বছর বিশেক আগের কথা। গ্রামের এক বাড়িতে প্রতিমা সাজানোর কাজ করছিলেন কারিগরেরা। তাঁদের কেউ যত্ন নিয়ে প্রতিমায় মাটির প্রলেপ দিচ্ছিলেন, কেউবা হরেক রঙের প্রলেপে রাঙিয়ে তুলছিলেন দেবী দুর্গাকে। খেলার মাঠে যাওয়ার পথে দেখা এই দৃশ্য এক কিশোরকে আবিষ্ট করে রাখে। সে মনপ্রাণে কখন যে কারিগরদের প্রতিমা তৈরি ও রংতুলির কাজে বুঁদ হয়ে যায়, খেয়ালই করেনি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে বাড়ি পাঠিয়ে দেন কারিগরেরা।
সরজিৎ অধিকারী নিজের প্রতিমাশিল্পী হওয়ার প্রথম মুগ্ধতার কথা বললেন এভাবেই। তারপর কেটে যায় দিন-মাস-বছর। নিজের ভেতরেও কারিগর হওয়ার ইচ্ছেটা বড় হতে থাকে। ১৫ বছর যখন তাঁর, তখনই প্রতিমা তৈরির কাজ শিখতে হাজির হন এক মৃৎশিল্পীর কাছে। সরজিতের বয়স এখন ৩৫। দিনে দিনে হাত পাকিয়েছেন প্রতিমাশিল্পী হিসেবে। মাগুরা সদরের বাটিকাডাঙ্গা গ্রাম থেকে তিনি এখন কাজ করছেন দেশের বিভিন্ন জেলায়। যেমন ১ অক্টোবর তাঁকে পাওয়া গেল মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকা বাসুদেবপুর সর্বজনীন দুর্গামন্দির প্রাঙ্গণে। মন্দিরের প্রতিমায় রঙের চূড়ান্ত প্রলেপ দেওয়ার ফাঁকে কথা বলে যাচ্ছিলেন।
‘আমাদের গ্রামের মৃৎশিল্পী অসিত বৈদ্য। নিজের বাড়িতেই প্রতিমা তৈরির কারখানা ছিল তাঁর। ওস্তাদের কাজ দেখেই প্রতিমা তৈরির আগ্রহটা জন্মে।’ বলেন সরজিৎ। সেই আগ্রহ থেকেই কারখানায় গিয়ে বসে থাকতেন। কী দিয়ে, কীভাবে প্রতিমা তৈরি করা হয়—সেসব দেখতেন। এখানেই তাঁর প্রতিমা তৈরির কাজের হাতেখড়ি হয়। বছর পাঁচেক শেখার পর তাঁর ওস্তাদ দেশ ছাড়লেন। তখন তাঁর ওস্তাদ অসিত বৈদ্যের রেখে যাওয়া কারখানা কিনে নেন সরজিৎ।
সময় গড়াতে থাকল। মৃৎশিল্পী হিসেবে সরজিতের সুনাম ছড়িয়ে পড়ল পুরো মাগুরায়। সুশোভিত কারুকার্য ও নিখুঁত রংতুলিতে প্রতিমা ফুটিয়ে তোলায় তাঁর জুড়ি নেই। তাঁর এই শৈল্পিক কারুকার্য দিনে দিনে দেশের বিভিন্ন প্রান্তেও ছড়িয়ে দিয়েছেন। সাত-আট বছর ধরে নিজ জেলা ছাড়াও মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ ও পাবনার বিভিন্ন এলাকায় মন্দিরে প্রতিমা তৈরি করে আসছেন।
সরজিতের শৈল্পিক গুণের আরেকটি বিষয় হলো পুঁতি দিয়েও মা দেবীর প্রতিমা তৈরি। এটা কেমন? তিনি বলছিলেন, ‘প্রথমে বাঁশ, মাটি ও খড় দিয়ে প্রতিমার কাঠামো তৈরি করা হয়। এরপর পুঁতি দিয়ে প্রতিমা তৈরি করা হয়। ঢাকার চকবাজার থেকে সোনালি ও সাদা রঙের এসব পুঁতি কিনে আনতে হয়।’
ঝিটকা বাসুদেবপুর সর্বজনীন দুর্গামন্দির পরিচালনা কমিটির উপদেষ্টাও সরজিতের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তিনি বললেন, ‘তাঁর প্রতিমা তৈরির কারুকাজ আর রংতুলির হাত অতুলনীয়। এ কারণে কয়েক বছর ধরে সেই মাগুরা থেকে সরজিৎকে নিয়ে এসে প্রতিমা তৈরি করা হচ্ছে।’
দুর্গাপূজা ছাড়াও সরস্বতীপূজা ও কালীপূজাতেও প্রতিমা তৈরিতে ব্যস্ত থাকতে হয় সরজিৎকে। জানালেন, দুর্গাপূজার তিন মাস আগে থেকে প্রচণ্ড ব্যস্ততা বেড়ে যায়। এরই মধ্যে মাগুরায় দুটি, টাঙ্গাইলে একটি, সিরাজগঞ্জে একটি এবং মানিকগঞ্জে একটি দুর্গামন্দিরে প্রতিমা তৈরি করেছেন। একেকটি মন্দিরে দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ ও অসুর মূর্তি থাকে। আকারভেদে প্রতিটি মন্দিরে প্রতিমা তৈরিতে ১ লাখ থেকে দেড় লাখ টাকা করে পেয়ে থাকেন।
প্রতিমা গড়ার অনুভূতিটাও কম পাওয়া নয় তাঁর কাছে। সে কথাই বলছিলেন, ‘মায়ের কাজ করতে ভালোই লাগে। প্রতিমা তৈরি সাধনার বিষয়। মায়ের রূপ অন্তরে নিয়ে
কাজ করতে হয়। তাহলেই প্রতিমা সুন্দর হবে।’