প্রথম আলোর কাছের মানুষ

অঝোর বৃষ্টিও বাদ সাধতে পারেনি প্রিয় শিল্পীর গান শোনায়, প্রথম আলোর জিপিএ–৫ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে। ছবি: প্রথম আলো
অঝোর বৃষ্টিও বাদ সাধতে পারেনি প্রিয় শিল্পীর গান শোনায়, প্রথম আলোর জিপিএ–৫ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে। ছবি: প্রথম আলো

গানের ভুবনের মানুষ বলে পরিচয়টা আগে থেকেই ছিল। শুধু পরিচয়! অনেকটা গর্ব করেই বলতে হয়, আমার লেখা প্রথম গানে কণ্ঠও দিয়েছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। সেই যে পরিচয়; তা-ই দিনে দিনে গাঢ় হয়েছিল।

সেই যোগাযোগ আরও নিয়মিত হয়েছিল প্রথম আলোতে পেশাগত কাজের খাতিরে। কখনো খবরের প্রয়োজনে, কখনো প্রতিষ্ঠানের আয়োজনে-উদ্যোগে তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়ে।

প্রথম আলোর যে শিরোনাম সংগীত। অনেকে শুনে থাকতে পারেন কথাগুলো, ‘প্রতিটি মানুষ আলোকিত হোক/খুলে যাক সকলের বন্ধ চোখ/আলোর পথযাত্রী/প্রথম আলো, প্রথম আলো।’ আমাদের আনুষ্ঠানিক ফোন নম্বরের ওয়েলকাম টিউনও এটি। প্রথম আলোর অনেক কর্মী নিজেদের ফোনেও এই ওয়েলকাম টিউনটি ব্যবহার করেন। এ গানটি সুর করেছেন আইয়ুব বাচ্চু। গেয়েছেন দিনাত জাহান। শেষের ট্যাগ লাইনে নিজেই কণ্ঠ দিয়েছেন।

আমরা যখনই যে কাজ নিয়ে তাঁর কাছে গিয়েছি, তিনি সানন্দে রাজি হয়েছেন। আগ্রহ নিয়ে তা করে দিয়েছেন। প্রথম আলোর শিরোনাম সংগীতের আগেই এ পত্রিকার সঙ্গে তাঁর যুক্ততা তৈরি হয়েছিল। ১৯৯৮ সালের কথা। মেরিল-প্রথম আলো তারকা পুরস্কার যাত্রা শুরু করেছে। পরের বছরই অনুষ্ঠানের শিরোনাম সংগীতের বিষয়টি মাথায় আসে। লেখাও হলো। সুর দেওয়ার তালিকায় প্রথম থাকলেন আইয়ুব বাচ্চু। কণ্ঠও দিলেন তিনি। এখনো তাঁর গাওয়া সেই শিরোনাম সংগীতই ওই অনুষ্ঠানে বাজানো হয়।

বিনোদন জগতের বড় এ আয়োজনের শিরোনাম সংগীতই শুধু নয়। আয়োজনেও তো তাঁর সরব উপস্থিতি সব সময়। চিত্রনায়ক মান্না যখন মারা গেলেন; সে বছর মেরিল-প্রথম আলো আয়োজনে একটি বিশেষ অংশ রাখা হয়েছিল তাঁকে স্মরণে। সেখানে অংশ নিলেন আইয়ুব বাচ্চু। ‘আম্মাজান, আম্মাজান...’ গানটি তিনি মঞ্চে গেয়েছিলেন। তাঁর কথা এলে এমন আরও কত শত কথা মনে পড়ে। কোনটি ছেড়ে কোনটা বলি।

প্রথম আলোর শুরু থেকেই সামাজিক নানা উদ্যোগ সচেতনতা কার্যক্রমসহ জনমত গঠনের কাজ করছি আমরা। সে ধারাবাহিকতায় অ্যাসিডসন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রথম আলো জোরালো ভূমিকা নেওয়া শুরু করে ২০০০ সালে। সারা দেশের সব বড় শহরে পদযাত্রা করা হয় অ্যাসিডসন্ত্রাস বন্ধে। সে সময় অ্যাসিডসন্ত্রাসবিরোধী আয়োজনের শিরোনাম সংগীতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন তিনি। সে গান নিয়েই আমরা পথযাত্রা করেছি।

আসলে কোনো আয়োজনে তিনি কখনো মানা করেননি। আমরা যখনই তাঁকে আমন্ত্রণ জানাতে গিয়েছি, হাসিমুখে তা গ্রহণ করেছেন। সময় করে উপস্থিত হয়েছেন। দিনে দিনে প্রথম আলোর কাছের একজন মানুষ হয়ে উঠেছিলেন।

মাদকবিরোধী কানসার্টে গান গাইছেন আইয়ুব বাচ্চু

অ্যাসিডসন্ত্রাসের পরই আমরা মাদকবিরোধী প্রচারণা শুরু করি। মাদকের ভয়াল গ্রাস থেকে তরুণদের সচেতন করতে আয়োজন করা হয় কনসার্টের। এই মাদকবিরোধী আন্দোলনের শিরোনাম সংগীতও তাঁরই গাওয়া।

