হানিয়াম মারিয়া

পাহাড়ে সাগরে সমানতালে

>কদিন আগেই কায়াক চালিয়ে পাড়ি দিয়েছেন বঙ্গোপসাগরের বাংলা চ্যানেল। পাহাড়েও অ্যাডভেঞ্চার করে বেড়ান সমানতালে। তিনি হানিয়াম মারিয়া। শুধু যে নিজে অ্যাডভেঞ্চার করেন তা নয়, অন্যদের উৎসাহ দেন, পরিবেশ-সচেতনতাও তৈরি করেন। তরুণ এই অভিযাত্রীকে নিয়েই প্রচ্ছদ প্রতিবেদন।
নেপালের তিলিচো হ্রদের পাড়ে হানিয়াম মারিয়া। ছবি: সংগৃহীত
নেপালের তিলিচো হ্রদের পাড়ে হানিয়াম মারিয়া। ছবি: সংগৃহীত

১৬ জানুয়ারি দুপুরের দিকে যখন মুঠোফোনে রাকার সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তখন ওপাশে শন্ শন্‌ আওয়াজ।

কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে বোঝা গেল ব্যাপারটা। ‘আমি সেন্ট মার্টিনে। স্কুবা ডাইভিংয়ে নামছি। সন্ধ্যায় কথা বলতে পারব।’
যে কারণে রাকা, মানে হানিয়াম মারিয়াকে ফোন দেওয়া হয়েছিল, তা এই স্কুবা ডাইভিংয়ের জন্য নয়। আগের দিন, ১৫ জানুয়ারি তিনি বঙ্গোপসাগরের ‘বাংলা চ্যানেল’ পাড়ি দিয়েছিলেন কায়াকে করে। কায়াক মানে বইঠাচালিত চিকনচাকন নৌকা। বাংলাদেশে কিছু পর্যটন কেন্দ্রে বছরখানেক হলো কায়াকের দেখা মিললেও, এমনিতে এই জলযান তেমন প্রচলিত নয়। কালেভদ্রে রোমাঞ্চপ্রিয়দের দেখা যায় কায়াকের বইঠা ঠেলতে। বাংলাদেশে নারীদের কায়াক চালাতে দেখা যায় না বললেই চলে। তাই কায়াক চালিয়ে রাকার বাংলা চ্যানেল পাড়ি দেওয়া খবরই বটে। ডবল কার্ট কায়াকে করে তিনি ও সায়মন হোসেন কাজটি করেন সফলতার সঙ্গেই। কায়াকে বাংলা চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার ব্যাপারেই রাকাকে ফোন করা।

ট্রেকিংয়ে নেপালের ল্যাংট্যাং উপত্যকায়

সাগরে যেমন, পাহাড়েও তেমন

শুধু জল নয়, পাহাড়ের প্রতি, বিশেষ করে নেপালের হিমালয় পর্বতমালার প্রতিও আকর্ষণ রাকার। তবে জলক্রীড়ার (ওয়াটার স্পোর্টস) প্রতি আগ্রহ বেশি। ১৬ জানুয়ারি সন্ধ্যায় আবার যখন রাকার সঙ্গে কথা হলো মুঠোফোনে, তখন এটাই বললেন বারবার। কায়াক চালান কবছর ধরে। নেপালের পাহাড়ি খরস্রোতা নদীতেই বেশি চালিয়েছেন। ভোতে কোশি নদীর কথাও বললেন। তবে বাংলা চ্যানেলের অভিজ্ঞতা তাঁর কাছে একেবারেই অন্য রকম।

 ২ ঘণ্টা ৫২ মিনিট

কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার শাহ্পরীর দ্বীপ থেকে সকাল ৮টা ৪৩ মিনিটে শুরু হয় রাকাদের কায়াকযাত্রা। রাকা বসেছিলেন সামনে। তাঁর পেছনে অনুজপ্রতিম বন্ধু সায়মন হোসেন। তাঁদের পাশে পাশে সার্ভিস বোটে ছিল সহায়ক দল। সেটিতে রাকার স্কুবা ডাইভিং প্রশিক্ষক ডুবুরি মজিবর রহমান, স্বামী ফজলে রাব্বি, ভিডিওগ্রাফার তূর্যসহ কয়েকজন।

রোমাঞ্চপ্রিয়দের জন্য রাকার দোকান পিক৬৯

বিপদ নেমে এসেছিল শুরুতেই। রাকা বলে যান, ‘শাহ্‌পরীর দ্বীপ থেকে সবে আধা কিলোমিটার গিয়েছি আমরা। দেখলাম তিন দিক থেকে বিরাট বিরাট কয়েকটা ঢেউ এগিয়ে আসছে। বেশ উঁচু। কায়াকে আমার অভিজ্ঞতা কম নয়। তবু ঢেউয়ের বিশালতায় ভয় ভর করল। কোনোমতে ঢেউ পেরোলাম। ঢেউ পেরোনের পর আমাদের সঙ্গে থাকা সার্ভিস বোটটা আর খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমরা বিপদে পড়লে উদ্ধার করার কথা তাদের। কিছুক্ষণ পর সেটি এগিয়ে আসতে থাকল। সেই নৌকার ইঞ্জিন চালু হতে সময় লাগছিল। আমাদের কায়াকের দেখা না পেয়ে তাঁরা ভেবেছিলেন, আমরা বুঝি হারিয়ে গেছি।’

