পরিবারে রূপচর্চা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে

নানি-দাদিদের শেখানো রূপচর্চার নানা কায়দাকেতা এখনো অনুসরণ করছে নতুন প্রজন্ম। এভাবে মিলেমিশেই নতুন-পুরোনো ধারায় ত্বক ও চুলের যত্ন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে থেকে যায়।

পরিবারের রূপচর্চায় থাকে ভালোবাসার ছোঁয়া। মা ও মেয়েকে নিয়ে মডেল হয়েছেন নৃত্যশিল্পী সামিনা হোসেন প্রেমা, রোকেয়া মীনাক্ষী হোসেন (মা) ও প্রথমা প্রত্যয়ী রাই (মেয়ে)

জীবনের উচ্ছ্বাসে, হাসি, আনন্দে উদ্ভাসিত প্রাণের কেন্দ্রবিন্দুই তো আমাদের ভালোবাসার পরিবার। সুস্থ জীবনধারার চর্চাও হয় সেখানেই। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, সময়ানুবর্তী জীবনযাপন, নিয়মমাফিক নিজের যত্ন নেওয়ার অভ্যাস এবং সব কাজে একে অন্যকে সহায়তা করা—এসবের ভিত গড়ে ওঠে পরিবারেই।

পারিবারিক বন্ধনের দৃঢ়তা নিশ্চিত হয় প্রত্যেক সদস্যের অন্তরের বিশুদ্ধ প্রশান্তি আর পারস্পরিক সুসম্পর্কের মাধ্যমেই। আবার মন ভালো থাকলে বাহ্যিকভাবেও ফুটে ওঠে সৌন্দর্যের আলো। ত্বক বা চুলের সুস্থতা শারীরিক সুস্থতারই অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর নিজের যত্ন নিলে মনটাও থাকে প্রফুল্ল। কেবল প্রতিষ্ঠানভিত্তিক সেবা দিয়ে নিজের সম্পূর্ণ যত্ন হয় না। বাড়িতে নিয়মিত যত্ন আবশ্যক। পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের প্রতি যত্ন ও ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দেওয়াটাও জরুরি বলে জানালেন মিউনিস ব্রাইডালের রূপবিশেষজ্ঞ তানজিমা শারমিন।

পরিবারেই গড়ে উঠুক সু-অভ্যাস

একটু যত্ন পেলে ভালো হয়ে যায় প্রিয়জনের মন

ত্বক ও চুল পরিচ্ছন্ন ও আর্দ্র রাখা প্রয়োজন সব বয়সেই। অভ্যাসগুলো শৈশব থেকেই গড়ে উঠুক। নৃত্যশিল্পী সামিনা হোসেনের মা রোকেয়া মীনাক্ষী হোসেন শৈশব থেকেই মেয়ের প্রতি যত্নশীল ছিলেন। নারকেল তেলে মেথি দিয়ে সেই তেল মাথায় মালিশ করা কিংবা মাথায় মেহেদি লাগানোর মতো সু-অভ্যাস মায়ের কাছ থেকেই শিখেছেন সামিনা। ত্বকের যত্নে দেখেছেন ঘৃতকুমারী ও লেবুর ব্যবহার, তবে হলুদ ব্যবহার হয়নি কখনোই। মেকআপ তুলতে নারকেল তেল বা অলিভ অয়েল ব্যবহার করতে বলতেন মা। নরম তুলা (বা কাপড়) দিয়ে মেকআপ তোলা হতো। সবশেষে মুখ ধুয়ে পুরু ক্রিম লাগানো হতো। সেই ধারা এখনো বজায় রয়েছে। সামিনার জন্য তো বটেই, কন্যা প্রত্যয়ী প্রথমার জন্যও। ছোটবেলা থেকেই মাকে সাজতে দেখেছে বলে নিজেও সাজতে ভালোবাসে সাড়ে আট বছরের এই দুরন্ত শিশু। মাথায় তেল বা মেহেদি দেওয়া, চুল আঁচড়ানো, চুল শুকানো—সব সময়ই একে অন্যকে সাহায্য করেন এই তিনজন।

রূপবিশেষজ্ঞ তানজিমা শারমিন পরামর্শ দিলেন পরিবারের সবার জন্য—

দুরন্তপনার শৈশবে

রূপচর্চা আর খুনসুটিতে রঙিন হয়ে উঠুক মুহূর্তগুলো

স্বাভাবিক যত্ন–আত্তিই হোক নিয়মমাফিক। শিশুর উপযোগী সাবান, শ্যাম্পু, তেল, লোশন বেছে নিন। শিশুর শরীরে তেল মালিশের প্রথা রয়েছে এ দেশের বহু পরিবারে। তবে শিশুর জন্য শর্ষের তেল ভালো নয় বলেই জানায় বিজ্ঞান। তাই যত্ন নিন জেনেবুঝে। ফেসপ্যাক, সানস্ক্রিন সামগ্রী বা কন্ডিশনারের প্রয়োজন নেই। চুলের কাটে স্বাচ্ছন্দ্যে থাক শিশু।

