বখতিয়ার হামিদ। নিজের গ্রামে গড়ে তুলেছেন পাখি ও বন্যপ্রাণীর অভয়াশ্রম
বখতিয়ার হামিদ। নিজের গ্রামে গড়ে তুলেছেন পাখি ও বন্যপ্রাণীর অভয়াশ্রম

পাখিদের ‘ফ্ল্যাট’ বানিয়ে দেন বখতিয়ার

তরুণ বখতিয়ার হামিদ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। প্রাণী সংরক্ষণে মনোযোগী হয়েছিলেন চুয়াডাঙ্গার নিজ গ্রাম বেলগাছিতে। গ্রামটি এখন ‘বন্য প্রাণী ও পাখির গ্রাম’ হিসেবে পরিচিত। বখতিয়ার যে কাজ শুরু করেছিলেন নিজের গ্রামে, সেই বার্তা এখন তিনি ছড়িয়ে দিচ্ছেন বিভিন্ন জেলায়। ফেসবুকেও তাঁর কাজ দেখে অনুপ্রেরণা পান অনেকেই।

চুয়াডাঙ্গা পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বেলগাছি পুরোপুরি শহর হয়ে ওঠেনি। তবে তা নিয়ে বাসিন্দাদের মনে কোনো আক্ষেপ নেই। বেলগাছিকে মনে হতে পারে শহরের ভেতরে একটুকরা গ্রাম। সেখানে বহুতল ভবনের পাশাপাশি আছে আধা পাকা ও কাঁচা বাড়ি। রাস্তার দুধারে পুকুর, ফসলি জমির মধ্যে রয়েছে নানা প্রজাতির গাছের সমাহার। সেসব গাছে ঝুলছে মাটির ছোট ছোট কলসি। অনেকেই এখন সেগুলোকে বলেন ‘পাখিদের ফ্ল্যাট’। সেই কলসির দিকে চোখ পড়তেই থমকে দাঁড়াতে হয়। দৃষ্টি কাড়ে কলসির সরু মুখ দিয়ে রংবেরঙের পাখি ঢুকছে, বের হচ্ছে। মন কাড়ে ধানখেতে পার্চিং হিসেবে পুঁতে রাখা ডালে বসে পাখিদের দোল, ঝোপঝাড়গুলোতে খরগোশ ও বেজির আনাগোনা, গাছের শরীর বেয়ে কাঠবিড়ালি ও গিরগিটির চঞ্চলতা।

এ যেন কাঠবিড়ালিদের সমাবেশ
নিজের ‘ফ্ল্যাটে’ দোয়েল!

পেশাগত কারণে প্রায়ই যাওয়া হয় বেলগাছি। সর্বশেষ ২৭ সেপ্টেম্বর গিয়েছিলাম। এ দিন দুটি বাগডাশ অবমুক্ত করা হয় সেখানে। নানা বয়সী মানুষের সঙ্গে কথা হয় সেদিন। মন দিয়ে আবারও শুনি বখতিয়ার হামিদ ও তাঁর সঙ্গীদের প্রকৃতিপ্রেমের গল্প।

তরুণ বখতিয়ার হামিদ চুয়াডাঙ্গা সদরের গাইদঘাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। তাঁর নেতৃত্বেই গ্রামটি হয়ে উঠেছে পাখি ও প্রাণীর আবাসস্থল। তাই তো গ্রামজুড়ে ঝুলছে ‘পাখি শিকার নিষিদ্ধ’, ‘এসো, পাখির বন্ধু হই’ লেখা সাইনবোর্ড। বেলগাছি এখন পাখিদের গ্রাম। শালিক, ঘুঘু, প্যাঁচা, শ্যামা, শামুকখোল, বক, চন্দনা টিয়া, হীরামনের আনাগোনা রয়েছে বেশ। সেই সঙ্গে মেটে তিতির, পাতা বুলবুলি, কমন ব্যবলার, হলুদ চোখ ছাতারে ও জলময়ূরেরও দেখা মেলে ইদানীং।

