প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে ভাবি, আমি কিছুই জানি না

সুবীর চৌধুরী পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থাপনা পরামর্শকদের একজন। তাঁকে বলা হয় ‘কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট গুরু’। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর নামে ফেলোশিপ আছে, তাঁর নামে ফেলোশিপ আছে যুক্তরাজ্যের লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসেও। ২০ সেপ্টেম্বর মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক নিবেদিত প্রথম আলো অনলাইনের টপ টক অনুষ্ঠানে কথা বলেছেন তিনি। প্রথম আলোর ইউটিউব ও ফেসবুকে প্রচারিত অনুষ্ঠানটির সঞ্চালক ছিলেন মুনির হাসান। অনুষ্ঠানে সুবীর চৌধুরীর কথা সংক্ষিপ্ত আকারে এখানে তুলে ধরা হলো।

সুবীর চৌধুরী

বিখ্যাত লোকের কাছে চিঠি

আমি যখন খুব ছোট, তখন দাদু একটা পরীক্ষা নিতেন। আমার সামনে একটা কলম আর একটা পয়সা দিয়ে বলতেন, কোনটা নেবে? আমি যখনই পয়সাটা নিতাম, তিনি আমাকে কলমের শক্তির কথা মনে করিয়ে দিতেন। বলতেন, ‘তুমি যদি একটা বই পড়ো, বই পড়ে ভালো লাগুক বা খারাপ লাগুক, তুমি কিন্তু বইয়ের লেখককে চিঠি লিখতে পারো।’ আমি বলতাম, ‘দাদু, আমি একটা বাচ্চা ছেলে, তাঁরা যদি উত্তর না দেন?’ দাদু বলতেন, ‘আবার লিখবে’

‘যদি এক শ বার চিঠি লেখার পরও উত্তর না দেয়?’

‘১০১ বার লিখবে!’

এভাবেই আমি চিঠি লেখা শুরু করলাম। অনেকে একবারে উত্তর দেয়নি। হয়তো ১০ বার বা ১৫ বারের পর উত্তর দিয়েছে। এভাবে ১২-১৩ বছর বয়সেই বহু নামকরা মানুষের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেল। এতে উপকার যা হয়েছে, আমাকে আর হার্ভার্ডে গিয়ে নেতৃত্বের কোর্স করতে হয়নি। ১৫ বছর বয়সেই লেখক, কবি, শিল্পীদের সঙ্গে মিশে অনেক কিছু শিখে গেলাম। বিকাশ ভট্টাচার্য নামের একজন খ্যাতিমান চিত্রশিল্পীর সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁরা সবাই একসঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকায় কাজ করতেন। আইআইটি (ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি) খড়গপুরে পড়ার সময় আমি বিকাশ ভট্টাচার্যের কাছে আবদার করলাম, ‘আপনি কীভাবে আঁকেন আমি দেখতে চাই।’ তিনি বললেন, ‘এটা তো সম্ভব না।’ তবু আমি লেগে থাকলাম। এভাবে প্রায় এক বছর লেগে থাকার পর তিনি শর্ত দিলেন, ‘ঠিক আছে। কিন্তু আমি যখন আঁকব, তুমি কোনো কথা বলতে পারবে না। চুপি চুপি আসবে, দেখে চলে যাবে।’ তিনি কতটা ‘প্যাশন’ নিয়ে আঁকেন, দুই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আমি দেখেছি। তখন কোয়ালিটি শব্দটা আমি শিখিনি, কিন্তু এ থেকে ‘কোয়ালিটি’ বিষয়টা আমি বুঝেছি।

