>রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি—চারটি ক্ষেত্রে চার তরুণ লিখছেন ভবিষ্যতের বাংলাদেশ সম্পর্কে। আজ শেষ পর্বে সংস্কৃতি
বাংলাদেশের সংস্কৃতি বিচিত্র ও বহুস্তর। একে একটি মোটা দাগে দেখা মুশকিল। অঞ্চল, গোষ্ঠী ও শ্রেণির দীর্ঘ সময়ের নানা ঘাত-প্রতিঘাতে সংস্কৃতির এ বৈচিত্র্য গড়ে উঠেছে। পয়লা বৈশাখের উপলব্ধি শহুরে বাঙালি মধ্যবিত্ত আর একজন গ্রামের কৃষকের কাছে আলাদা; আবার সমতল ও পাহাড়ের বাসিন্দাদের মধ্যেও এর ভিন্ন ভিন্ন মানে। সংস্কৃতিকে বোঝার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, এ দেশের সব উপাদান এক জায়গায় এনে বিপুল বৈচিত্র্য ও বৈপরীত্যসহ একে দেখতে হবে। বাংলাদেশকে বুঝতে হলে সেই বৈচিত্র্যের উপলব্ধিতে পৌঁছানোই হতে হবে আমাদের আগামী দিনের সাধনা। যতই আমরা সংস্কৃতির বিভিন্ন ছোট স্বরগুলোকে তুলে ধরতে পারব, ততই আমরা এগিয়ে যাব।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, বাঙালি বলতে আমরা নিজেদের কীভাবে চিহ্নিত করতে চাই? আগামী দিনে বাঙালিত্বের ধারণাকে আরও মুক্ত, ব্যাপ্ত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক না করে এগোনোর উপায় নেই। এই ধারণা বড় করে তুলতে না পারলে আমরা নিজেরা ছোট হতে থাকব। কিছুদিন আগেই নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায় ও গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের ওপর যে দৃষ্টিভঙ্গির কারণে হামলা হলো, ঠিক তারই বিরুদ্ধে একাত্তরে যুদ্ধ করে আমরা বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছি। আমরা যদি বলি মুক্তিযুদ্ধ আমাদের চেতনার কেন্দ্রবিন্দু, তাহলে বাঙালিত্বের ধারণাকে এসব ভেদবুদ্ধির ওপরে নিয়ে যেতে হবে।
আমাদের সমাজে যে বিভক্তি জন্মেছে, তা খুবই বিপজ্জনক। ভিন্ন কণ্ঠস্বর নিয়ে আলোচনা তো দূরের কথা, তা প্রকাশের ক্ষেত্রই সংকুচিত। এ পরিস্থিতি যেকোনো সময় দাবানল তৈরি করতে পারে। বিকল্প পরিসর তৈরি করতে না পারলে এবং ক্রমশ তা বড় করে তুলতে না পারলে সামনে বড় বিপদ ঘটতে পারে।
আমাদের সংস্কৃতিচর্চার প্রায় সবটাই শহরকেন্দ্রিক। আরও শুদ্ধ করে বললে, ঢাকাকেন্দ্রিক। এ-ও সারা দেশের সঙ্গে আমাদের এক বিচ্ছিন্নতার উৎস। সংস্কৃতিকে শুধু শহুরে শিল্পচর্চার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেললে বৃহত্তর সমাজের বহু উৎকৃষ্ট বিষয় থেকে আমরা বঞ্চিত হব। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ঢাকা শহরের খুব কাছেই মানিকগঞ্জ। সেখানে মহররমের অনুষ্ঠানে সব মানুষ জড়িয়ে পড়ে। বেশির ভাগ মানুষই সুন্নি। অথচ মহররম মূলত শিয়াদের অনুষ্ঠান। এর পেছনে গল্প আছে। উনিশ শতকের প্রথম দিকে মানিকগঞ্জের এক লোক ভারতে পড়তে গিয়ে এক শিয়া গুরুর কাছে দীক্ষা নেন। নিজের মেয়ের সঙ্গে গুরু তাঁর বিয়ে দেন। এই বাংলায় মহররমের চল নেই বলে মেয়েটি আসতে চাইলেন না। শর্ত দিলেন, মহররমের অনুষ্ঠান করলেই কেবল তিনি আসবেন। সেই থেকে শুরু। এই মহররম একেবারে আলাদা। এলাকার মানুষ সেখানে নিজের জীবনের ত্যাগ ও লড়াইয়ের সঙ্গে মহররমের গল্পকে মিশিয়ে দিয়েছে।
একইভাবে বেহুলা-লখিন্দরের গল্পে বা লালনের গানে বহু কালের যেসব অভিজ্ঞতা পুঞ্জিত হয়ে আছে, গবেষণা করে জ্ঞান আকারে আমাদের মধ্যে সেসব নিয়ে আসা দরকার। একদিকে আমাদের সংস্কৃতির দার্শনিক পর্যালোচনা দরকার, আরেক দিকে প্রয়োজন পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের সপ্রাণ যোগাযোগ। ধরা যাক, জয়নুল আবেদিন বাংলাদেশের অসাধারণ প্রতিভাবান একজন শিল্পী। বাংলাদেশকে পৃথিবীর কাছে তুলে ধরতে জয়নুল আবেদিনকে বিদেশিদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। এ জন্য দরকার মানসম্পন্ন গবেষণা ও প্রকাশনা।
আবার ঢাকার কথাই ধরা যাক। সাংস্কৃতিক অবকাঠামোর কত বড় পরিবর্তনই বা এখানে ঘটেছে। আগে সবাই নাটক দেখত বেইলি রোডে। এখন তাদের নাটক দেখতে যেতে হয় শিল্পকলা একাডেমিতে। নবাবপুর, ধানমন্ডি, গুলশান, উত্তরায় কেন একটি করে মঞ্চ থাকবে না?
