ফেসবুকের খাদ্যবিষয়ক গ্রুপগুলোয় খাবারের ছবি দেখতে দেখতে চোখে জল এসে যায় জিভের পরিবর্তে। সবাই এখন স্বাস্থ্য সচেতন, কম চর্বি, কম শর্করাযুক্ত খাবারের ছবির ছড়াছড়ি সে গ্রুপগুলোতে।
মজার বিষয়ই বটে। বেশ কিছুদিন থেকে শোনা যাচ্ছে, তেল–মসলা কম, কিছুটা সেদ্ধ সেদ্ধ— এই হবে আধুনিক খাবারের বৈশিষ্ট্য। আশির দশকের শেষের সময়গুলোতে বা নব্বইয়ের দশকে আমাদের বাল্য বা কৈশোরে কখনো অসুখে ভুগলে এমন তেল–মসলা কম, কিছুটা সেদ্ধ সেদ্ধ স্বাস্থ্যবান্ধব খাবার দেওয়া হতো। সেসব খাবারের মধ্যে ছিল তেল–মসলা কম দিয়ে শিং-মাগুর মাছের টলটলে ঝোল, কচি মুরগির ঝোল, গন্ধভাদই পাতার ঝোল, সেদ্ধ সবজি, কাঁচা গাজর-পেঁপে ইত্যাদি। আমরা বিপুল অনাগ্রহে সেসব খাবার খেতাম। কতটা কী হতো সে বোঝা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবে সেটাই ছিল ডাক্তারের পরামর্শ। একদিকে চলত ওষুধ আর অন্যদিকে এসব পথ্য। ওষুধ নাকি পথ্য, ঠিক কোনটার কার্যকারিতায় রোগী সেরে উঠত, সেটা বলা মুশকিল। প্রায় সাড়ে তিন দশক পর যখন এই রোগীর পথ্যজাতীয় খাবার আমাদের জীবন যাপনের অংশ হয়ে গেল, তখন একটু ভাবনাতেই পড়ে গেলাম প্রথমে যে বেশির ভাগ মানুষ কি অসুখে ভুগছেন! একটু তত্ত্বতালাশ করে দেখা গেল, এটাই এখনকার ট্রেন্ড। রোগী না হয়েও রোগীর পথ্যে জীবন এখন তরতাজা, লাবণ্যময় হয়ে উঠছে বলেই শোনা যাচ্ছে।
লক্ষণ ভালো, স্বাস্থ্য সুরক্ষা প্রয়োজন। গত দুই দশকে ইন্টারনেটের বদৌলতে তথ্যভান্ডার আমাদের হাতের মুঠোয় এসেছে। এর ফলে জীবনযাপন প্রক্রিয়ার প্রধান অনুষঙ্গ খাদ্য নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে ব্যাপকভাবে। এই বদলের অনেকগুলো বাঁক আছে। ‘রোগীর পথ্যজাতীয়’ স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার অভ্যাস তৈরি করা তার একটা। ইউটিউব বা বিভিন্ন ভিডিও দেখে সেগুলো রান্না করাও একটা বাঁক। দুটোই হচ্ছে সমানতালে। এখন আমাদের দৈনন্দিন যে রুটিন, যে অভ্যাস তার সঙ্গে আমাদের ‘আধুনিক’ জীবনযাপনের বিভিন্ন অনুষঙ্গের যে বিপুল অপ্রতুলতা, তাতে খাবার স্বাস্থ্যকর না হলে চলবে না। সে ব্যাপারে আমাদের অনুশীলন শুরু হয়ে গেছে।
স্বাস্থ্যকর খাবারের সঙ্গে মসলা, তেল এসব ব্যবহারেও ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে। জনপ্রিয় হচ্ছে হার্বস, বিভিন্ন ধরনের সালাদ, সামুদ্রিক খাবার। ব্যবহার বেড়েছে জলপাই-সূর্যমুখী তেল কিংবা রাইসব্যান অয়েলের। বাড়ির খাবারে তেল-মসলা-ঝালের ব্যবহারে এখন পরিমিতিবোধ চোখে পড়ার মতো।
গত এক দশক বা তারও কিছু বেশি সময় ধরে অরগানিক ফুডের চর্চা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে আমাদের শহরে। গলির মোড়েও চোখে পড়ে অরগানিক ফুডের দোকান। রাসায়নিক সার-কীটনাশকমুক্ত শাকসবজি, দেশি ফল, দুধ, মাছ-মাংস, ডিম, মসলা ইত্যাদি পাওয়া যায় সেসব দোকানে। বিশেষ করে শিশুদের নিরাপদ রাখতে মা-বাবারা কিনছেন সেসব। খানা–খাদ্যের ব্যাপারে এই প্রবণতা অত্যন্ত ইতিবাচক।
ওষুধের সঙ্গে পথ্য না খেলে অসুখ সারে না— এটা আমাদের প্রাচীন বিশ্বাস। সেই পথ্য বা পথ্যের মতো খাবার যখন জীবনযাপনের ট্রেন্ড হয়ে যায়, তখন স্বাস্থ্যকর জীবনের অনুভব এমনিই চলে আসে।