জীবনের কোনো না কোনো সময়, কখনো না কখনো, সবাই–ই আমরা ভুল করি। কেউ কম আর কেউ বেশি। দুজন ব্যক্তির ভেতর যে সম্পর্ক, সেখানেও যেকোনো একজন ‘পা পিছলে’ একটা ভুল করতেই পারেন। অনেক সময় সেটা একেবারেই ‘নির্দোষ মিথ্যা’। আবার কখনো কখনো সেটা পরকীয়া বা যৌনতার মতো মারাত্মক ব্যাপার নিয়ে মিথ্যা। এমন সব পরিস্থিতিতে আমরা প্রায়ই অপর পক্ষকে ক্ষমা করে দিই। ভুলে গিয়ে সম্পর্কটাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাই। অনেক সময় আমরা ক্ষমা করে দিই ঠিকই, কিন্তু মন থেকে ভুলতে পারি না। নিজের ভেতরকার ক্ষত প্রায়ই ভয় হয়ে জেগে ওঠে। অনেক সময় এমনও হয়, অপর পক্ষকে ক্ষমাও করা যায় না, আবার ছেড়ে যাওয়াও মুশকিল। প্রতিমুহূর্তে অন্তর্দহন। এমন পরিস্থিতিতে আপনি কী করবেন? এই জরুরি বিষয় নিয়ে ভারতের ম্যাগাজিন ফিল্মফেয়ার–এ একটি বিশেষ প্রবন্ধ লিখেছেন মনোবিজ্ঞানী ও পরামর্শক শীতল শাপারিয়া। তাঁর বিশেষ দিকগুলো তুলে ধরা হলো।
মুখোমুখি হোন
আপনার যদি মনে হয় যে আপনি প্রতারিত হয়েছেন বা অপর পক্ষ আপনার কাছে কোনো একটা সত্য গোপন করেছে, যেটা আপনাদের সম্পর্কের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তাহলে দেরি করবেন না। সত্যটা জানার পর দুজনই সবচেয়ে সুবিধাজনক সময়ে মুখোমুখি বসুন। আপনিই শুরু করুন। জানতে চান। এ রকম সমস্যার ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময় দেখা যায়, আপনারা যতটা শান্ত আর আন্তরিকভাবে ও খোলামনে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করবেন, পরিস্থিতি ততটাই সহজ হয়ে যাবে। প্রিন্সটন নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় বলা হয়, একবার প্রতারণা করা সঙ্গী বা সঙ্গিনী আবারও হুবহু একই প্রতারণা করবেন—তা বলা যায় না। ভালোবাসাসংক্রান্ত বিষয়গুলো খুবই জটিল। তাই বুদ্ধিমানের কাজ হলো মনকে শক্ত রাখা, সব সময় মাথা খাটিয়ে ভাবা। এখানেই পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, ‘আপনি বিশ্বাস করুন। তবে “চেক” করতে ভুলবেন না।’
দ্বিতীয়বার সুযোগ দিন, তবে একবারই
প্রথমত, যত সহজে আপনি মানুষকে ক্ষমা করতে পারবেন, আপনার জীবন ততটাই সহজ হয়ে যাবে। তবে যা ঘটেছে, তা ভুলে যাবেন না। দ্বিতীয়ত, যাঁকে ক্ষমা করছেন, তিনি কি অনুতপ্ত? তিনি কি এই ভুল জীবনে একবারই করলেন? তিনি কি কথা দিয়েছেন যে এই ভুল বাকি জীবনে আর হবে না? ক্ষমা করার সময় এসব বিষয় বিবেচনায় রাখবেন। মারাত্মক ভুলের একটা সহজ সমাধান হলো, আপনি ক্ষমা করে দিয়ে নিজের পথ দেখুন। আর ওই ব্যক্তির সঙ্গে চিরতরে সম্পর্ক ছেদ করুন। যাতে বারবার আপনাকে একই তিক্ত অনুভূতির ভেতর দিয়ে যেতে না হয়। এক পক্ষ যদি বারবার একই ভুল করতে থাকে আর আপনি যদি বারবার তাঁকে ক্ষমা করে দেন, তাহলে একসময় জীবন এতটা জটিল হয়ে যাবে যে বাকি জীবন ধরে সেই জট ছাড়িয়ে কূল পাবেন না। তাই দ্বিতীয় সুযোগ দিন, তবে একবারই।
আরেকটা সুযোগ আপনি দিতেই পারেন। তবে কখন? যখন অপর পক্ষ সত্যিই গভীরভাবে অনুতপ্ত হবে। আপনি যখন নিশ্চিত হবেন, দ্বিতীয়বার সুযোগ দিলে আর এ রকম কিছু ঘটবে না, তখনই সুযোগ দিন। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের (ইউসিএল) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, মানুষের মস্তিষ্কের একটি অংশের নাম ‘অ্যামিগডালা’ যা মিথ্যা বলার সময় মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কিন্তু বারবার মিথ্যা বললে অ্যামিগডালার কারণে তৈরি হওয়া বিরূপ প্রতিক্রিয়া কমে যায়। এতে মানুষ নিজেকে কম অপরাধী ভাবতে থাকে। তখন তার ভেতর আর বিশেষ অপরাধবোধও কাজ করে না। প্রতারক সঙ্গী যদি এমন পরিস্থিতিতে পৌঁছে যায়, তবে নিজেকে ওই সন্দেহভরা বিষাক্ত সম্পর্ক থেকে সরিয়ে নিন।
ক্ষমা করে আপনার কী লাভ?
