পরাজয়েও অপরাজেয় এক ইয়াসমিন

নিজের চেয়ে মাকে নিয়েই বেশি ভাবেন ইয়াসমিন (ডানে)
ছবি: লেখক

সময়ের সঙ্গে প্রত্যাশা বদলায় মানুষের। জীবনের ভিন্ন ভিন্ন বাঁকে নিজের সঙ্গেই কতবার নতুন করে দেখা হয়ে যায়। কিন্তু পোশাকশ্রমিক ইয়াসমিনের সেই ছোটবেলা থেকেই একটা চাওয়া—সে প্রত্যাশা এমন একজনকে নিয়ে, যিনি তাঁকে প্রথম অন্ধকারের ভয়ের অভিজ্ঞতা দিয়েছেন—মা সুস্থ হয়ে যাক। নোয়াখালীর চৌমুহনীর পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া শিশুকন্যাটি যেদিন বইখাতা রেখে এলাকার বিস্কুট কারখানায় কাজে ঢুকেছিলেন, সেদিনও তাঁর প্রত্যাশা ছিল এ–ই। অথচ আশ্চর্য হলেও সত্যি, শৈশব মানেই মাকে নিয়ে আতঙ্কের স্মৃতি ইয়াসমিনের।

মা হাজেরা তাঁকে বেদম পেটাতেন। কখনো ঘরের বাইরে রেখে ভেতর থেকে দরজার ছিটকিনি টেনে দিতেন, কখনো মুখে-পিঠে ক্রমাগত প্রহার। এমনও হয়েছে যে বন্ধ দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে শিশু ইয়াসমিন ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর ঘরের ভেতর খিলখিল করে হাসছেন মা। সে শব্দ উঠানের জমাট অন্ধকারের মতো তাঁর ভয় বাড়িয়েছে। ঠিক তখন হয়তো পাশের বাড়ির জানালার বন্ধ কপাটের চোখ ফাঁকি দিয়ে শিশু ইয়াসমিনের পায়ের কাছে পড়েছে স্ট্যাম্প সাইজের একটু আলো। সেদিকে তাকিয়ে থেকে তখন ভয়কে পরাজিত করেন। ইয়াসমিনের মা হাজেরা মানসিক ভারসাম্যহীন। আগে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতেন। পথের মানুষকে ধরে ধরে রাজ্যের অভিযোগ করতেন। তবে ২০১২ সাল থেকে সাধ্যমতো চিকিৎসা করা হচ্ছে হাজেরা বেগমের।

বিস্কুট কারখানার কাজটা শেষ পর্যন্ত চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি ইয়াসমিনের। আত্মীয়দের আশ্বাসে অসুস্থ মাকে নিয়ে এই ইয়াসমিন চলে আসেন ঢাকায়। ইয়াসমিন বলছিলেন, সাধ্যমতো সবাই চেষ্টা করেছেন পাশে থাকতে, তবে এ নগরজীবনে সবারই তো আয়-ব্যয় একাকার। এরপর শুরু হয় আরেক অধ্যায়। মাসে ৫ হাজার টাকার বিনিময়ে ইয়াসমিন হয়ে যান পোশাকশ্রমিক। এটুকুতেই মা-মেয়ের সব মৌলিক চাহিদার সংস্থান।

রাজধানীর খিলক্ষেত রেলক্রসিং দিয়ে খুব ভোরে দল বেঁধে পার হতেন ইয়াসমিন। কখনো সকালের ট্রেন চলে গেলে হুইসেল বাজিয়ে নামিয়ে দেওয়া হতো পথ আটকানোর লোহার রেলিং। দুই পাশের মাটি থরথর করে কাঁপত। সেখানে দাঁড়িয়ে চোখের পলকে চলে যাওয়া ট্রেনের জানালায় আটকে থাকা যাত্রীদের ক্লান্ত মুখ দেখতেন তিনি। এমন এক ট্রেনেই মাকে নিয়ে চৌমুহনী থেকে ঢাকায় আসা। বছর ঘুরে একটু–আধটু বেতন বাড়ে। সে পয়সায় পোশাকশ্রমিকের নিজের পোশাকে বসে লেইসের ঝুল। ভ্যান থেকে কেনা আরেকটি নতুন পার্স থাকে হাতে। টিনশেডের ভাড়া ঘরে অপেক্ষারত অবুঝ মায়ের জন্য মাঝেমধ্যে শখ করে আধা কেজি আপেল কেনেন ইয়াসমিন। কিন্তু অন্ধকার উঠানে ভয়ে কুঁকড়ে থাকা শিশুর ভাগ্য এত সহজেই সহায় হয় না।

