ঢাকার রাজপথে রিকশার ঘণ্টি টুংটাং করে বাজতে শুরু করে গত শতকের তিরিশের দশকে। সে সময় ধুলা উড়িয়ে পূর্ব বাংলার রাজধানী দাপিয়ে বেড়াত ঘোড়ায় টানা টমটম। চাবুকের সপাং সপাং শব্দে ঘোড়াকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখত কোচোয়ান। রিকশা তখন দর্শকের ভিড় ঠেলে রেসের মাঠে উঁকি দিতে সচেষ্ট এক নাবালক।
কেবল দর্শক হয়েই নয়, ঢাকার রাজপথে অলিখিত রেসে নাম লেখানোর উপায় কী? কীভাবেই–বা ঘোড়াগুলোকে পাঠানো যায় আস্তাবলে? এ প্রশ্নের সমাধানে রিকশামালিকেরা এঁটেছিলেন মোক্ষম এক ফন্দি। সিনেমার ব্যানার আঁকিয়েদের ‘হায়ার’ করে এনে ক্যানভাস হিসেবে তুলে দিয়েছিলেন গোটা রিকশাকেই। প্রতিষ্ঠানের ছায়া না মাড়ানো শিল্পীরা ওই ক্যানভাসের সদ্ব্যবহার করেছিলেন। পীতলরাম সুর, আর কে দাস, আলাউদ্দিন, আলী নুর, দাউদ উস্তাদ প্রমুখ স্বশিক্ষিত শিল্পীর অভিনব নকশায় রিকশা হয়ে ওঠে নজরকাড়া। অচিরেই ত্রিচক্রযানটি হয়ে ওঠে জনপ্রিয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, রিকশাচিত্র আগমনের এটাই ছিল অন্যতম হেতু।
টমটমকে টেক্কা দিয়ে রিকশা টিকে গেলেও রিকশাচিত্র কিন্তু বিলুপ্তির চোখরাঙানি দেখছিল। রিকশার ব্যাক প্লেট বা পৃষ্ঠপাত দখল করে বসেছিল ডিজিটাল প্রিন্ট। মাথায় হাত দিয়ে পাততাড়ি গোটাতে শুরু করেছিলেন আঁকিয়েরা। পৈতৃক পেশায় ইস্তফা দিয়ে কেউ কেউ বেছে নিয়েছেন ভিন্ন পথ। এ নিয়ে কারও বিশেষ মাথাব্যথাও ছিল না। রিকশাচিত্র যে কতটা মৌলিক এবং অভিনব, তা হয়তো ভেবে দেখার প্রয়োজন বোধ করিনি আমরা! তবে নানান বাঁকবদলে রিকশাচিত্রের দিন ফিরেছে। এই শহুরে লোকশিল্প এখন রাঙাচ্ছে জীবনযাপনের নানান ক্যানভাস।
বাসনকোসনের মতো ক্যানভাসের কথাই ধরা যাক। খাবারের টেবিলে বসলে বাসনে এত দিন কেবল জাপানি, চীনা কিংবা ব্রিটিশ নকশাই নজর কাড়ত। সম্প্রতি ওসব কুলীন নকশার পাশাপাশি চোখ ধাঁধাচ্ছে আমাদের রিকশাচিত্র। আমরা এখন সকালে চায়ের কাপে দেখি লোকজ মোটিফ। দুপুরে রোদচশমা ঝলমল করে মৌলিক রঙে। রাতে গা এলিয়ে দিই মোটা ব্রাশের স্ট্রোকে বর্ণিল বিছানার চাদরে। আর এসব লোকজ মোটিফ, মৌলিক রং এবং মোটা ব্রাশের স্ট্রোক রিকশাচিত্রেরই দান।
রিকশাচিত্র কেবল বাসনকোসন, পোশাক–আশাক, আসবাব কিংবা ঘরের দেয়ালে আটকে নেই। জায়গা করে নিয়েছে বনানীর রেস্তোরাঁ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র–শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) টংদোকানে। মডেল–অভিনেত্রী শিরিন শিলার উদ্যোগে টংদোকানগুলোকে সম্প্রতি রিকশাচিত্রে রাঙিয়েছেন পুরান ঢাকার শিল্পী হানিফ পাপ্পু। তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছিল ২০১৯ সালে। শুনিয়েছিলেন তাঁর জীবনের ক্যানভাস বদলের গল্প। শৈশবেই সিনেমার ব্যানার আঁকাআঁকিতে হাতেখড়ি। কৈশোরেই তা হয়ে ওঠে পেশা।