একইভাবে ঢাকার নানা অঞ্চলে খেলার মাঠ নেই, সিনেমা হল নেই, লাইব্রেরি নেই। এই তালিকারও শেষ নেই। আমরা এখনো গুটিকয়েক মানুষের জন্য সুনির্দিষ্ট অবকাঠামোয় তুষ্ট হয়ে আছি।
এবারের ছবিমেলায় নাসির আলী মামুনের তোলা প্রতিকৃতির একটি প্রদর্শনী থাকবে। তাঁর ছবির তালিকায় শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, এস এম সুলতানের মতো শ্রেষ্ঠ বাঙালি মনীষার সম্ভার। নাসির আলী মামুনের তোলা ছবি দেখতে দেখতে মনে হয়, আজ তিনি কার ছবি তুলবেন? আমার সময়ে কি কেউ কবিতার জন্য জীবনের সর্বস্ব বাজি রাখতে রাজি আছেন? কোথায় সেই মৃত্যুকে অগ্রাহ্য করা স্বপ্ন? আমাদের সমাজে কী এমন পরিবর্তন ঘটে গেল, যা এমন স্বপ্ন দেখার সাহস জোগায় না? সমাজের বদল ঘটবে। কিন্তু আমাদের অমূল্য বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেললে তো চলবে না।
আবার ইতিবাচক বহু ঘটনাও ঘটছে। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন এবার পঞ্চমবারের মতো উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের আয়োজন করল। বৈরী রাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের মাটিতে এমন উৎসব ভাবা যায়? ভোর চারটা পর্যন্ত জেগে স্টেডিয়ামভরা মানুষ শুনছে শুদ্ধ দরবারি সংগীত। এই শ্রোতার সিংহভাগ অংশ আবার তরুণ। বাংলাদেশেই ঘটছে এই অবিশ্বাস্য ও অকল্পনীয় কাণ্ড। ঢাকা আর্ট সামিটের যে আয়োজন বাংলাদেশ করল, তা তো বিশ্বমানের। কী কল্পনায়, কী পরিকল্পনায়! শিল্পভাষার বৈচিত্র্যে ও উপস্থাপনের গুণে এ-ও আমাদের যোগ্যতার প্রমাণ হয়ে উঠল। ১৮ বছর ধরে ছবিমেলার যে আয়োজন হচ্ছে, তাতে বিশ্বসেরা শিল্পীদের আলোকচিত্র দেখতে পাচ্ছে বাংলাদেশের দর্শকেরা।
বাংলাদেশ এখন আর শুধু বাংলাদেশের ভেতরেই আটকে নেই। এ দেশের তরুণদের প্রতিভা ছড়িয়ে পড়ছে সারা পৃথিবীতে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীরা লন্ডন, প্যারিস, নিউইয়র্কে গিয়ে তাদের প্রতিভায় সবাইকে অভিভূত করে দিচ্ছে। তাদের হাত ধরে খুলে যাচ্ছে বহু নতুন সম্ভাবনার পথ। চট্টগ্রামের ছেলে আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদকে আমরা কে চিনতাম? কিন্তু লাইভ ফ্রম ঢাকা বানিয়ে আন্তর্জাতিক পুরস্কার ছিনিয়ে এনেছেন তিনি। এর মানে হলো, আমাদের চেনাজানা সাংস্কৃতিক পরিসরটি একটু একটু করে বড় হতে শুরু করেছে; ছড়িয়ে পড়ছে ঢাকার সীমানার বাইরে।
এই যে পালাবদলটা শুরু হয়ে গেছে, এ আমাদের ধরে রাখতে হবে। বাংলাদেশ এমন একটা সময় অতিক্রম করছে, যেখানে অস্থিরতা ও শূন্যতা আছে। আবার একই সঙ্গে আছে অন্তহীন সম্ভাবনা।
মুনেম ওয়াসিফ: আলোকচিত্র শিল্পী