পুড়ছে আমাজন পুড়ছে আমার মন

আমাজনের বেশিরভাগ অংশই তো এমন গহীন অরণ্য, যেখানে পড়েনি মানুষের পা। ছবি: সংগৃহীত
আমাজনের বেশিরভাগ অংশই তো এমন গহীন অরণ্য, যেখানে পড়েনি মানুষের পা। ছবি: সংগৃহীত
>চিরহরিৎ বন আমাজন ঘুরে এসেছিলেন। জীববৈচিত্র্য, নদী-সাগর, বিশালাকার বৃক্ষরাজি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের আতিথেয়তা—সবই যেন টাটকা স্মৃতি। তাই তো দাবানলে এখন যখন পুড়ছে আমাজন, তখন মনও যেন কাঁদছে। নিজের সেই ভ্রমণ অভিজ্ঞতা আর এখনকার অনুভূতির কথা লিখেছেন মো. শাহিদ-উল-মুনীর।

‘দাউ দাউ পুড়ে যাচ্ছে ঐ নয়া বাজার

পুড়ছে দোকান পাট, কাঠ

লোহা লক্কড়ের স্তূপ...।’

নয়া বাজার নয়। এখন পুড়ছে যেন পৃথিবীর ফুসফুস। কবি শামসুর রাহমান বেঁচে থাকলে হয়তো বন নিয়ে বেশি চিন্তা করতেন। ফুসফুস আক্রান্ত হলে যেমন সারা শরীর দুর্বল হয়ে যায়, তেমনই বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ায় আমরা এই পৃথিবীর বাসিন্দারা ভুগছি প্রতিনিয়ত। পৃথিবীর মোট অক্সিজেনের ২০ শতাংশ উৎপাদিত হয় ‘পৃথিবীর ফুসফুস’খ্যাত আমাজনের চিরহরিৎ বন থেকে। তার থেকেও বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে নেয় এই বনভূমি। প্রায় ২০০ কোটি মেট্রিক টন কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে ৭০ লাখ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বিশাল এই বনাঞ্চল। 

সেই বন নিজেই এখন দাবানলে আক্রান্ত। মাইলের পর মাইল পুড়ে ছারখার হচ্ছে। বন পোড়ার ধোঁয়া আমাজনের আকাশ ছাড়িয়ে আড়াই হাজার মাইল দূরে দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে বড় শহর সাও পাওলোকেও অন্ধকারে ঢেকে দেয়। কত নির্মম একটি বন পুড়ে যাওয়ার দৃশ্য! 

আমাজন সম্পর্কে প্রথম জেনেছিলাম পাঠ্যবইতে। এত বড় বন! এখানে নাকি অনেক জায়গায় সূর্যের আলোও প্রবেশ করতে পারে না। তখন থেকেই আমাজন বনাঞ্চল দেখার সুপ্ত বাসনা ছিল মনে। ২০১৬ সালে আমাজন দেখার সৌভাগ্য হয়। সেবার তথ্যপ্রযুক্তির অলিম্পিকখ্যাত ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস অব আইটির (ডব্লিউসিআইটি) আসর বসেছিল ব্রাজিলে। বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির (বিসিএস) পরিচালক হিসেবে সেখানে যোগ দিয়ে ব্যবসায়ী বন্ধুদের নিয়ে রওনা দিই আমাজন ভ্রমণে।

ছোট নদী বেয়ে আমাজন বনের ভেতর। ছবি: সংগৃহীত

মুগ্ধ হওয়ার মতো জীববৈচিত্র্য

আমাজনের মূল বৈশিষ্ট্য হলো এর জীববৈচিত্র্য। আমাজন নদীই আমাজন বনের জীবনীশক্তি। ৯টি দেশের প্রায় ৭০ লাখ বর্গকিলোমিটার জায়গাজুড়ে বিস্তৃত এই বনাঞ্চল। আয়তনে বাংলাদেশের তুলনায় ৩৮ গুণ বড়। এ বনের ৬০ শতাংশ ব্রাজিল, ১৩ শতাংশ পেরু, ১০ শতাংশ কলম্বিয়া এবং বাকি ১৭ শতাংশ অন্যান্য ৬টি দেশে (বলিভিয়া, ইকুয়েডর, ভেনেজুয়েলা, গায়ানা, সুরিনাম ও ফরাসি গায়ানা) অবস্থিত। সমগ্র পৃথিবীতে যে পরিমাণ চিরহরিৎ বন বা রেইন ফরেস্ট আছে, তার অর্ধেকই হলো আমাজন। এই বনে ৪০ হাজার প্রজাতির প্রায় ৩ হাজার ৯০০ কোটি গাছ রয়েছে। 