শেখার মানসিকতা

মাননিয়ন্ত্রণ বা কোয়ালিটি কন্ট্রোল নিয়ে আমি যখন কাজ শুরু করি, তখন লক্ষ্য ছিল এ ক্ষেত্রে আমি বিশ্বের সেরা হব। সে জন্য আমি আমার মেন্টরদের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। একইভাবে যখন ব্যবস্থাপনা খাতে কাজ শুরু করলাম, তখনো মাথায় একই জিনিস ছিল। ম্যানেজমেন্ট টোয়েন্টি ওয়ান সি বইটি লেখার সময়ও আমি ব্যবস্থাপনা জগতের মহারথীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। বিশ্বের সেরা ২০টি বিজনেস স্কুলের সেরা চিন্তাবিদের সঙ্গে আমি তখন কাজ করেছি। অতএব বইটা যখন ছাপা হলো, আমাকে অনেকে বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যবস্থাপনাবিষয়ক চিন্তাবিদ (ম্যানেজমেন্ট থিংকার) বলতে শুরু করলেন। এরপর থেকে আমার ভাবনা ছিল, এ খাতে কীভাবে সেরাদের কাতারে থাকতে পারি। সেই চেষ্টায় অব্যাহতভাবে কাজ করে গেলাম, একটার পর একটা বই লিখলাম, প্রতিনিয়ত নিজেকে চ্যালেঞ্জ করলাম।

আমার কাছে মনে হয়, আমি কত কম জানি—সে ব্যাপারে সব সময় ধারণা থাকা উচিত। প্রতিদিন যদি ঘুম থেকে উঠে ভাবি, আমি কিছুই জানি না, তাহলে কিন্তু দিনটা খুব সুন্দর। আমি নিজে এ চর্চা করি। তাহলে জানার ক্ষুধাটা থাকে। আমার ইচ্ছা আছে, ঢাকায় গেলে যাঁরা জামদানি শাড়ি তৈরি করেন, তাঁদের সঙ্গে দেখা করব। তাঁরা কীভাবে কাজ করেন দেখব। পুরো বিশ্ব বলে, আমি একজন ‘কোয়ালিটি গুরু’। কিন্তু আমি মনে করি, আমি এখনো কোয়ালিটি সম্পর্কে শিখছি।

ভোক্তার তিন চাহিদা

যেকোনো পণ্য বা সেবার তিন ধরনের মান নিশ্চিত করতে হয়। ভোক্তা বা গ্রাহকের তিন ধরনের চাহিদা থাকে—মৌলিক চাহিদা, রোমাঞ্চিত হওয়ার চাহিদা (এক্সাইটমেন্ট নিড), আর কর্মক্ষমতাসংক্রান্ত চাহিদা। আমরা যা করি, শুরুতেই দুর্দান্ত একটা পণ্য বিক্রি বা সেবা দেওয়া শুরু করি। ধরা যাক একটা ঝাঁ চকচকে হাসপাতাল কিংবা বিশাল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে অত্যাধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা আছে, কিন্তু ভালো চিকিৎসক অথবা ভালো শিক্ষক নেই। অতএব আমরা সুন্দর একটা ভবন তৈরি করে রোমাঞ্চিত হওয়ার চাহিদা পূরণ করলাম, কিন্তু মৌলিক চাহিদাই পূরণ হলো না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমরা এ ভুলটাই করি। সুন্দর, চকচকে পণ্য তৈরি করি, কিন্তু সেটা মৌলিক চাহিদা পূরণ করে না, বা সেটার কর্মক্ষমতা (পারফরম্যান্স) ভালো হয় না। যদি এই তিনটি চাহিদা কেউ পূরণ করতে পারে, দাম বেশি হলেও মানুষ সেই পণ্য কিনবে।

