেই থাকে। ততক্ষণে আব্দুল আলী নিজে থেকেই বলতে শুরু করেছেন, ‘আমি ছিলাম তৎকালীন আইজিপি (পূর্ব পাকিস্তান পুলিশের মহাপরিদর্শক) তসলিমউদ্দিন সাহেবের বডিগার্ড। সেদিন বেলা ২টা পর্যন্ত ডিউটি ছিল। তারপর রুমে ফিরছি। দুপুরের খানা খাইছি, বিশ্রাম নিছি। বিকেল ৫টার দিকে গেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়।’

স্মৃতিতে থাকা সেদিনের সেই দিনলিপি আমাদের সামনে মেলে ধরেন আব্দুল আলী। মিছিলে উত্তাল রমনা, শাহবাগ, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কাটিয়েছেন অনেকটা সময়। রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে ফিরেছেন রাত সাড়ে নয়টা নাগাদ। থাকতেন ৬ নম্বর ব্যারাকের তৃতীয় তলায়। এই ভবনেরই নিচতলা তখন ঢাকা জেলা পুলিশের অস্ত্রাগার। সামনে ফাঁকা জায়গা। একপাশে পুকুর। তার পাশ দিয়েই ১ নম্বর গেট থেকে আসা রাস্তাটা ওয়ার্কশপ হয়ে চলে গেছে পুলিশ লাইনসের ২ নম্বর গেটের দিকে।

পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত ঐতিহাসিক পাগলা ঘণ্টার সামনে দাঁড়িয়ে আব্দুল আলী, ২০১৭

বাইরে থেকে ফেরার পর আব্দুল আলীর ভেতরে কেমন যেন অস্থিরতা ভর করে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন পুলিশ সদস্য হিসেবে ব্যাপারটা তিনি মানতে পারেন না। ‘বাইরে অবস্থা খুবই সন্দেহজনক মনে হয়েছে। শঙ্কা নিয়ে ফিরি রুমে। কিছু একটা ঘটবে, বারবার এমনই মনে হচ্ছিল।’ আব্দুল আলী বলে যান।

অস্থিরতা চেপে রেখে রাতে ক্যানটিনে খেতে যান। এমন সময় হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়। রাত তখন ১০টা ১০ মিনিট। কী হচ্ছে এসব? এই সময় বিদ্যুৎ যাবে কেন? কিছুই তিনি মেলাতে পারেন না। অন্য পুলিশ সদস্যরাও তাঁর মতো। টর্চলাইটের আলোয় রাতের খাবার খেয়ে নেন সবাই। আচ্ছা, পুলিশ লাইনসের বাইরের অবস্থা কী? দিনের আলোর মতো উজ্জ্বল আব্দুল আলীর সেই রাতের স্মৃতি।

সিঁড়ি ধরে তৃতীয় তলায় ওঠেন তা দেখতে। আশপাশে তেমন বড় কোনো ভবন নেই। তাই চারপাশটা দেখা যায়। কিন্তু কী দেখবেন? শুধু পুলিশ লাইনস নয়, শহরের কোথাও আলো নেই। অন্ধকারে ডুবে গেছে পুরো শহর।

আব্দুল আলী নিচে নেমে আসেন। ছুটে যান টেলিফোন অফিসে। কিন্তু টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন। চলে আসেন পুকুরপাড়ে। কিছু সময় সেখানে বসেই কাটান। তবে অস্থির ছিলেন ভেতরে ভেতরে। বিদ্যুৎ নেই, টেলিফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন। সন্দেহ নিয়ে একসময় যান ওয়ারল্যাস অফিসের দিকে। চারপাশে সুনসান। মানুষের আনাগোনা নেই। উদ্বিগ্ন আব্দুল আলী ওয়ার্কশপের কাছাকাছি একটি জায়গায় গিয়ে দাঁড়ান। তারপর?