আমাজন অরণ্যাঞ্চলে ৩০ লাখ প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদ রয়েছে। ১০ লাখ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস এই বনে। 

আমাজন বনের ব্রাজিল অংশে সম্প্রতি ছড়িয়ে পড়েছে দাবানল। ছবি: এএফপি

আমাজনের পথে 

বিস্ময়কর এই বন দেখতে ব্রাজিলের ব্রাসিলিয়া থেকে উড়াল দিই মানাউস শহরে। এই দুই শহরের দূরত্বও কম নয়, প্রায় পৌনে ৩ হাজার কিলোমিটার। রাতটা কাটাই মানাউসে। পরের দিন সকালে মাইক্রোবাসে আমরা সাগরের পাড়ে নৌবন্দরে পৌঁছাই। স্পিডবোটে ১ ঘণ্টা সাগর পাড়ি দিয়ে যাই রিও নেগ্রো নদীতে। নীল সাগরের বুকে আমাদের চোখে পড়ে সাগর আর নদীর মিলনস্থল। চোখজুড়ানো নীল পানির মায়ার জাল ঘিরে রেখেছে আকাশের সঙ্গে মিতালি করে। এ দৃশ্য ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। শুধু অনুভব করতে হয়।

নদী পেরিয়ে আবার মাইক্রোবাস। আমাজন নদীর পাড়ে কটেজে পৌঁছাই। পেছনে ঘন বন আর সামনে নদী। এই নদীতে কুমিরের দেখাও মেলে। বিকেলে আমরা বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে যাই। কিছু মাছ টোপও গিলেছিল। নদীর তাজা মাছ দিয়েই হয় রাতের আহার। 

সে সময়ে আমাজন অঞ্চলে নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া থাকায় অতি গরম বা অতি ঠান্ডা কোনোটার প্রভাব অনুভব করিনি। রাতের বেলা নদীর পাড় বেশ শান্ত। আড্ডা আর গান দিয়ে রাতের নিস্তব্ধতা বেশ জমে উঠেছিল।

আমাজনের গহিন ভেতর

এবার আমাজনের ভেতরে প্রবেশের পালা। সকালে ট্যুর গাইড ঘুম থেকে ডেকে তুললেন। গাইডকে দেখে টারজানের কথা মনে পড়ে যায়। আমরা সবাই ট্রাউজার, টি-শার্ট এবং গামবুট পরে বনে প্রবেশের জন্য প্রস্তুত হলাম। আর আমাদের গাইডে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্টেই স্বচ্ছন্দ। পথে যেতে যেতে ধীর পায়ে হাঁটা এক বন্য প্রাণীর সঙ্গে দেখা। গাইড কোলে তুলে নিলেন। যেন পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে দীর্ঘদিন পর সাক্ষাৎ। হাঁটছিলাম আর বিশাল সব গাছের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছিলাম। এমন একটি গাছ দেখলাম, যেটি প্রস্থে প্রায় ১০ ফুটের মতো। এই গাছের কাণ্ডে আঘাত করলে ঢোলের মতো শব্দ হয়। কথিত আছে, গ্রামের সবাইকে একত্র করার জন্য অথবা কোনো ঘোষণা দেওয়ার জন্য এই গাছে আঘাত করে প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করা হতো। বড় গাছের পাশাপাশি নানান রকম ঔষধি গাছের সমাহার। এখানকার ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জীবনযাপন দেখাতে গাইড আবার আমাদের নৌকায় চড়ালেন।

থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল আমাজনের স্থানীয় অধিবাসীদের একটি বাড়িতে

বিচিত্র জীবন

আমাজনের ১১.৮ শতাংশ জায়গা সেখানকার বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষেরা ব্যবহার করছে। এই বনে এমন জাতিসত্তার সংখ্যা তিন শর বেশি। তাদের বেশির ভাগ ব্রাজিলীয়। পর্তুগিজ, স্প্যানিশসহ অন্যান্য ভাষায় তারা ভাবের আদান-প্রদান করতে পারে। তবে প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা রয়েছে। কিছু যাযাবর জাতিও রয়েছে। আমাজনের বাইরে গোটা পৃথিবীর সঙ্গে তাদের তেমন যোগাযোগ নেই বললেই চলে। 