মানের সংজ্ঞা এবং পণ্ডিত রবিশঙ্কর

সেতারবাদক পণ্ডিত রবিশঙ্করের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল তাঁর মৃত্যুর ছয় মাস আগে। তিনি বলেছিলেন, ‘তোমার কাছে মানের সংজ্ঞা কী?’ আমি বললাম, ‘আমার কাছে “মান”–এর সংজ্ঞা হলো রবিশঙ্কর’। তিনি জানতে চাইলেন, ‘কেন?’ বললাম, আমার যখন খুব মন খারাপ হয় কিংবা আমি খুব খারাপ অবস্থায় থাকি, তখন রবিশঙ্করের সুর শুনলে আমার মন ভালো হয়ে যায়। খুব খারাপ অবস্থা থেকে খুব ভালো অবস্থায় নিয়ে যাওয়া—এটাই হলো মান। এরপর আমি তাঁর কাছে তাঁর সংজ্ঞাটা জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, ‘আমি তো এখনো মানসম্পন্ন কিছু করতে পারিনি।’

৯৩ বছর বয়সে বিশ্বের মর্যাদাপূর্ণ সব পুরস্কার পাওয়ার পর তিনি বলছেন, তাঁর কাজ এখনো মানসম্পন্ন হয়নি! আমি বললাম, এটা কী বলছেন আপনি! তিনি বললেন, ‘আমি সুর তৈরি করি সংগীতের দেবতা, মা সরস্বতীকে সন্তুষ্ট করার জন্য। মিউজিক কম্পোজ করার সময় আমি ভাবি, একদিন হয়তো মা সরস্বতী এসে আমার কাঁধে হাত রেখে বলবেন, “রবি, তোমার কাজে আমি সন্তুষ্ট।” সেটা তো হয়নি। তাই আজও আমি প্রতিদিন ঘুম থেকে ভোর পাঁচটায় উঠে সংগীত সাধনা করে যাচ্ছি।’ একজন কলেজছাত্র থেকে শুরু করে সফল প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা—এমন মানসিকতা যদি থাকে, জীবনটা সুন্দর হবে।

যোগাযোগের দক্ষতা

একটা বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো যোগাযোগের দক্ষতা। কথা বলা, প্রাণ খুলে কথা বলা। আমার খুব সৌভাগ্য, আমি চট্টগ্রামে জন্মেছি। চট্টগ্রামের মানুষের একটা অন্য রকম বন্ধন আছে। বাংলাদেশের মানুষের একটা গুণ হলো, আমরা মানুষকে ভালোবাসতে জানি। যেটা পৃথিবীর অনেক দেশে নেই। আমাদের আতিথেয়তাও একটা বড় গুণ। এ সাক্ষাৎকারের খবর শুনে অনেক এক ই–মেইলে লিখছে, ‘সুবীর, ১৯৮৩ সালে ভারত ক্রিকেট বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর তুই বিরিয়ানি খাইয়েছিলি। তুই চট্টগ্রাম এলে আমি তোকে বিরিয়ানি খাওয়াব।’ প্রায় ৪০ বছর কোনো যোগাযোগ নেই, অথচ এখনো সে ই–মেইলে আমাকে এ কথা লিখছে। আমার বিশ্বাস, আমি যা কিছু পেয়েছি জীবনে, সবই যোগাযোগের দক্ষতা দিয়ে। যোগাযোগের নিয়মটাই হচ্ছে সংকোচহীনভাবে কথা বলা, সবার সঙ্গে গিয়ে কথা বলা। নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করার জন্য না, শেখার জন্য।

আমার ছেলের বয়স ১৩ বছর, ইনস্টাগ্রামে ওর অনুসারী আমার চেয়ে বেশি। আমি ওর কাছে কৌতূহল নিয়ে জানতে চাই, তোর কীভাবে এত অনুসারী হলো? তরুণদেরও এ শেখার আগ্রহ থাকতে হবে। আমরা প্রত্যেক মানুষ হলাম শূন্যের মতো। আর আমার আশপাশের মানুষ হলো অন্যান্য সংখ্যা। শূন্যের কোনো মূল্য নেই। যখনই আমি অন্য কারও পাশে দাঁড়াব, তখন আমার মূল্য তৈরি হবে। নিজেকে শূন্য ভেবে অন্যের পাশে দাঁড়াতে হবে, অন্যের কাছে শিখতে হবে।