কারখানায় ঝুঁকে কাজ করার সময় মাঝেমধ্যে একটু ব্যথা বুকের ডান পাশে। কখনো অ্যাসিডিটি, কখনো এমনি বলে নিজেকে আশ্বস্ত করতে করতে একসময় আর ছেলেভোলানো কথায় ব্যথা কমে না। অতঃপর বৈদ্য–কবিরাজ–চিকিৎসক মিলে বের করলেন, ডান স্তনে টিউমার বড় হচ্ছে দ্রুত। সুখের আভাস আসার আগেই পুনরায় মেঘের ডামাডোল। এরপর কামাই (অনুপস্থিত) হতে শুরু হলো কারখানায়। এর–তার কাছে চেয়ে অপারেশনের টাকা জোগাড় হলেও এবার হারালেন সেই আট হাজার টাকার চাকরি। ঘরভাড়া বাকি। ঘরের ভেতর মানসিক রোগী মা। এক তরুণীর তখন ঠিক কী করার থাকে!

পরাজয় মেনে নিতে লড়াই শুরু করেননি ইয়াসমিন

কিন্তু ইয়াসমিন এত সহজে পরাজয় মেনে নিতে লড়াই শুরু করেননি। অস্ত্রোপচারের পর যন্ত্রণাক্লিষ্ট শরীরে আবার শুরু করেছেন একটি কাজ। বাড়ি থেকে প্রায় আধা ঘণ্টার পথ হেঁটে মূল সড়কে বাসের জন্য আসতে হয়। ২০ টাকা রিকশা ভাড়া বাঁচে। মহাখালী রেলগেটে নেমে আবার হাঁটেন এক ঘণ্টা, তারপর তাঁর নতুন কাজের জায়গা। রোজ সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত উপস্থিত থাকতে হয় সেখানে। বাড়ি ফিরে আবার চুলায় হাঁড়ি বসাতে হয়। শিশুর মতো মা অপেক্ষা করেন মেয়ের জন্য।

করোনা মহামারির দুঃসময়ে প্রায় এক বছর কর্মহীন থেকেও এ শহরে লড়াই চালিয়েছেন ইয়াসমিন। নতুন কাজটি শুরুর মাস কয়েক পর পুনরায় একই জায়গায় ব্যথা। আবার টিউমার। অস্ত্রোপচার করতে হবে। বিধ্বস্ত ইয়াসমিনকে জিজ্ঞেস করলাম, টিকে থাকার এ লড়াইয়ে সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা কী? অকপটে জানালেন, মায়ের সুস্থ হয়ে ওঠা দেখতে পাওয়া। একজন সুস্থ মা কেমন হতে পারেন, তা ইয়াসমিনের স্মৃতিতে নেই। এক জীবনে নিজের সুস্থতার চেয়ে বেশি প্রত্যাশা মায়ের ভালো থাকা। এবারের অস্ত্রোপচার কবে করাতে পারবেন, তা নিশ্চিত না। তবে তাঁর দুশ্চিন্তা, যে ওষুধ খেয়ে মা সেরে উঠছিলেন, সেটা না বন্ধ হয়ে যায়!

শৈশবে মা তো ঘরের বাইরে বের করে দিতেন। তাহলে মায়ের জন্য এত টান কেন? ইয়াসমিন জানালেন, ‘মা তো বুঝতে পারত না। আমার জন্য কেউ যদি কাঁদে, সে একজনই। বের করে দিয়ে আবার সে–ই টেনে নিত ঘরে। অন্ধকারে হয়তো ভয় পেতাম, কিন্তু ভোরের আলো দেখতাম মায়ের কোলের মধ্যে শুয়ে। হয়তো মানসিক ভারসাম্যহীন আমার মা সেটুকুও তখন বুঝত না, তবে আমার অভিমান থাকত না।’

ইয়াসমিনের নানাবাড়ি আর বাবার বাড়ি এক জমিতে। অন্ধকার উঠানে ভয় পাওয়া শিশুর পায়ের কাছে যে স্ট্যাম্পসমান এক টুকরো আলো পড়ত, সেটা তাঁর বাবার ঘর থেকে আসা। তিনি তখন দ্বিতীয় পরিবারের সন্তানদের নিয়ে নিশ্চিন্ত জীবনের আয়োজনে। তাই সে আলো কোনো দিন দীর্ঘ হয়নি প্রথম সন্তান ইয়াসমিনের জন্য।

মাত্র ২৪ বছর বয়সে দ্বিতীয় দফায় স্তন টিউমারের অপারেশন করতে হবে মেয়েটির। আবার হয়তো হারাতে হবে বর্তমান কাজটি। বিদায় নেওয়ার সময় অনুরোধ করলেন, তাঁর মায়ের সুস্থতার জন্য যেন দোয়া করি। এক জীবনে মায়ের সুস্থ হয়ে ওঠার প্রত্যাশার চেয়ে বেশি কিছুই প্রাপ্তি হতে পারেনি ইয়াসমিনের জন্য।