এরপর তরতর করেই এগিয়েছে রাকাদের নৌকা। ২ ঘণ্টা ৫২ মিনিটে ১৪.৭৫ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে পৌঁছান সেন্ট মার্টিনে। বইঠার নৌকা চালিয়ে রাকা ও সায়মন বাংলা চ্যানেল পাড়ি দিলেন।

 জলের নিচে সন্তরণ

পরদিন তো সেন্ট মার্টিনে নামলেন জলের গহিনে। কেমন লাগল? ‘সত্যি বলতে তিন–চার বছর আগে সেন্ট মার্টিনে পানির নিচে যা ছিল তার প্রায় কিছুই নাই এখন। লোকজন সাগরের নিচে থাকা প্রবাল প্রাচীর থেকে প্রবাল কেটে নিয়ে গেছে। প্লাস্টিকের মতো বর্জ্যের কারণে রংবেরঙের মাছও প্রায় উধাও।’ তবে এখন আগের চেয়ে কিছুটা সচেতনতা বেড়েছে বেড়াতে আসা মানুষের মধ্যে।

রাকা ও ফজলে রাব্বি

পর্বতে শুরু

জলের পাশাপাশি অন্তরিক্ষের কাছাকাছি স্থল—পাহাড়–পর্বতও কম টানে না রাকাকে। অন্নপূর্ণার বেসক্যাম্পে গিয়েছেন। নেপালের হিমালয় রেঞ্জের পাহাড়গুলো রাকার কাছে আকর্ষণীয়। ‘পর্বতের শৃঙ্গজয় (সামিট করা) আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি পাহাড়ে ঘুরব, সেখানকার মানুষ দেখব, তাদের সংস্কৃতি বোঝার চেষ্টা করব। তারপরও এ বছর ইচ্ছা আছে ৬০০০ মিটার উচ্চতার পর্বতে ওঠা।’ বললেন রাকা।

আশৈশব রোমাঞ্চের হাতছানি

রাকার ঘুরে বেড়ানোর শখ ছোটবেলা থেকেই। ১৯৮৭ সালে কুষ্টিয়ায় নানাবাড়িতে জন্ম তাঁর। কিছুদিনের মধ্যেই চলে আসেন ঢাকায়। উত্তরখানে দাদার বাড়ি। এখানেই বেড়ে ওঠা। প্রয়াত বাবা সাদাত আহমেদ ছিলেন ব্যবসায়ী। মা জে বি ঝরনা গৃহিণী, তবে গান ও লেখালেখি করেন। এক ভাই, দুই বোনের মধ্যে রাকা সবার বড়। ভিকারুননিসা স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বদরুন্নেসা কলেজ পেরিয়ে স্নাতক হয়েছেন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস, অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি (আইইউবিএটি) থেকে।

১৫ জানুয়ারি কায়াক চালিয়ে বঙ্গোপসাগরের ‘বাংলা চ্যানেল’ পাড়ি দিচ্ছেন হানিয়াম মারিয়া ও সায়মন হোসেন

মায়ের সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছেন অনেক। তবে অ্যাডভেঞ্চার বলতে যা বোঝায় সেটা শুরু ২০১৪ সালে অন্নপূর্ণার বেসক্যাম্প থেকে। বানজি ও সুইং জাম্প দিয়েছেন, সাইক্লিং করেছেন—এখন ঝুঁকে পড়েছেন জলক্রীড়ার দিকে। রাকার অভিযাত্রার সঙ্গী তাঁর স্বামী ফজলে রাব্বি। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করেন। ট্রাভেলার্স অব বাংলাদেশ (টিওবি) নামের ফেসবুক গ্রুপ চালান আর ঘুরে বেড়ান। তাঁরা বিয়ে করেছেন ২০১৬ সালে।

চাকরি একটা রাকাও করতেন। সেটা ছেড়ে দিয়েছেন। করছেন ব্যবসা। পিক৬৯ নামের সে দোকান রোমাঞ্চপ্রিয়দের জন্যই। বেড়ানো ও অভিযানে যাওয়ার জন্য দরকারি পণ্য (গিয়ার) বিক্রি হয় সেখানে। ঢাকার বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্স এবং এলিফ্যান্ট রোডে পিক৬৯–এর দুটি শাখা আছে। রাকার ভাষায়, ‘ব্যবসার জন্য ব্যবসা করি না। এখানে বই পাওয়া যায়, বসে বই পড়া যায় আর চা–কফি পান করা যায় বিনা মূল্যেই। আসলে আমরা চাই মানুষ বেশি করে ঘুরে বেড়াক, অ্যাডভেঞ্চার করুক, এ ব্যাপারে জানুক।’

নিজেদের একটা নৌকা আছে রাকা ও ফজলে রাব্বির। সেটাতে ইঞ্জিন লাগানো। এটা নিয়ে তাঁরা ঘুরে বেড়ান এখানে–সেখানে। ‘এখন কায়াক নিয়ে বাংলাদেশের সব নদীতে যেতে চাই। নদীমাতৃক দেশে জলে জলে অ্যাডভেঞ্চার আরও বেশি করে করা উচিত।’ রাকার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা।

রাকার আরও কিছু স্বপ্ন আছে, সেগুলো এখানে না হয় অব্যক্তই থাক।