কী আর করা যাবে, সবই কপাল! গ্রামের টাটকা বাতাস রুজিতে নাই। তাই ফাটকাবাজির শহরে আটকা পড়ে আছি। একের পর এক শুক্কুরবার কেটে যাচ্ছে। একটার পর একটা ডে অফ টুক করে চলে যাচ্ছে। টের পাচ্ছি না। খালি কাজ! আর অ-কাজ!
অবলা দুই শিশুপুত্র আটক ঘরে হাঁসফাঁস করে। প্রায়ই ব্যাগ গুছিয়ে হাঁটা দিতে চায়। সেদিন শুক্রবারে ছোটটা বলল, ‘তলো! তলো!’ মানে ‘চলো, বাইরে ঘুরিয়ে আনো!’ মানে, ঘর নামের এই জেলখানা তার ভালো লাগে না। বললাম, ওকে, ডান! তলো!
বউকে বললাম, ঝটপট রেডি হও! বেড়াতে যাব!
‘কোথায় বেড়াতে যাবে?’
জেলখানায়।
‘মানে!’
পশুপক্ষীর জেলখানায়। ভদ্র ভাষায় যাকে বলে চিড়িয়াখানা।
দুই ছেলের মা এই প্রস্তাবে বিরাট খুশি। সে এক টিকিটে দুই কাজ সারার তালে আছে। লায়ন মানে সিংহ, টাইগার মানে বাঘ, পিকক মানে ময়ূর—এসব থিউরিটিক্যাল পড়াশোনার একটা প্র্যাকটিক্যাল কোর্স সে দুই ছেলেকে করানোর মোক্ষম সুযোগ পেয়ে গেছে। বিনোদনের সঙ্গে ব্যবহারিক শিক্ষার ক্লাসের মারাত্মক মেলবন্ধন। অধুনালুপ্ত গুলিস্তান হলের ‘এক টিকিটে দুই ছবি’ আরকি!
২.
সকাল সাড়ে ১০টা। চিড়িয়াখানায় ঢুকলাম। ছেলে-বুড়ো, মেয়ে-বুড়ি—এই রকমের নানা কিসিমের লোক এসেছে। বুঝলাম, চিড়িয়াখানা একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান, পরিবারের সবাইকে নিয়ে ঢোকার মতো জায়গা।
মাইকে কোকিলকণ্ঠী ঘোষিকা বলছেন, ‘চিড়িয়াখানার মধ্যে ধূমপান আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ!’ কিন্তু ঢুকতেই ভেতরে গণশৌচাগারের পাশে দেখা গেল, এক লোক বিড়ি-সিগারেটের বিরাট দোকান সাজিয়ে বসে আছেন। নিজেও আয়েশ করে সিগারেট টানছেন। প্যারাডক্স আর কাকে বলে!
দশ কদম বাড়াতেই হাতের বাঁ পাশে মাঠের মতো জায়গা। সেখানে হরিণের দল। মায়াভরা চোখে চেয়ে আছে একদল মৃগ। মায়ামৃগ। মাঠে কোনো ঘাস নেই। কাদা আর খানাখন্দ আছে। রোজ চা-নাশতার মতো সকালে যে লতাপাতা খেতে দেওয়া হয়, এখনো তা আসেনি। চিড়িয়াখানার কর্মীরা সকালে গোসল-টোসল করে খাবারটাবার খেয়ে আসবেন। তারপর তারা খাবার পাবে। না খাওয়া মায়ামৃগ দেখে বড় মায়া হলো। মন খারাপ হলো।
ভাবলাম শাখামৃগের কাছে যাই, মন ভালো হবে। বাচ্চারা বানর দেখে মহাখুশি। খাঁচার কাছে যেতেই বিষ্ঠার গন্ধে বমি আসার জোগাড়। বানর এবং বানরের বাচ্চাদের দিকে আঙুল তুলে আমার বউ তার ও আমার, মানে আমাদের বাচ্চাদের দেখাতে দেখাতে বলল, ‘দেখো বানর! বলো, “মানকি!” মানকি মানে বানর!’ এই শিক্ষামূলক লেকচারে তাদের আগ্রহ দেখা গেল না। আরও কতগুলো বাচ্চার সঙ্গে মিলে দুই ছেলে তাদের ‘জ্ঞাতি’দের গায়ে সমানে ঢিল ছুড়তে লাগল। বানরগুলো উত্তেজিত হয়ে চিঁ চিঁ করছে। বড়রা আদর করে বাদাম ছুড়ে মারছে। তাদের খাঁচাভরা বিষ্ঠা, ইটের খোয়া আর বাদামের খোসা। এমন ঘরে বানর তো দূরের কথা, আমাদের মতো ভদ্দরনোকও থাকতে পারবে না।
বানরের খাঁচা থেকে এবার এলাম সত্যিকারের ‘চিড়িয়াখানায়’। ‘চিড়িয়া’ শব্দের অর্থ যেহেতু পাখি, সেহেতু পাখিদের বড় খাঁচাটাকেই আমার আক্ষরিক অর্থে ‘চিড়িয়াখানা’ মনে হলো। বেশ বড় একটা জায়গা। তারের জাল দিয়ে ঘেরা। এর মধ্যের সব পাখিই বকশ্রেণির। সাদা বক, কানি বক, আরও কী সব ইংরেজি-বাংলা মেশানো নামের বক। সংখ্যায় তারা শখানেক। এই বকগুলোর কোনো বকবকানি নেই। সবাই চুপ মেরে আছে। পোস্তা করা মেঝে। বক ও তাদের বাচ্চাকাচ্চার পানি খাওয়ার ব্যবস্থা হিসেবে ভেতরে একটা চৌবাচ্চা আছে।
মা বকগুলোর অবস্থা দেখে চোখে পানি এল। মেঝেতে ছড়ানো একরাশ ডিম। সম্ভবত এখন তাদের ডিম পাড়ার মৌসুম। ডিম পাড়তে একটু লতাপাতা লাগে। একটু বাসার মতো জায়গা হলে হয়। সে ব্যবস্থা নেই। খালি ফ্লোরে ডিম পেড়ে সেই ডিমে তা দিয়ে মা হওয়ার সে কী দুর্মর চেষ্টা! কিউরেটর থেকে আমাদের মতো দর্শনার্থীদের সবার কাছে ওগুলো মূল্যহীন ডিম। মা বকগুলোর কাছে ওগুলো অনাগত সন্তান। সেই সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাতে মা বকেরা তপ্ত মেঝেতে ডিম আগলে বসে আছে। এসব বকের মাতৃত্ব উপলব্ধির মতো মন আমাদের মতো বকধার্মিকদের আগেও ছিল না, এখনো নেই। কবে হবে, কে জানে!