২০০২ সালের দিকে হোঁচট। ডিজিটাল প্রিন্ট তখন সহজলভ্য। হানিফ পাপ্পু বাধ্য হয়েছিলেন রং–তুলি বাক্সবন্দী করতে। বছর দশেকের মধ্যে দেশি–বিদেশি শিল্পরসিকদের কাছে বাড়তে থাকে রিকশাচিত্রের কদর। শিল্পবোদ্ধা এবং গণমাধ্যমও রিকশাচিত্রকে দেয় ‘শহুরে লোকশিল্প’র মর্যাদা। হানিফ পাপ্পুর মতো অনেক শিল্পী আবার বাক্স খুলে বের করে আনেন জমাটবাঁধা অ্যাক্রিলিক রং আর খড়খড়ে মোটা ব্রাশ। শুরু হয় রিকশাচিত্রের নতুন যাত্রা। রিকশাচিত্রীদের সঙ্গে নতুন এই যাত্রায় যুক্ত হন মূলধারার শিল্পীরাও। তরুণ শিল্পীদের উদ্যোগ, পণ্য নির্মাতাদের আগ্রহ এবং নতুন প্রজন্মের ভালোবাসায় নতুন প্রাণ পায় রিকশাচিত্র। মূলধারার কোনো কোনো চিত্রশিল্পী রিকশাচিত্রে খুঁজে পান অনুপ্রেরণা।
১৯৫০–এর মাঝামাঝি ও শেষভাগে ইউরোপ–আমেরিকায় পপ আর্টের যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তার সঙ্গে আমাদের রিকশাচিত্রের এই পুনরুত্থানের একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে পপ আর্ট আন্দোলনের গোড়াপত্তন হয়েছিল মূলত বনিয়াদি চিত্রকলার দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার জন্য। স্কটল্যান্ডের এদুয়ার্দো পাওলোজ্জি, ব্রিটেনের রিচার্ড হ্যামিল্টন, যুক্তরাষ্ট্রের ল্যারি রিভার্স, রে জনসন, রবার্ট রাউসেনবার্গ ও জ্যাসপার জোনসের মতো চিত্রশিল্পীরা চেয়েছিলেন, চিত্রকর্ম কেবল অভিজাতের নয়, হওয়া চাই সাধারণের জন্যও। তাই তাঁরা চিত্রকর্মে তুলে এনেছিলেন গণমানুষের সংস্কৃতি এবং জীবনযাপনের অনুষঙ্গ।
পপ আর্টের ‘পোস্টারবয়’ অ্যান্ডি ওয়ারহলের কথাই ধরা যাক। ১৯৬২ সালে লস অ্যাঞ্জেলেসের ফেরাস গ্যালারিতে প্রথম একক চিত্রকর্ম প্রদর্শনীর আয়োজন করেন এই মার্কিন শিল্পী। প্রদর্শনীর ৩২টি স্ক্রিনপ্রিন্টের বিষয় ছিল একই—ক্যাম্পবেলস ব্র্যান্ডের স্যুপের কৌটা! প্রদর্শনীটি সে সময় সাড়া জাগাতে পারেনি। বোদ্ধারা স্যুপের কৌটার ‘ছবি’গুলোকে চিত্রকর্মের তকমা দিতে নারাজ। মজার ব্যাপার হলো, ওই স্যুপের কৌটার ছবিগুলোই এখন চিত্রকর্ম হিসেবে তুমুল প্রশংসিত। খোদ নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট (মোমা) চিত্রকর্মগুলো কিনে নিয়েছে ১ কোটি ৫০ লাখ ডলারে! পপ আর্টের বেলায় এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি।
মার্কিন মুলুকের স্ক্রিনপ্রিন্টে আঁকা স্যুপের কৌটা আর আমাদের রিকশায় আঁকা ফুল–লতাপাতার মিলটা এখানেই। দুটোই সাধারণের রং, রেখা ও বিষয়–আশয়ের চিত্রকর্ম, দিন শেষে, যা অসাধারণ। মানুষ রিকশাচিত্রকে অন্তরে ঠাঁই দিয়েছে, তাই শোভা পাচ্ছে অন্দরে। আর এ কারণেই রিকশাচিত্রের সঙ্গে ভস্ম থেকে জেগে ওঠা ফিনিক্স পাখির কী অদ্ভুত মিল!