শুধুই কি পাখি? বন্য প্রাণী ও বেওয়ারিশ কুকরের জন্যও অভয়াশ্রম এই বেলগাছি। গ্রামের মাঠে গেলেই এখন দেখা মেলে খরগোশ, বনবিড়াল, বাগডাশ, মেছো বাঘ ও শিয়ালের।

বেলগাছি গ্রামে এ এক পরিচিত দৃশ্য

গোড়ার গল্প

এক যুগ আগেও গ্রামটি এমন প্রাণীবান্ধব ছিল না। শিকারির উৎপাত আর কীটনাশক ব্যবহারের নেতিবাচক প্রভাবে পাখিরা গ্রাম ছেড়েছিল। সেই পরিবেশ পছন্দ হচ্ছিল না বখতিয়ার হামিদের। সে সময়ের কথা বলছিলেন তিনি, ‘২০০৭ সালে আমি স্নাতকের ছাত্র ছিলাম। তখন প্রতিবাদ করতে গিয়ে পাখিশিকারিদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছিলাম। এরপর বন্ধুদের নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলি।’ প্রতিরোধের মুখে শিকারিদের গ্রামে আসা বন্ধ হয় বটে, কিন্তু দীর্ঘদিন পাখিদের দেখা মেলেনি। পরে ধীরে ধীরে ফিরে আসে পাখিরা।

গ্রামে পাখি ও প্রাণীদের ফিরিয়ে আনতে বখতিয়ার উদ্যোগ নেন। ২০১১ সালে ৩৫ জন সমমনা তরুণকে নিয়ে গড়ে তোলেন ‘বেলগাছি যুব সমাজ’ নামের সংগঠন। সে সময়ে টিউশনির টাকায় গ্রামের রাস্তার দুধার ও কবরস্থানের গাছগুলোতে এক হাজারের বেশি কলসি বেঁধে দেন। এরপর কলসির সংখ্যা বাড়তেই থাকে। দিনে দিনে কলসিতে বাসা বাঁধে পাখিরা। তাদের খাবারের জোগান দিতে ধানসহ বিভিন্ন ফসলের খেতে বাঁশের মাচা ও পুরোনো ডাল পুঁতে পাখিদের বসার ব্যবস্থা করেন। পাখিরা ডালে বসে ক্ষতিকর পোকা খেয়ে ফেলায় জমিতে কীটনাশকের ব্যবহারও কমতে থাকে। এক বছরের মাথায় ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি আসতে শুরু করে গ্রামটিতে। শীতকালে পরিযায়ী পাখিরাও আসে দল বেঁধে। শীত শেষে আবার নির্বিঘ্নে ফিরেও যায় আপন ঠিকানায়। বখতিয়ার বলেন, ‘অনুকূল পরিবেশ পেয়ে প্রায় ২০ বছর পর গ্রামে বাবুই পাখি ফিরে এসেছে আমাদের গ্রামে। তাল ও নারকেলগাছে তারা বাসা বেঁধেছে। ভাবতে ভালোই লাগে।’

গাছে গিরগিটি!

বেলগাছি যেন সংরক্ষিত বন

চুয়াডাঙ্গা জেলায় কোনো সংরক্ষিত বন নেই। তবে সামাজিক বন বিভাগের কর্মকর্তাদের ভরসা করার মতো একটি জায়গা আছে। সেই জায়গা বেলগাছি। সামাজিক বন বিভাগ চুয়াডাঙ্গার বনরক্ষক জাকির হোসেন জানালেন, জেলার বিভিন্ন প্রান্তে প্রায় সময়ই বন্য প্রাণী ও পাখি ধরা পড়ে। এরপর সেগুলোকে নিয়মানুযায়ী অবমুক্ত করতে হয়। সেই কাজ বেলগাছিতে নিশ্চিন্তে করা যায়।

বখতিয়ার হামিদ তাঁর বাড়ি লাগোয়া নিজের জমিতে গড়ে তুলেছেন কেয়ার ফর আনক্লেমইড বিস্ট (কাব) হাসপাতাল। হিংস্র কোনো প্রাণীর আক্রমণ বা ঝড়-বৃষ্টিসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে অসুস্থ বন্য প্রাণী ও পাখিদের নিয়মিত চিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকে এই হাসপাতালে। এ জন্য তিনি প্রাণিসম্পদ বিষয়ে ২০১৬ সালে দীর্ঘমেয়াদি একটি কোর্সও সম্পন্ন করেছেন।