একবার আমন্ত্রণ জানাতে গিয়েছিলাম জিপিএ-৫ সংবর্ধনায় অংশ নেওয়ার জন্য। বললাম, মাধ্যমিক পরীক্ষায় যারা ভালো ফলাফল করেছে, তাদের জন্যই এ সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। শুনেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘কবে?’ এরপর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রামে যখনই আয়োজনটি হয়েছে, তিনি ছুটে গিয়েছেন। অবাক করা বিষয়টি হলো, প্রথম দিকে জিপিএ-৫ সংবর্ধনায় যাবেন বলে এলআরবির পূর্বনির্ধারিত একটি কনসার্ট স্থগিত করে দিয়েছিলেন। এ কথাটি পরে জেনেছি।

কিছুদিন আগের কথা। নতুন এক উদ্যোগ নিয়ে কথা হচ্ছিল আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গে। সেটা ছিল গিটার ফেস্ট আয়োজন নিয়ে। সারা দেশে তরুণদের অংশগ্রহণে গিটার উৎসব হবে। প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সেরা গিটার বাজিয়ে খুঁজে বের করা হবে। পুরস্কার হিসেবে নিজের পছন্দের চারটি গিটার তিনি দিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। অনেকটা ব্যর্থতা নিয়েই কথাগুলো বলতে হচ্ছে। কারণ, তাঁর সে স্বপ্নের আয়োজন আলোর মুখ দেখেনি। নানা কারণে থমকে গিয়েছিল। কে জানত, সেই থমকে যাওয়াটা চিরদিনের জন্য থমকে যাবে।

বিষাদভরা মনে অন্য একটি বিষয় আজ বলতে ইচ্ছে করছে। সংগীতের মানুষ হিসেবে তাঁকে দেখেছি, এ অঙ্গনের মানুষের জন্য কতটা অন্তপ্রাণ ছিলেন। অনেকে হয়তো সে কথা জানেনও না। অনেকটা নিভৃতে কাজ করেছেন। এই যেমন শিল্পী লাকী আখান্দ্ তখন ভীষণ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। অনেকে গেছেন তাঁকে দেখতে। পাশেও দাঁড়িয়েছেন অনেকে। তিনিও গিয়েছিলেন দেখতে। লাকী আখােন্দ্‌র চিকিৎসার জন্য দিলেন মোটা অঙ্কের টাকা। বললেন, এই সহায়তার কথা যেন কাউকে না বলি। আমি কখনো কাউকে কথাটি বলিনি। এমনই ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু।

সংগীতের সব অঙ্গনেই ছিল তাঁর পদচারণা। তিনি একাধারে গীতিকার, সুরকার, শিল্পী ও গিটারিস্ট। সব ক্ষেত্রেই তিনি হয়েছিলেন সফল।

তাঁর সুর করা ও গাওয়া বিখ্যাত গানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘চলো বদলে যাই’, ‘হাসতে দেখো গাইতে দেখো’, ‘আসলে কেউ সুখী নয়’, ‘আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ‘ফেরারি এ মনটা আমার’, ‘এই রুপালি গিটার’, ‘তারাভরা রাতে’ ও ‘এখন অনেক রাত’। রক ও পাশ্চাত্যের সংমিশ্রণে গান কিংবা মেলোডিয়াস সব ধরনের গানের মাধ্যমে তিনি তাঁর সুরে বৈচিত্র্য এনেছেন।

সংগীত পরিচালক হিসেবেও তিনি সফল। তপন চৌধুরীর গাওয়া ‘আমার গল্প শুনে কারও চোখে’, ‘আলো ভেবে যারে আমি’ এবং ‘পাথর কালো রাত’ গানগুলো তার প্রমাণ।

আইয়ুব বাচ্চু যখন চলচ্চিত্রে প্লে-ব্যাক করেছেন, সেখানেও স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। লুটতরাজ ছবির ‘অনন্ত প্রেম তুমি দাও’, আম্মাজান চলচ্চিত্রে ‘আম্মাজান, আম্মাজান’, সাগরিকা ছবির ‘আকাশ ছুঁয়েছে মাটিকে’—এমন অনেক শ্রোতাপ্রিয় গানের কথা বলা যায়, যে গানগুলো এখনো মানুষের কণ্ঠে শোনা যায়।

শুধু গিটার বাজিয়েই দর্শকদের মাতিয়ে রাখার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল আইয়ুব বাচ্চুর। গিটারের সুরের মূর্ছনায় বশ করেছেন দেশের লাখো তরুণের মন। এ তরুণেরাই তো তাঁর গানের প্রধান ভক্ত। এ তরুণদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করার দারুণ নজির দেখাতেন কনসার্ট শেষে। প্রতিটি কনসার্ট শেষ করতেন গিটারের তারে টুংটাং সুর তুলে। সে সুরে প্রাণ পেত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’।

লেখক: গীতিকবি