এগিয়ে এল বাইক

হঠাৎ একটা মোটরবাইক ঢুকে পড়তে দেখেন ১ নম্বর গেট দিয়ে। বাইক কাছে এসে আলো ফেলল আব্দুল আলীর মুখে। তীব্র আলোয় কিছু ঠাহর করতে পারছিলেন না আব্দুল আলী। আরও কাছে এসে বাইক থামে। অন্ধকারের আলোয় বাইকে একজন মানুষ—এতটুকুই বোঝেন তিনি। আব্দুল আলী বলেন, ‘আশপাশে কাউকে না পেয়ে বাইকচালক আমাকে জানালেন রাজারবাগে পাকিস্তানি সেনারা আজ (২৫ মার্চ ১৯৭১) রাতে আক্রমণ করবে। বঙ্গবন্ধু সমস্ত পুলিশ সদস্যকে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করার নির্দেশ দিয়েছেন। আমাকে এই বার্তা পুলিশ সদস্যদের পৌঁছে দিতে বললেন। কথা শেষ করে চলে যেতে থাকেন আরোহী। পরিচয় কী—জানতে চাইলে তিনি আমাকে বলেন তাঁর নাম শেখ কামাল।’

মুসিবতে পড়েন আব্দুল আলী। একজন সাধারণ কনস্টেবল তিনি। এই বার্তা তিনি কীভাবে সবাইকে জানাবেন ভেবে পান না। আব্দুল আলী বলেন, ‘উত্তেজনায় আমার শরীর কেঁপে ওঠে। ‘ম্যাগাজিন গার্ড, ম্যাগাজিন গার্ড...’ বলে চিৎকার করে করে দৌড়ে যাই ৬ নম্বর ব্যারাকের দিকে।’ একজন সেন্ট্রিকে সামনে পান। তাঁর কাছে জানতে চান হাবিলদার গার্ড কোথায়। তিনি বলেন, জানেন না। তারপর ‘হাবিলদার গার্ড, হাবিলদার গার্ড...’ বলতে বলতে ভবনের একতলা, দোতলা, তিনতলায় উঠে যান। অনেকেই তাঁর সামনে পড়েন, কিন্তু কোনো কর্মকর্তা সাড়া দেন না। এখন কাকে কী বলবেন আব্দুল আলী?

পাগলা ঘণ্টা

বাজালেন পাগলা ঘণ্টা

নিচে নেমে আসেন আব্দুল আলী। অস্ত্রাগারের সামনে থামের পাশে ঝোলানো পাগলা ঘণ্টা। লোহার লম্বা একটা দণ্ড হলো পাগলা ঘণ্টা। আদতে রেললাইনের পাতের একটা অংশ। এই ঘণ্টা বাজালে পুলিশ সদস্যরা যে যেখানে যেভাবেই থাকেন না কেন, হাজির হন সালামি গার্ডের সামনে। আব্দুল আলী বলেন, ‘হে আল্লাহ তুমিই জানো। যা হবার হবেই। এই সাহসটুকু নিয়েই আমি পাগলা ঘণ্টা বাজানো শুরু করে দিই।’

পুলিশ সদস্যরা যে যেখানে ছিলেন, ছুটে আসেন সালামি গার্ডের সামনে। দুজন ‘সেন্ট্রি’ সেই রাতে দায়িত্বে ছিলেন। আব্দুল আলী তাঁদের একজনকে পাগলা ঘণ্টা বাজানোর দায়িত্ব দিয়ে চলে যান অস্ত্রাগারের চাবি আনতে। চাবি থাকে রিজার্ভ ইন্সপেক্টরের (আরআই) কাছে। ওই ভবনেই ছিল তাঁর অফিস। কিন্তু তালাবন্ধ। চলে যান তাঁর বাসায়। বাসার দরজায়ও তালা ঝোলানো।

ভাঙা হলো তালা

ততক্ষণে পাগলা ঘণ্টার শব্দে সবাই জড়ো হয়েছেন সালামি গার্ডের সমানে। আব্দুল আলী তখন পাগলপ্রায়। অস্ত্রাগারের তালা লাগানো। সেই চাবি তো তাঁর কাছে নেই। একজন ‘সেন্ট্রিকে’ তিনি নির্দেশ দেন তালায় গুলি করতে। গুলি করে ও শাবল দিয়ে ভাঙা হয় তালা। অস্ত্রাগারের ভেতরে ঢোকেন আব্দুল আলী। ‘শহীদবাগ, শহীদবাগ...’ ‘ফকিরাপুল, ফকিরাপুল...’ এভাবে এলাকা ধরে সারি সারি সাজানো থ্রি নট থ্রি রাইফেল-গুলি তুলে দেন পুলিশ সদস্যদের হাতে।

