>
পরিচ্ছন্ন বাংলাদেশের স্বপ্ন তাদের। এ লক্ষ্য নিয়েই রোজ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বর পরিষ্কার করে দলটি। পরিচ্ছন্নতার বার্তা মানুষের কাছে পৌছাতে সারা দেশে রয়েছে তাদের আরও নানা উদ্যোগ। বিডি ক্লিন নামের সেই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কথা থাকছে এবারের প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে।
রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বর পেরোনোর সময় তাঁদের সঙ্গে দেখা। ২৫-৩০ জনের একটি দল। সবাই তরুণ। কেউ চত্বর ঝাড়ু দিচ্ছেন, কেউবা জমানো ময়লা ব্যাগে ভরছেন। ময়লার ব্যাগ সরিয়ে নেওয়ার কাজও করছেন কয়েকজন। বিশেষ কোনো আয়োজন নয়, নয় কোনো বিশেষ দিন। সে জন্যই পরিচ্ছন্নতার কাজ দেখে একটু খটকা লাগল।
তবে শহীদ মিনার চত্বরের পাশ দিয়ে নিয়মিত যাঁদের যাতায়াত কিংবা এই এলাকায় থাকেন, তাঁদের কাছে দৃশ্যটি চোখ সওয়া। কারণ, তরুণদের দলটি প্রতিদিন বিকেলে সময় মেনে শহীদ মিনার চত্বর পরিষ্কার করে। ২৮ জানুয়ারি কথা হলো তাঁদেরই কয়েকজনের সঙ্গে। জানা গেল, তাঁরা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিডি ক্লিনের সদস্য। তাঁরা শুধু শহীদ মিনার চত্বরই নয়, পরিচ্ছন্নতার বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছেন সারা দেশেই। তাঁদেরই একজন ছন্দা মন্ডল বলেছিলেন, ‘আমরা প্রতিদিন বিকেল চারটা থেকে পরিচ্ছন্নতার কাজ শুরু করি। ভাষাশহীদদের প্রতি সম্মান জানানোর জন্যই আমাদের এই উদ্যোগ।’
ছন্দা মন্ডল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী। শহীদ মিনার পরিচ্ছন্ন রাখার কাজটি তাঁরা ২০১৭ সালের ২২ মে থেকে নিয়মিত করে আসছেন। স্বেচ্ছাসেবকদের আরেকজন কাজী হাসান আল মাহমুদ বললেন, ‘দেশ ও দেশের বাইরে থেকে অনেকে শহীদ মিনারে আসেন। কিন্তু এখানকার পরিবেশ থাকত অপরিচ্ছন্ন। তাই আমরা স্বেচ্ছায় শহীদ মিনারকে পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য কাজ করি।’ কাজী হাসান একজন চাকরিজীবী।
ছন্দা আর হাসানের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমরা শহীদ মিনারের সামনে রাস্তার পাশে চলে আসি। সেখানে ময়লা কুড়িয়ে একটা ঠোঙায় ভরছেন শাম্মী আক্তার। ইডেন মহিলা কলেজে পড়েন তিনি। বলছিলেন, ‘শুধু সচেতনতার অভাবে আমরা জুতা নিয়ে বেদিতে উঠি। ময়লা ফেলি যত্রতত্র। নিজে সচেতন থাকা এবং আরেকজন মানুষকে সচেতন করা আমার কর্তব্য। আমি আমার কর্তব্যটুকু করছি।’
পরিচ্ছন্নতার উদ্যোগের শুরু
ঘটনাটি ২০১৬ সালের। ঢাকা শহরজুড়ে ময়লা ফেলার ডাস্টবিন বসাল সিটি করপোরেশন। কিন্তু সাধারণ মানুষ সেগুলো ব্যবহার করছে না। ডাস্টবিনের জায়গায় ডাস্টবিন থাকছে, ময়লা ফেলছে তার চারপাশে। ফরিদ উদ্দিনকে মানুষের এই অবহেলা, অসচেতনতা খুবই পীড়া দিল। তিনি ভাবলেন, মানুষকে সচেতন করা উচিত। নির্দিষ্ট স্থানে ময়লা ফেললেই শহরটা সুন্দর হয়। উৎকট গন্ধ থেকে বাঁচে পথচলতি মানুষ। পরিচিত কয়েকজনকে ডাকলেন। শাহবাগে বসে সবাই মিলে বুদ্ধি আঁটলেন দলেবলে কী করা যায়। নিজেরাই হাতে তুলে নিলেন ঝাড়ু। শুরু হলো পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম।
বিডি ক্লিনের প্রধান সমন্বয়ক ফরিদ উদ্দিন ফিরে গেলেন সেদিনটিতে, ‘তারিখটা এখনো মনে আছে, ২০১৬ সালের ২ জুন। আমরা শাহবাগ থেকে কারওয়ান বাজারের সার্ক ফোয়ারা পর্যন্ত রাস্তার পাশের ময়লা পরিষ্কার করেছিলাম।’ সেদিন ‘পরিচ্ছন্নতা শুরু হোক আমার থেকে’ স্লোগান নিয়ে যাত্রা শুরু হওয়া ঢাকা ক্লিন সংগঠনটিই এখনকার বিডি ক্লিন।