বাঘ আর সিংহের খাঁচা দূরে নয়। কাছাকাছি। গিয়ে দেখি সিংহ আর বাঘ বাবু না খেতে পেয়ে কাবু হয়ে বিড়ালের কায়দায় ঝিম মেরে আছে। বাচ্চারা খাঁচার কাছে গিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে ‘হা-লু-ম’ বলে শব্দ করল। কিন্তু তাতে তাদের সাড়াশব্দ মালুম হলো না। যে ঘরে বাঘ আর সিংহগুলো আছে, তাতে দৌড়াদৌড়ি দূরে থাক তার দশ কদম ফেলার উপায় নেই। ঘরের সাইজ দেখেই কবীর সুমনের ‘দশ ফুট বাই দশ ফুট গান’ মনে আসতে বাধ্য। একটু বাদেই খাবার এল। মাংস। মনে হলো গরুর মাংস। খানিক চেখেটেখে তারা রেখে দিল। আশ মিটিয়ে খাওয়া যাকে বলে, সে রকম খেল না। মনে মনে বললাম, বিড়ালের পেটে ঘি হজম হয় না। সাড়ে পাঁচ শ টাকা কেজি দরে কেনা গরুর মাংসের এমন লুকরেটিভ অফার কেউ পায়ে ঠেলে? পাশে দাঁড়ানো এক ভদ্রলোক বলেন, ‘মনে হয় ফ্রিজে রাখা মাংস। ঠান্ডা বলে খাচ্ছে না।’ এখানেও মন খারাপ হলো।
বনমানুষের খাঁচার সামনে গিয়ে আরও একবার বুঝলাম, আমরা অমানুষ। ওরাংওটাংটা করুণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে দর্শনার্থীদের দিকে। তার চোখে প্রচ্ছন্ন আর্তি। বন্দিদশা থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য নাকি স্রেফ খাবারের জন্য সে অমন করে চেয়ে ছিল, তা বোঝা যাচ্ছিল না। একজন একটা কলা এগিয়ে দিলেন। ওরাংওটাংটা অবিকল ভিক্ষুকের মতো হাত পেতে নিল।
ভল্লুক আর উল্লুককে দেখলাম গালে হাত দিয়ে সুকান্ত স্টাইলে আড়ার ওপর বসে আছে।
শিকারি পাখিদের খাঁচায় একটা চিল পানির ট্যাপের মুখ কামড়াচ্ছে। বুঝলাম তেষ্টা পেয়েছে। সে জানে এই ফুটো দিয়ে পানি পড়ে। সে ভাবছে এখন পানি পড়ছে না কেন? কল না ছাড়লে পানি পড়বে না, এই বিদ্যে এখন তাকে কে শেখাবে? অথচ ‘আজ দু ফোঁটা পানির তরে বুক ফেটে যায়!’
এরপর রামছাগল, পাঁঠা, গন্ডার, ভেড়া— সবার খোঁজ নিলাম। ওদের মধ্যে সবচেয়ে যাকে সুখী মনে হলো, তার নাম গাধা। জেব্রার পালের পাশে সে নিরিবিলি ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। গরাদের এ পাশে থাকা আমাদের স্বজাতি ভেবে হয়তো সে নিশ্চিন্ত মনে (গাধাদের মন আছে কি না, কে জানে!) আছে।
ওদের দেখে বাচ্চারা হাততালি দিচ্ছিল। পরিবারের সবাইকে নিয়ে দেখার মতো অশ্রুসিক্ত সামাজিক চিড়িয়াখানা দেখে আমার তখন মন খুবই খারাপ। বাচ্চাদের বললাম, ‘বাবারা, তলো!’