নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের দাউদপুর ইউনিয়নের জিন্দা গ্রাম। এখানে এলে সবাই জিন্দা পার্কেই আসেন। জিন্দা পার্কে ঢুকে গাছপালা আর কৃত্রিম লেক দেখে যেন মনটা শীতল হয়ে যায়। পার্কের ভেতরে গড়ে তোলা হয়েছে একটি স্কুল ও একটি গ্রন্থাগার। দোতলা স্কুলের নাম লিটল অ্যাঞ্জেল সেমিনারি। পাশেই তৈরি করা হয়েছে পাঁচতলা গ্রন্থাগার। এগুলোর স্থাপনাশৈলী মন কাড়ে। মজার বিষয় হচ্ছে, দুটি ভবনের কোথাও মাটির পোড়ানো ইট ব্যবহার করা হয়নি। পরিবেশবান্ধব বিভিন্ন ব্লক দিয়ে তৈরি হয়েছে এই ভবন দুটি।
ইটের কাজ করে এসব ব্লক। পরিবেশবান্ধব বলা হচ্ছে, কারণ এগুলো পোড়াতে হয় না। এসব ইট ও ব্লক তৈরি হয় মাটির তলদেশের মাটি, বালু আর সিমেন্ট দিয়ে। জিন্দা পার্ক তৈরি হয়েছে অগ্রপথিক সমিতির উদ্যোগে। সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল শাহিন বলছিলেন পরিবেশবান্ধব ভবন গড়ে তোলার পেছনের গল্প। একদিন এক প্রকৌশলী বন্ধু তাঁকে পরিবেশবান্ধব ভবনের কথা জানান। সঙ্গে এ–ও বলেন, এসব ভবন যেমন মজবুত, তেমনি পরিবেশের জন্যও সহায়ক হবে। আবার খরচও হবে কম। বছর বছর রং করার দরকারও নেই। ভবনের ভেতরের তাপমাত্রা থাকবে শীতল। এতসব সুবিধার কথা চিন্তা করে তাঁরাও পার্কের ভেতরে স্কুল তৈরির কথা ভাবলেন।
২০১২ সালে শুরু হয়ে গেল কাজ। পার্কের ভেতরে ৬০ শতাংশ জায়গাজুড়ে তৈরি হতে লাগল সেই স্কুল। দুই বছরে শেষ হয় স্কুলের কাজ। এখন সেই স্কুলে প্লে গ্রুপ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। শিক্ষার্থী দুই শতাধিক। আবদুল্লাহ আল শাহিন বলেন, ‘এত সুবিধা পাওয়া যাবে এ রকম ভবনে তা আগে বুঝিনি।’ এখানে যেসব ব্লক ব্যবহার করা হয়েছে তা কেনা হয়েছিল কনকর্ড, স্কাই ভিউ, সেভেন রিংস, রূপসী কংক্রিট ও মীর কংক্রিট থেকে। এই ভবনের পর পরিকল্পনা করা হয় লাইব্রেরির জন্য পাঁচতলা ভবন নির্মাণের। পার্কের দর্শনার্থীরা এসে নির্জনে বই পড়বেন। দুটি ভবনের স্থপতি সাইদুল হক বলেন, ‘পার্কের ভেতরে পরিবেশবান্ধব দুটি ভবন নির্মাণ করতে অনেক ভালো লেগেছে। এরপর ওই এলাকায় আরও তিনটি এবং ঢাকায় দুটি ভবনের নকশা করেছি।’
জিন্দা পার্কের ভেতরে পরিবেশ বান্ধব স্কুল ও লাইব্রেরি দেখতে গিয়েছিলেন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তা সায়মন রহমান। ফেসবুকে ছবি দিয়ে তিনি লিখেছেন, একটি পার্কের ভেতরে এমন ভবন দেখে মনটা ভালো হয়ে গেল। এ ধরনের আরও ভবন হোক এমনটাই প্রত্যাশা তাঁর।
যশোরেও এমন বাড়ি
যশোরের পালবাড়ি এলাকার আবুল কালাম আজাদ তাঁর বাড়িতে তৈরি করেছেন দুটি ভবন। দুটিতেই ব্যবহৃত হয়েছে পরিবেশবান্ধব ব্লক। তাঁর ছেলে মামুনুর রশিদ থাকেন সিঙ্গাপুরে।
আবুল কালাম বলেন, ‘একদিন আমার ছেলে পরিবেশবান্ধব বাড়ি নির্মাণ করার কথা বলে। আমিও সায় দিই। ছেলে ভারত থেকে আমদানি করে ব্লক বানানোর যন্ত্র। সেই যন্ত্র দিয়ে তৈরি হয় ব্লক। কুষ্টিয়ার বালু, পাথর আর সামান্য সিমেন্ট দিয়ে তৈরি এসব ব্লক রোদে শুকানো হয়, তারপর ভবন নির্মাণ করা হয়। এখন ব্লকের নাম দিয়েছি এইচএন কংক্রিট ব্লক। এই ব্লকের খবর ফেসবুক আর ইউটিউবের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। মানুষ প্রতিদিন ফোন দিচ্ছে। এরই মধ্যে বরিশালে কিছু ব্লক সরবরাহ করেছি।’
গাজীপুরে হচ্ছে বহুতল ভবন