 ঘণ্টা দেড়েক নদীপথে আমরা একটা গ্রামে পৌঁছাই। যে বাড়িতে আমাদের যাওয়ার কথা, সে বাড়িটি নদীর ঘাট থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে। হেঁটে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। বনের ভেতরে গাছের নিবিড় ছায়ায় আমরা বন্ধুর পথ পাড়ি দিচ্ছিলাম। হরেক রকম পাখির ডাকে দেশের কোনো অজপাড়াগাঁয়ের কথাই মনে পড়ছিল তখন। তবে এত বিশাল আকৃতির গাছের দেখা মেলা এই বন ছাড়া অন্য কোথাও দুষ্করই।

দূর থেকে দেখা যাচ্ছে মাচার ওপর একটি বাড়ি। বাড়ির কর্তা বেশ আন্তরিক। মাথা নিচু করে করমর্দন করে আমাদের স্বাগত জানালেন। অতিথি এসেছে দেখে চলে গেলেন বন থেকে কোনো প্রাণী শিকার করে আনতে। বাড়ির অন্য সদস্যরাও মৃদুভাষী। ঘণ্টা পেরোতে না পেরোতেই বিরাট এক হাঁস নিয়ে হাজির হলেন তিনি। নিজেরাই জবাই করলাম। রান্না হলো, তবে আধা সেদ্ধ রান্না ভালো লাগছিল না। নিজেদের কাছে ছিল কিছু মসলা। তা দিয়ে বনভোজনের মতো হাঁস রান্না করে নিলাম আমরা। বেশ তৃপ্তি করেই খেলাম। আধুনিকতার ছোঁয়া এই গ্রামে না থাকলেও এর অধিবাসীরা বেশ অতিথিপরায়ণ। বাড়ির ভেতরে পেলাম বিশাল এক অজগর সাপের চামড়া। বাড়ির কর্তার নিজের শিকার করা সাপ। দেখেই বোঝা যায়, বিশাল বনের প্রাণীগুলোও নয় ছোটখাটো। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার আগেই ফিরে এলাম নদীর পাড়ের সেই ছিমছাম কটেজে।

বাঁচাতে হবে আমাজন

শুকনা মৌসুমে আমাজনের জঙ্গলে দাবানল একটা প্রচলিত ঘটনা। সেখানে শুকনা মৌসুম জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত। এই দাবানল তৈরি হতে পারে প্রাকৃতিক কারণে। যেমন বাজ পড়লে। আবার কৃষক এবং কাঠুরেরাও ফসল উৎপাদন বা পশু চরানোর জন্য জমি পরিষ্কার করতে জঙ্গলে আগুন দিয়ে থাকে।

বছর তিনেক আগের আমাজন ভ্রমণটি এখনো আমার কাছে টাটকা। আমাজনের সঙ্গে একটি আত্মিক সম্পর্ক অনুভব করি। আমাজন এভাবে পুড়ছে শুনে নিজের মধ্যে একটা হাহাকার করে। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা তো আরও ভয়ংকর। যুক্তরাষ্ট্রের এক বিজ্ঞানী আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে আমাজন অরণ্য আগামী ৫০ বছরের মধ্যে বিলীন হয়ে যেতে পারে। নিজের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে ভাবাটা বেশ কষ্টকর। যে আমাজনকে আমরা দেখে এসেছি, তা একসময় থাকবে না ভাবতেও ভয় হয়। এই বনাঞ্চল ধ্বংস হওয়া মানে বুকভরে শ্বাস নেওয়ার স্বাধীনতা হারানো। বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে এমনিতেই এখন রাতেও দিনের গরম অনুভূত হয়। যদি এই পরিস্থিতি চলতে থাকে, তাহলে প্রতিটি বাসায় শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র আর অক্সিজেনের সিলিন্ডার বসিয়েও শেষরক্ষা হবে না।

আমাজন যেন আমার কানে কানে বলছে, ‘আমাকে বাঁচাও এই বর্বর আগুন থেকে, আমাকে বাঁচাও/ আমাকে লুকিয়ে ফেলো চোখের পাতায়/ বুকের অতলে কিংবা একান্ত পাঁজরে/ আমাকে নিমেষে শুষে নাও/ চুম্বনে চুম্বনে।’

কবির মতো আমরাও অসহায়। তবে আশার বাণী হচ্ছে, এরই মধ্যে ব্রাজিল আগুন নেভানোর কাজ শুরু করেছে। বলিভিয়া যুদ্ধবিমান দিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে যাচ্ছে। মানুষ, প্রাণী, বৃক্ষরাজি, অক্সিজেন—সবকিছুর জন্যই তো পৃথিবীর বনগুলোকে বাঁচাতে হবে।

লেখক: তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তা এবং বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সভাপতি