বিশ্বাস করুন, ক্ষমার ফলে দুই পক্ষের ভেতর আপনিই বেশি লাভবান হবেন। যতক্ষণ না অপর পক্ষকে ক্ষমা করতে পারছেন, ততক্ষণ আপনার মন আর মস্তিষ্ক আপনার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করতে থাকবে। আপনাকে দুদণ্ড শান্তি দেবে না। দ্বিতীয়ত, যতক্ষণ না ক্ষমা করছেন, ততক্ষণ সচেতন বা অবচেতন মনে আপনার সঙ্গে যা ঘটেছে, তার প্রতিশোধ নিতে সব অলিগলিতে ঢুঁ মারবেন। এটা মোটেও সুস্থ চর্চা নয়। একবার ৩২ বছর বয়সী এক নারী গিয়েছিলেন মনোবিজ্ঞানী শীতলের কাছে। গিয়ে জানান, বিয়ের ছয় বছর পর তিনি আবিষ্কার করেন, তাঁর স্বামী পরকীয়ায় লিপ্ত। এর ছয় মাসের ভেতর তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায়। কিন্তু তিনি কিছুতেই সামনে এগোতে পারছিলেন না। এ কারণে সেই নারীর চাকরিও চলে যায়। তখন শীতল ওই ব্যক্তিকে ক্ষমা করে দিতে অনুরোধ করেন। বলেন যে প্রতারকের ওপর রাগ, ক্ষোভ পুষে রাখার চেয়ে আমাদের জীবনে আরও অনেক কিছু করার আছে। আর জীবনের জন্য সেগুলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। রাগ, ক্ষোভ শরীর আর মনের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। একজন মিথ্যাবাদী, প্রতারকের জন্য নিজের শরীর, মন আর সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয়? আপনিই বলুন।
একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করে শেষ করি। আমার খুব কাছের এক বন্ধু, ধরে নেওয়া যাক তাঁর নাম ‘এক্স’। এক্সের মা, বাবা, পরিবারকে দেশের সবাই কমবেশি চেনেন। এ রকম একটি প্রসিদ্ধ পরিবারের সবার বিরুদ্ধে গিয়ে ভিন্ন ধর্মের এক ছেলেকে পালিয়ে বিয়ে করেন তিনি। এক্সের ভাড়া নেওয়া বাসায় সংসার শুরু করেন তাঁরা। বিয়ের পর ওই ছেলে এক্সের টাকায়ই চলতেন। সেই ছেলে কয়েক মাস পর সেই বাসায় অন্য মেয়ে এনে থেকেছেন। পাশের ঘরে দরজা লাগিয়ে কান চেপে ধরে চিৎকার করে কেঁদেছেন এক্স। তারপরও সম্পর্কটা ‘টিকিয়ে রাখা’র কোনো চেষ্টাই বাদ রাখেননি। দিনের পর দিন এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ায় একসময় এক্স বেঁচে থাকার তাগিদেই ওই বিষাক্ত সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসেন। রাজধানীর একটা কফিশপে এসব কথা জানিয়ে আমাকে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন, ‘বলো তো, পুরো প্রক্রিয়ার ভেতর আমার জন্য সবচেয়ে কঠিন কী ছিল?’ উত্তরের অপেক্ষা না করে নিজেই জানিয়েছেন, সমাজের ‘মুখোমুখি’ হওয়া।
মনের বন্ধু সংগঠনের সাইকোসোশ্যাল কাউন্সিলর নাদিয়া নাসরিনকে যখন ঘটনাটি জানালাম, তিনি বললেন, ‘সবার আগে নিজের সঙ্গে নিজের পরিষ্কার বোঝাপড়া হওয়াটা জরুরি। আপনার বন্ধু ঠিকই বলেছেন। একটা সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার পর পরিবার, সমাজ, বন্ধুবান্ধবের মুখোমুখি হওয়াটা আসলেই অনেক কঠিন। সে ক্ষেত্রে “প্রপার কমিউনিকেশন” হওয়াটা জরুরি। বিচ্ছেদ খুবই দুঃখজনক আর পরিশ্রমের একটি প্রক্রিয়া। সে সময় কাছের মানুষের সমর্থন খুবই জরুরি। আশপাশের মানুষকে বোঝাতে হবে নিজের অনুভূতির কথা, নিজের চাওয়ার কথা। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, নিজেকেই নিজের ভালো রাখার দায়িত্ব নিতে হবে।’