গাজীপুরের টঙ্গীতে নয়তলা একটি বহুতল ভবন নির্মাণ করছে তৈরি পোশাক কারখানা ব্রাভো অ্যাপারেলস ম্যানুফ্যাকচার লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির প্রকৌশলী রুহুল আমিন বলেন, প্রায় ১৬৭ শতক জমির ওপর নির্মিত এই ভবনের ৯০ শতাংশ কাজ শেষ। এটি তৈরিতে ব্লক ব্যবহার করা হয়েছে। এই ভবন গড়ে তোলার মূল কারণ হচ্ছে পরিবেশবান্ধব ভবন তৈরি ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা। ব্লক ব্যবহারে প্রচলিত ইটের চেয়ে খরচ কম এবং ভবনকে শীতল রাখে এসব ব্লক।
সরকার যেসব কাজ করেছে
পরিবেশবান্ধব নির্মাণসামগ্রী নিয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ কাজ করছে সরকারি প্রতিষ্ঠান হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এইচবিআরআই)। রাজধানীর এই প্রতিষ্ঠানে চার বছর ধরে ব্যবহার করা হচ্ছে এসব সামগ্রী। এসব তৈরির ক্ষেত্রে প্রধান উপকরণ হচ্ছে নদীর তলদেশের খনন করা মাটি ও অল্প পরিমাণে সিমেন্ট। এইচবিআরআইয়ের সামগ্রীগুলোর মধ্যে রয়েছে মাটি ও সিমেন্টের সংমিশ্রণে তৈরি ইট, ভবনের মেঝে, ছাদ ও দেয়াল তৈরির উপকরণ, হলো স্ল্যাব, বালু-সিমেন্টের কংক্রিট হলো ব্লক, পলি ব্লক, ড্রেজড মাটির ব্লক, মাটি-সিমেন্টের স্ট্যাবিলাইজড ব্লক, ফেরোসিমেন্ট পানির ট্যাংক, একতলা ভবনের খুঁটি, চাল প্রভৃতি। এখানে একটি পাঁচতলা ভবনসহ বেশ কয়েকটি ভবন তৈরি করা হয়েছে; যেসব তৈরিতে কোনো পোড়ানো ইট ব্যবহার করা হয়নি।
নদীর তলদেশের মাটি আর সামান্য পরিমাণ বালু ও সিমেন্ট দিয়ে তৈরি রোদে শুকানো এসব ইট, ব্লক দিয়ে তৈরি হয়েছে এই ভবনগুলো। এইচবিআরআইয়ের পরিচালক প্রকৌশলী শামিম আখতার বলেন, ‘আমাদের তৈরি ভবনগুলো বৈজ্ঞানিকভাবেই টেকসই আর পরিবেশবান্ধব। দেশের সেরা স্থপতি আর পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে আমাদের সঙ্গে দীর্ঘ গবেষণা করেছেন। তারপর এই ভবন তৈরি করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, গত তিন বছর ধরে সচেতনতা তৈরিতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সুইচ-এশিয়া কর্মসূচির আওতায় আমাদের সঙ্গে কাজ করছে অক্সফ্যাম ও অন্যান্য আরো প্রতিষ্ঠান যাদের সহায়তায় এই পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির প্রসার ও ব্যবহারে সচেতনতা ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে কাজ করে যাচ্ছে এইচবিআরআই।’
বেসরকারি স্থাপনার পাশাপাশি সরকারি বিভিন্ন স্থাপনায় পরিবেশবান্ধব নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করা হচ্ছে। নোয়াখালীর ভাসানচরে স্থাপনা তৈরিতে পরিবেশবান্ধব নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করা হচ্ছে। এখানে প্রায় ১ হাজার ৪০০ ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া পটুয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও পিরোজপুরে সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে ভবন নির্মাণে পরিবেশবান্ধব সামগ্রী ব্যবহার করা হচ্ছে।
সরকারি ও বেসরকারিভাবে পরিবেশবান্ধব নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার অত্যন্ত ইতিবাচক বলে মনে করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জিয়াউল হক। তিনি বলেন, ইটের পরিবর্তে অনেকে বাড়িতে ব্লক ব্যবহার করছেন। এতে দূষণও হয় না আবার উর্বর মাটিও নষ্ট হয় না।
দেশে কনকর্ড, মীর সিরামিক, মিরপুর সিরামিক, খাদিম সিরামিকসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠান এ ধরনের পরিবেশবান্ধব নির্মাণসামগ্রী তৈরি করছে। উদ্দেশ্য একটাই, পোড়ামাটির ইটের ব্যবহার আর পরিবেশের দূষণ কমানো।