বখতিয়ার হামিদ

বৃত্তের বাইরে

নিজ গ্রাম বেলগাছি ও নিজ জেলা চুয়াডাঙ্গাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি বখতিয়ারের প্রকৃতিপ্রেম। ২০১৭ সালে কুষ্টিয়ায় পিটিআই চত্বরে পাখির অভয়াশ্রম গড়ে দিয়েছেন। পাখিসহ বন্য প্রাণী সংরক্ষণে এয়ারগান এবং ফলের বাগানে কারেন্ট জাল ব্যবহার বন্ধে ২০১৮ সালে দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে প্রচারাভিযান চালান। দেশের ২২টি জেলায় বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ও স্বেচ্ছাসেবকেরা ‘মাটির কলসিতে পাখির ফ্ল্যাট’ বাস্তবায়ন করেছে।

চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক মো. নজরুল ইসলাম সরকার পাখি ও প্রাণী সংরক্ষণে ‘বেলগাছি মডেল’–এর প্রশংসা করলেন। তিনি বলেন, ‘আমি খুব কাছ থেকে বখতিয়ারের কাজ দেখেছি। জেলার সব কটি উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়নগুলোতে পরিকল্পিতভাবে এই মডেল বাস্তবায়নে শিগগিরই কাজ শুরু করা হবে।’

করোনাকালেও প্রাণীদের পাশে

করোনাকালে সাধারণ ছুটি চলার সময় বিপদে পড়েছিল এলাকার বেওয়ারিশ কুকুরগুলো। দোকানপাট বন্ধ থাকায় কুকুরগুলোকে প্রায় সময়ই অভুক্ত থাকতে দেখা যায়। বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে বখতিয়ার কুকুরগুলোর খাবারের ব্যবস্থা করেন। রোজ বাড়িতে রুটি বানিয়ে নিয়ে যেতেন পৌর এলাকায়। পথে পথে ঘুরে কুকুরগুলোকে নিয়মিত খাওয়াতেন।

বখতিয়ারের সারথিরা

নিজের কাজে বন্ধুদের পাশে পেয়েছিলেন বখতিয়ার। তাই তো বন্ধুদের ভূমিকার কথাই বারবার বলেন তিনি। বখতিয়ার হামিদ বললেন, ‘পাখি ও বন্য প্রাণীর অভয়াশ্রম গড়তে শুধু আমি নই, বেলগাছি যুব সমাজের ৩৫ জন সদস্যের প্রত্যেকেরই ভূমিকা রয়েছে। যাঁদের মধ্যে বর্তমানে ১৫ জন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে পড়ছেন। অন্যরা পেশাগত কারণে জেলার বাইরে অবস্থান করছেন।’ এখনো যাঁরা নিরলস পরিশ্রম করে চলেছেন, তাঁদের কয়েকজনের নামও গড়গড় করে শোনালেন তিনি—আরিফুজ্জামান, আশরাফুল হক, শাহীন কবির, ডালিম মিয়া, এনায়েতুল্লাহ, মাহমুদ হাসান, সবুজ হোসেন, ইখতিয়ার হোসেন, নাজমুল হোসেন প্রমুখ।

সারা দেশে বানাবেন পাখির ‘ফ্ল্যাট’

পাখিদের আবাস গড়ে দিতে সারা দেশে পাখিদের ‘ফ্ল্যাট’ বানানোর স্বপ্ন বখতিয়ার হামিদের। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে তিনি বললেন, বনের পাখি ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণে বেলগাছি মডেল সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে চাই। পাখি ও বন্য প্রাণীদের নিরাপদে থাকার স্বার্থে রেললাইনের দুধারের ঝোপঝাড় রক্ষায় শিগগিরই চুয়াডাঙ্গার দর্শনা থেকে কুষ্টিয়ার জগতি পর্যন্ত ৫৪ কিলোমিটার রেলপথ পায়ে হেঁটে প্রচারণা চালাব। পরিবেশ রক্ষায় যা খুবই জরুরি।