ছেলে হয়েও ছোটবেলা থেকেই পুতুলের প্রতি বড় টান আসাদুজ্জামানের। ২০১৫ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই তাই পুতুলনাট্য গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্রে আসা-যাওয়া শুরু করেন। দেশে এটাই একমাত্র এ ধরনের প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এখানে কাজ করতে গিয়ে তাঁর মনের একটা খচখচানি কিছুতেই দূর হচ্ছিল না। গবেষণা কেন্দ্র নির্দিষ্ট মঞ্চে পুতুল নিয়ে কাজ করে। ফলে সব শিশুর দোরগোড়ায় পৌঁছানো সম্ভব হয় না। তাই তিনজন মিলে সহজে বহনযোগ্য সেট বানিয়ে দেশের নানান জায়গায় শিশু-কিশোরদের নাগালের মধ্যে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন তাঁরা।
আর এভাবেই ২০১৯ সালের ২৬ আগস্ট জন্ম নিল কাকতাড়ুয়া পাপেট থিয়েটার। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের ৪৪তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আসাদুজ্জামানের সঙ্গে এই থিয়েটারে কাজ করেন একই বিভাগের প্রণয় সরকার, শাহনাজ শানু, সোহানা তানজিম, তুনতুন মজুমদার, জুবায়ের কিশোর এবং পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের ফারহানা আফরিন।
দেশের আনাচকানাচ ঘুরে ঘুরে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে পাপেট নাটক দেখান তাঁরা। ইতিমধ্যে বগুড়ার পল্লি উন্নয়ন একাডেমি, নেত্রকোনার বিদ্যাভুবন, ময়মনসিংহের একমাত্রা স্কুল, হালুয়াঘাটের আদিবাসী নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়, বাংলাবান্ধা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, অবকাশ শিশু নিকেতন, মির্জাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ময়মনসিংহের ব্রাদার হাউস, ব্রিটিশ কাউন্সিল, চট্টগ্রামের নগরফুল শিরীষতলাসহ বিভিন্ন স্থানে শিশু–কিশোরদের পুতুলনাট্য দেখিয়েছে এই থিয়েটার। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পুতুলনাট্যের এই আয়োজন নিজেদের অর্থায়নেই করেছেন বলে জানান আসাদুজ্জামান।
‘শিশুদের পুতুল বানানো শেখাতে ও খেলার মাধ্যমে আনন্দ দিতে আমাদের ছুটে বেড়ানো। এই আনন্দ আমি বারবার পেতে চাই। আর তাই কখনো উত্তরের বাংলাবান্ধা, কখনো দক্ষিণের চট্টগ্রাম। কখনো বগুড়া আবার কখনো নেত্রকোনায় ছুটে যাই,’ বলছিলেন দলনেতা আসাদুজ্জামান। পুতুলনাট্যের মাধ্যমে শিশুদের আনন্দ দিয়ে নিজেরাও আনন্দ খোঁজেন থিয়েটারের সদস্যরা। পাশাপাশি শিশু–কিশোরদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করেন তাঁরা। বয়োসন্ধির নানা পরিবর্তন মোকাবিলা, কিশোরীদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন করা, প্রান্তিক জনগণের মধ্যে কুসংস্কার দূর করে সামাজিক সচেতনতা তৈরির জন্য শিক্ষামূলক নাটক প্রযোজনা করে কাকতাড়ুয়া।
পাশাপাশি করোনার সময় স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে জানানোর জন্য বিভিন্ন প্রচারণা, সড়কের শৃঙ্খলার নিয়মকানুন শেখানো, বন্য প্রাণী সংরক্ষণে মানুষকে সচেতন করার উদ্দেশ্যেও পুতুলনাট্য তৈরি করেছে তারা।
থিয়েটারের সদস্য প্রণয় সরকার জানান, কাকতাড়ুয়া পাপেট থিয়েটার দুই বন্ধু ও ভাল্লুক, নিরাপদ সড়ক, খুশির গল্প, স্বাধীনতার গল্প, গাছ বন্ধু, হাতি রক্ষাসহ বেশ কয়েকটি পুতুলনাট্য নিজেরাই প্রযোজনা করেছে।
শিশু-কিশোরদের হাতেকলমে পুতুল বানানো শিখিয়েছে কাকতাড়ুয়া। মূলত ফেলে দেওয়া জিনিসপত্র দিয়ে পুতুল বানায় তারা। থিয়েটারের সদস্য শাহানাজ শানু বলেন, ‘ককশিট, থার্মোকল, আঠা, সুই–সুতা, কাপড় ইত্যাদি দিয়ে আমরা পুতুল বানাই।’ তিনি যোগ করেন, ‘আমরা আনন্দময় শিক্ষার মাধ্যমে শিশুদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করতে চাই। আমরা চাই, শিশুরা বেড়ে উঠুক সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে, নিজেদের অধিকার, অন্যের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্যের ব্যাপারে সচেতন হয়ে। আমরা পুতুলের মাধ্যমে আমাদের সাধ্যমতো এই চেষ্টা চালিয়ে যেতে চাই।’
কাকতাড়ুয়ার আরেক সদস্য ফারহানা আফরিন বলেন, ‘গল্প বলার মাধ্যমে মানুষকে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে সচেতন করা বা শিক্ষিত করে তোলার পদ্ধতিটি বেশ প্রাচীন ও জনপ্রিয়। পুতুলনাট্য এমন একটি শিল্পমাধ্যম, যেখানে গল্প হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত এবং গল্পের অন্তর্নিহিত বোধ শিশু থেকে বৃদ্ধ—সবার মনে প্রভাব ফেলতে পারে।’
সদস্যদের চাঁদায়ই থিয়েটার পরিচালিত হচ্ছে। আসাদুজ্জামান বলেন, ‘পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আরও ভালোভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছতে পারব আমরা। দেশের প্রতিটি প্রান্তে কাজ করা আরও সহজ হবে।’