২০০৯ সালের জুন মাসের শুরুর কোনো একটি দিন। আমার ভাই রাসকিন (হাবিবুল্লাহ তালুকদার) স্তন ক্যানসার নিয়ে সচেতনতামূলক কাজ করেন। তিনি একটি টিভি চ্যানেলে এ বিষয়ে অনুষ্ঠান করছিলেন। সন্ধ্যায় বাড়িতে বসে সেই অনুষ্ঠান দেখছিলাম। তাঁর অনুষ্ঠানে স্তন ক্যানসার হলে লক্ষণগুলো সম্পর্কে জানতে পারি। মনে হলো আমার স্তনটা পরীক্ষা করা দরকার। সেই অনুষ্ঠানে যেমন শুনেছিলাম, তেমন করে স্তন পরীক্ষা করতে গিয়ে চাকা অনুভব করলাম। পরদিন দেখলাম, চাকাটি আগের চেয়ে বড় হয়েছে। ভাবলাম, টিউমার হলো কি না। মনে মনে একটু ভয় পাচ্ছিলাম। দেরি না করে পরদিনই ঢাকায় রওনা দিলাম। ক্যানসার হাসপাতালে পরীক্ষা–নিরীক্ষা হলো। সকালে ভাইয়ের বাসায় চা পান করছিলাম, এমন সময় খবরটা এল।
ক্যানসার হয়েছে আমার—সেটি বুঝতে, ধাতস্থ হতে বেশ সময় লাগল। কেমন যে লাগছে, সেটি বোঝানো যাবে না। আমার ভাই, ছেলেমেয়ে ও স্বামী আশ্বস্ত করতে লাগলেন—কিছু হবে না। সবার সামনে চুপচাপ বসে ছিলাম। পরে খুব খারাপ লেগেছে। একা একা কান্না করেছি। বারবার মনে হচ্ছিল, এমন কেন হলো। রাসকিনকে যেহেতু বেশি ভরসা করি, তাঁর পরামর্শমতো চলতে থাকলাম। সব সিদ্ধান্ত তিনি নিলেন। সেই বছরের জুলাই মাসের ৯ বা ১০ তারিখে অপারেশন করলাম। স্তন কেটে ফেলতে হলো। তখন আমার ৪৭ বছরের মতো বয়স। পরিবারের সবাই আমাকে খুব সাহস দিয়েছে। একা যেন থাকতে না হয়, তাই পালাক্রমে আমার সঙ্গে সময় কাটাত। এরপর ২১ দিন পরপর ছয়টি কেমোথেরাপি চলল। কেমোর কিছুদিন পর মাথার চুল পড়তে থাকল। এ এক মহাযুদ্ধ। এরপর ২৫টি রেডিওথেরাপি।
আমার স্বামী সে সময় ভারতে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন চিকিৎসার জন্য। কিন্তু রাসকিন বললেন, এখানেই চিকিৎসা ভালো হবে। চিন্তা করার কিছু নেই। আমাকে বললেন, সিরাজগঞ্জের খাজা এনায়েতপুর হাসপাতালে অত্যাধুনিক যন্ত্র আছে, সেখানে রেডিওথেরাপি দিতে। আমি ও আমার স্বামী সেখানে যেতাম। প্রথমবার গিয়ে দেড় মাস থাকলাম। আমার স্বামী ব্যাংকে কাজ করতেন। প্রতি শুক্র–শনিবার তিনি আসতেন। বাকি সময় অন্য ভাইয়েরা থাকত আমার কাছে। এভাবেই চলছিল। ছেলেমেয়েরা তখন লেখাপড়া করছে। এর মধ্যে ২০১১ সালে আমার স্বামী ব্রেনস্ট্রোক করে মারা যান। যদিও তাঁর স্ট্রোকটা বছরখানেক আগেই হয়েছিল। ক্যানসারের পরপরই স্বামী হারানো—এমন বিপর্যয় কীভাবে সামলেছি এখন ভাবি। ১০ বছর ধরে ছয় মাস পর পর চেকআপ করাই। প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যানসার শনাক্ত হয়েছিল বলে আমি বেঁচে আছি। আর পরিবার পাশে ছিল বলে সব সামলাতে পেরেছি।
অনুলিখিত
লেখক: একজন ক্যানসারজয়ী