আব্দুল আলী বলতে থাকেন, ‘আমিও অস্ত্র, গোলাবারুদ নিয়ে বের হয়ে আসি। তখন দেখি দ্বিতীয় অস্ত্রাগারটাও খোলা হয়েছে।’ আব্দুল আলী বেরিয়ে অবস্থান নেন মোটর গ্যারেজের পাশে। গর্তমতো একটা জায়গায় রাতভর ছিলেন তিনি।

ক্রলিং করে হাসপাতালে

রাত ১২টার পরই শুরু হয় প্রতিরোধযুদ্ধ। মুহুর্মুহু গুলির শব্দে কান পাতা দায়। আব্দুল আলী বলে যান, ‘আমি অস্ত্র হাতে গুটিসুটি মেরে সেখানেই বসে থাকি। যুদ্ধ করতে পারিনি।’ ভোরের দিকে ক্রলিং করে চলে যান পুলিশ টেলিকম ভবনের পাশে, এখন যে পুকুর রয়েছে সেখানে। তারপর সুযোগ বুঝে চলে যান পুলিশ হাসপাতালে। হাতের অস্ত্র হাসপাতালের বিছানার তোশকের নিচে রাখেন।

হেঁটে হেঁটে মহেন্দ্রগঞ্জ

রাজারবাগ পুলিশ লাইনস হাসপাতালেই সেদিন কেটে গেল। বাইরে কারফিউ। বের হওয়ার উপায় নেই। একসময় সুযোগ বুঝে বেরিয়ে পড়লেন। চলে গেলেন কমলাপুরে। সেখান থেকে ট্রেনে নারায়ণগঞ্জ। এভাবেই পাঁচ দিন হেঁটে হেঁটে পৌঁছালেন ভারতের মেঘালয়ের মহেন্দ্রগঞ্জে। যুদ্ধের দিনগুলো তিনি এখানেই পার করেছেন। কামালপুর রণাঙ্গনে অংশ নিয়েছেন যুদ্ধে।

স্বাধীনতা পেলেন, কিন্তু…

১৯৭২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি। স্বাধীনতার পর যোগ দেন কর্মস্থলে। স্বাধীন দেশের মুক্তিযোদ্ধা পুলিশ সদস্য। দিন, বছর গড়িয়ে ১৯৭৭ সাল। রাজনীতির মোড় ঘুরে গেছে। মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আলীরা তখন কোণঠাসা। তিনি ধানমন্ডি থানায় কর্মরত। পরিবারসহ বাসা নিয়েছেন মিরপুরে। ওই বছরে তাঁর নামে মামলা হলো বিশেষ ট্রাইব্যুনালে। বিচার হলো, এক মাসের জেল হলো। হারালেন চাকরি। আব্দুল আলী সেই ঘোর অন্ধকার দিনের কথা বলতে বলতে আটকে গেলেন। বিড়বিড় করে বললেন, ‘আহা রে, কী দিন। এ জন্যই কি যুদ্ধ করছিলাম।’

এক মাস পর জেল থেকে ছাড়া পেয়ে সোজা গিয়েছিলেন গ্রামের বাড়ি। তারপর? সেই বেদনাবিধুর গল্প আব্দুল আলী বলতে চান না।

আনসারের প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে পুলিশে

আব্দুল আলীর জন্ম জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার চিকাজানিতে। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড়। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। পুলিশে কনস্টেবল পদে যোগ দেন ১৯৬৭ সালে। আব্দুল আলী বলেন, ‘ময়মনসিংহে আসছিলাম আনসার বাহিনীর প্রশিক্ষণ নিতে। সেখানেই ঘোষণা দেওয়া হয়, পুলিশে জনবল নেওয়া হবে। লাইনে দাঁড়াই যাই।’

নির্বাচিত হন আব্দুল আলী। রাজশাহীর সারদা পুলিশ একাডেমিতে ছয় মাস প্রশিক্ষণ নিয়ে কনস্টেবল হিসেবে যোগ দেন রাজারবাগ এসএএফ শাখায়। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি থেকে তৎকালীন আইজিপির দেহরক্ষীর দায়িত্বে ছিলেন।

১৯৭৭ সালে চাকরিচ্যুত হওয়ার পর তিনি গ্রামের বাড়িতেই থাকতেন। পুলিশ বাহিনীর প্রথম প্রতিরোধের যোদ্ধাদের খুঁজতে গিয়ে পাঁচ সন্তানের জনক আব্দুল আলীর খোঁজ মেলে ২০১০ সালে। এরপর দেওয়া হয় সম্মাননা।