উঠতি বয়স থেকে

হরমোনের তারতম্যে ত্বকের ওপর প্রভাব পড়তেই পারে। বাইরেও যাওয়া হয় একটু বেশি। ত্বক ও চুল ভালোভাবে পরিষ্কার রাখাটা তাই জরুরি। এ সময় থেকেই গড়ে উঠুক ত্বকের উপযোগী সানস্ক্রিন সামগ্রী (চিটচিটে ভাব এড়াতে সানস্ক্রিন সমৃদ্ধ ফাউন্ডেশনও ব্যবহার করা যায়) এবং চুলে কন্ডিশনার ব্যবহারের অভ্যাসও। বাড়িতেই হোক যত্ন–আত্তি। কুড়িতে পা দেওয়ার আগে সৌন্দর্যচর্চাকেন্দ্রে নাই–বা গেলেন। ব্রণ খোঁটানো যাবে না—এই অভ্যাসও গড়ে উঠুক পরিবারে। ব্রণের সমস্যা অতিরিক্ত হলে চিকিৎসা নিন। বাড়িতে নিতান্তই হাত ও পায়ের যত্ন নেওয়া সম্ভব না হলে মাসে একবার প্রতিষ্ঠানভিত্তিক সেবা নিতে পারেন।

বয়সভেদে

অবসরে মা–মেয়ে মিলে চলুক রূপচর্চা

৩০ পেরোনো সদস্যরা ব্যবহার করতে পারেন নাইট ক্রিম, মাসে একবার ফেসিয়াল করাতে পারেন। ৫০ পেরোলে অনেকেরই নিজের প্রতি যত্ন নেওয়ার প্রবণতা কমে। সব ভাবনা দূরে রেখে সবাইকে নিয়ে হাসিখুশিভাবে বেঁচে থাকার নামই তো জীবন। সৌন্দর্যচর্চায় অভ্যস্ত কিংবা অনভ্যস্ত সবার জন্যই জীবনের শেষবেলাতে স্বাভাবিক যত্নটুকু নিশ্চিত করার দায়িত্ব নিতে হবে পরিবারের, তাঁদের সুস্থতার জন্যই। শিশুর মতোই যত্নে রাখুন তাঁদেরও। কুঁচকে যাওয়া, শুষ্ক ত্বকে প্রয়োজনমাফিক ময়েশ্চারাইজার লাগিয়ে দিন। তাঁর ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতায় সহায়তা করুন। চুল আঁচড়ে দিন, নখ কেটে দিন। মাথায় তেল মালিশ করুন। প্রয়োজনে শ্যাম্পু করতে, চুল ধুতে এবং শুকাতেও সহায়তা করুন।

সব বয়সের জন্য

এমনই কোমলতায় ঘিরে থাকুক নানি– নাতনির সম্পর্ক

অন্ততপক্ষে গোসলের পর একবার এবং রাতে একবার তো ময়েশ্চারাইজার লাগাতেই হবে। ত্বক তৈলাক্ত প্রকৃতির হলেও ময়েশ্চারাইজার আবশ্যক (বিশেষত রাতে)। কম বয়সে ত্বকের যত্ন নিলে বয়সের ছাপ পড়ে দেরিতে। পরিবারের সবাই যদি একসঙ্গে সৌন্দর্য চর্চা করেন, সময়টা আনন্দেই কাটবে। তবে ব্যক্তিগত যত্ন–আত্তির সামগ্রী আলাদা রাখা বাঞ্ছনীয়। মন ভালো থাকলে ঘুমও ঠিকঠাক, তাতে সৌন্দর্যও ঠিক থাকে ষোলো আনা।

একসঙ্গে সবাই

একে অপরকে সহযোগিতা করে ত্বক ও চুলের যত্ন নেওয়ার ধারা টিকে আছে পরিবারগুলোয়।

রোজ শরীরচর্চা হতে পারে একসঙ্গে। সপ্তাহান্তে নিজের সৌন্দর্যের জন্য যে একটু সময় রাখা উচিত, সেটাও হোক পারিবারিক নিয়ম। সপ্তাহের একটি দিন প্যাক ব্যবহার করতে পারেন পরিবারের সবাই (শিশু বাদে)। কোনো দিন হয়তো শসা বা দেশি আলু কাটা হচ্ছে বাড়িতে, যাতে সবারই হতে পারে সহজ রূপচর্চা—

শসা কিংবা দেশি আলুর কুচি চোখের ওপর রাখতে পারেন কিছুক্ষণ। এতে দূর হবে ক্লান্তিভাব এবং চোখের চারপাশের কালচে ছোপ। চাইলে তুলার প্যাড শসা কিংবা দেশি আলুর রসে ভিজিয়ে নিয়েও একইভাবে ব্যবহার করা যায়। এটি রোজ করলেও ক্ষতি নেই।

দাগছোপ (যেমন রোদে পোড়া দাগ) থাকলে সপ্তাহে দুই-তিন দিন দেশি আলুর রস ব্যবহার করুন। আলুর রস যতটা নেবেন, লেবুর রস নিন তার চার ভাগের এক ভাগ। লেবুর রস যতটা নেবেন, ততটাই নিন মধু। মিশিয়ে রাখলে নিচে ঘন আস্তর পড়বে। আস্তরটা তুলে দাগের স্থানে মালিশ করে লাগান। ১০-১৫ মিনিট পর ধুয়ে ফেলুন।

 উপটান লাগাতে পারেন একসঙ্গে (ত্বক শুষ্ক হলে দুধ দিন উপটানে)। ১০-১৫ মিনিট পর উপটান শুকিয়ে এলে হালকা পানি দিয়ে মালিশ করে করে তুলে ফেলুন।

রূপচর্চার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা আমাদের অনেকেরই নেই। তবে এটাও ঠিক ঘরে একে অপরকে সহযোগিতা করে ত্বক চুলের যত্ন নেওয়ার ধারা টিকে আছে পরিবারগুলোয়। আর এই ধারা চলছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। নানির কাছ থেকে মা, মায়ের কাছ থেকে মেয়ে...