৩৮ বছর বয়সী ফরিদ উদ্দিনের পড়াশোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে। এখন একটি অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। ২৮ জানুয়ারি রাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে তাঁর সঙ্গে আলাপ। পরে যোগ দিয়েছিলেন আরও কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক।
চায়ে চুমুক দিয়েই ফরিদ উদ্দিন বললেন, ‘পথ চলতে অনেক অসংগতিই চোখে পড়ে। ছোটবেলা থেকে পরিচ্ছন্ন থাকার বিষয়টি আমি মেনে চলতাম। নিজের ঘরে যখন ময়লা সতর্কতার সঙ্গে ফেলি, কেন তাহলে পথে ময়লা ফেলব? যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ছুড়ে না ফেলে নির্দিষ্ট স্থানে ময়লা ফেলার এই অভ্যাস তৈরির জন্যই আমরা মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করছি।’
এ জন্য তাঁরা কোনো নির্দিষ্ট স্থানে জড়ো হন। সেখানকার ময়লা পরিষ্কার করেন। হাতমাইকে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেন। এই সচেতনতার কাজটি রাজধানী ছাড়াও সংগঠনটি বিডি ক্লিন-বরিশাল, বিডি ক্লিন-ময়মনসিংহ, বিডি ক্লিন-খুলনা, বিডি ক্লিন-গোপালগঞ্জ, বিডি ক্লিন-ফেনী, বিডি ক্লিন-নোয়াখালী, বিডি ক্লিন-টাঙ্গাইল, বিডি ক্লিন-চিটাগাং, বিডি ক্লিন-সিলেট নামে পরিচ্ছন্নতার কাজ করে চলেছে। তাঁরা চেষ্টা করছেন দেশের সব কটি জেলায় স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করতে। ফরিদ উদ্দিন বললেন, ‘ফেসবুকের মাধ্যমে আমাদের সঙ্গে প্রায় সাত হাজার স্বেচ্ছাসেবী সারা দেশে যুক্ত আছেন। পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন।’
এই কাজটি তাঁরা নিজেদের খরচেই করেন। শুরুতে প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার জন্য যে অর্থ ব্যয় হতো, সেটা ফরিদ উদ্দিন নিজেই বহন করতেন। এখন অনেক স্বেচ্ছাসেবী এগিয়ে এসেছেন। কেউ হয়তো ১০০ টি-শার্ট বানিয়ে দিচ্ছেন, কেউবা আনছেন ঝাড়ু। এভাবেই চলেছে এগিয়ে পরিচ্ছন্নতা যাত্রা।
পরিচ্ছন্ন ক্যাম্পাস
সারা দেশে কাজের ধারাবাহিকতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেও পরিচ্ছন্ন ক্যাম্পাস গড়ার উদ্যোগ নিয়েছিল বিডি ক্লিন। ২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর থেকে টানা ১২ সপ্তাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তাঁরা পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম ও সচেতনতার কাজ করেন। পরিচ্ছন্নতা অভিযানের শুরুটা হয়েছিল কলাভবন ও এর আশপাশের এলাকা পরিষ্কার করার মাধ্যমে। এভাবে প্রতি সপ্তাহে এলাকা ভাগ করে নিয়ে পুরো ক্যাম্পাসের ময়লা পরিষ্কার করেন স্বেচ্ছাসেবকেরা।
এই পরিচ্ছন্ন অভিযানের সমাপনী পর্ব ছিল ২৬ জানুয়ারি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের মাঠে একত্র হন বিডি ক্লিনের ১ হাজার ৫০০ স্বেচ্ছাসেবী। সেদিন বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২১টি পয়েন্টে আবার তাঁরা ছড়িয়ে পড়েন ঝাড়ু হাতে। যখন পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পরিচ্ছন্ন হলো, তখন সন্ধ্যা ৬টা ২৫ মিনিট। ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান পরিচ্ছন্ন ক্যাম্পাস ঘোষণা করেন। এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অভিনেতা জাহিদ হাসান। তিনি বললেন, ‘আমি তাঁদের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। এ ধরনের কাজের সঙ্গে সব সময় আছি। আমি বলব দেশ আমার তাই আমাদেরকেই পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।’
এই কাজ তাঁদের অনুপ্রেরণা জোগাবে। বিডি ক্লিনের স্বেচ্ছাসেবকেরা চান সচেতনতার বার্তা নিয়ে সবার কাছে পৌঁছাতে। সবাই নিজের পরিচ্ছন্নতার দায়িত্বটুকু বুঝবে, মানবে। এটাই তো তাঁদের চাওয়া।