‘আপনার জীবনের লক্ষ্য কী? নিজ দেশ ছেড়ে এত দূর পড়তে এলেন...পড়ালেখা শেষে দেশে ফিরে কী করবেন?’ প্রশ্ন শুনে লাক্সমি রায়ের কপালে ভাঁজ পড়ল। বাড়ি নেপালে। পড়ছেন পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পবিপ্রবি) কৃষি বিভাগের চতুর্থ বর্ষে। লাক্সমি ভেবে বললেন, ‘আমি আসলে লক্ষ্যটা এখনো ঠিক করতে পারিনি। লক্ষ্য ঠিক করার জন্য চার বছর সময় আমার কাছে খুব কম মনে হয়।’ একেবারেই অকপট জবাব। বাংলাদেশে পড়তে এসে শুরুতে লাক্সমিকে বেশ ভুগতে হয়েছে। ভাষা বুঝতেন না। ক্লাসে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতেন, আর হলের ডাইনিংয়ে খাবারের ঝালে নাস্তানাবুদ হয়ে চোখের পানি ফেলতেন। সেই লাক্সমি রায়ই কিন্তু এখন তাঁর বিভাগের ‘ফার্স্ট গার্ল’! কথা বলেন পরিষ্কার বাংলায়।
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আমরা ঘুরে দেখছিলাম ১৬ জুলাই। বিশ্ববিদ্যালয়টির দুটি ক্যাম্পাস। একটি পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলায়, অন্যটি বরিশালে। বরিশাল ক্যাম্পাসে মূলত ভেটেরিনারি–সংক্রান্ত বিষয়গুলো পড়ানো হয়। আর পটুয়াখালীতে আছে কৃষি, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, বিবিএসহ বেশ কয়েকটি বিষয়ে পড়ার সুযোগ। প্রায় ৩ হাজার ৪০০ শিক্ষার্থীর জন্য এখানে ৮টি হল আছে। ৫টি ছেলেদের, ৩টি মেয়েদের।
বেশ বড় ক্যাম্পাস। এমাথা থেকে ওমাথা যেতে যেতে হেডফোনে দুটি গান শুনে ফেলা যায়। ‘গাইড’ হিসেবে আমাদেরকে পবিপ্রবি ঘুরে দেখাচ্ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষার্থী রেজাউল ইসলাম, মাহদী আল হাসান, প্রতিমা দাস, জাহেদা আক্তার সহ আরও অনেকে। তাঁদের সঙ্গে ক্যাম্পাসের আনাচকানাচ ঘুরে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে, ক্যানটিন আর হলের ডাইনিংয়ে খেয়েদেয়ে দিনটা দ্রুতই ফুরিয়ে গেল।
অন্য পরিবার
পবিপ্রবিতে বেশ কয়েকটি পুকুর আছে। নামগুলো সুন্দর—লালকমল, নীলকমল, তরঙ্গতনু। নীলকমলের ওপরেই একটা সুন্দর সেতু। অন্যদিকে লালকমল আর খেলার মাঠের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে ছায়াঢাকা রাস্তা, ছাত্রছাত্রীরা বলেন ‘প্যারিস রোড’।
ক্যাম্পাসের ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তনের সামনে দিয়ে একটু এগোতেই একটা তিন রাস্তার মোড়। মাহদী আল হাসান পরিচয় করিয়ে দিলেন, ‘এই মোড়টাকে আমরা বলি বিচ্ছেদ পয়েন্ট।’ কেন? মাহদী মজার একটা ব্যাখ্যা দিলেন, ‘বাঁ দিকের রাস্তা দিয়ে গেলে ছেলেদের হল। আর ডান দিক দিয়ে গেলে মেয়েদের হল। সারা দিনের ক্লাস-আড্ডা শেষে সন্ধ্যার আগে যখন যে যার হলে ফেরে, তখন এখানেই ক্যাম্পাসের জুটিরা একে অন্যকে বিদায় দেয়। সে জন্য এই মোড়টার নাম বিচ্ছেদ পয়েন্ট।’
পবিপ্রবির ক্যাম্পাস মূল শহর থেকে একটু দূরে। প্রতিদিন পটুয়াখালী শহর আর বরিশাল থেকে বাস আসে। তবে অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের হলেই থাকেন। এখানে সবাই সবার চেনা। কৃষি, প্রকৌশল, ব্যবসায় শিক্ষা, একেক বিষয়ে পড়লেও ছাত্রছাত্রী-শিক্ষক—সবাই মিলে একটা বড় পরিবার। বিভিন্ন উৎসব-আয়োজন তাঁরা উদ্যাপন করেন একটি পরিবারের মতোই। পয়লা বৈশাখে যেমন দিনভর নানা রকম অনুষ্ঠান শেষে রাত ১১টায় শুরু হয় যাত্রা। এ বছর পয়লা বৈশাখে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মিলে আয়োজন করেছিলেন যাত্রাপালা—কমলার বনবাস। আশপাশের এলাকা থেকে লোকজন দলে দলে এসেছেন যাত্রাপালা উপভোগ করতে, সে এক বিরাট মহাযজ্ঞ!
নেই সেশনজট
হুট করে পবিপ্রবির ক্যাম্পাসে হাজির হয়ে গেলে আপনি ছাত্রছাত্রীদের দেখা খুব একটা পাবেন না। একেক বিভাগের ক্লাস হয় একেক দিকে। ক্লাস, ব্যবহারিক ক্লাস, পরীক্ষা, অ্যাসাইনমেন্ট...একটার পর একটা চলতেই থাকে। ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ নেই।
তাই আড্ডা জমে মূলত রাতে, হলের ছাদে বা বারান্দায়। কৃষি বিভাগের ছাত্র রেজাউল ইসলাম বলছিলেন, ‘সবচেয়ে মজা হয় ফুটবল বা ক্রিকেট বিশ্বকাপের সময়। একেকটা হলে এত বেশি চেঁচামেচি হয়, এই আনন্দে শামিল না হয়ে আপনি পারবেন না। আফসোস, হলজীবনে আমাদের একটার বেশি বিশ্বকাপ দেখার সুযোগ হয় না।’
বিশ্বকাপ আসে চার বছর পরপর। পবিপ্রবিতেও শিক্ষার্থীদের স্নাতক শেষ হয় চার বছরে। রাজনৈতিক হট্টগোল, মিছিল, আন্দোলন তেমন নেই। পরীক্ষা হয় একদম সময়মতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. হারুনর রশীদ মনে করেন, এটিই বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা। তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে কোনো সেশনজট নেই। পড়ালেখার ক্ষেত্রে আমরা আধুনিক প্রযুক্তি, গবেষণার দিকে বেশি জোর দিই।’ ক্যাম্পাস ঘুরে মো. হারুনর রশীদের কথার প্রমাণ পাওয়া গেল। বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্মপ্লাজম সেন্টারে চোখে পড়ল বেশ কয়েকটি নতুন জাতের ফল, যা উদ্ভাবন করেছেন এখানকার গবেষকেরা। এখান থেকে বেরিয়ে ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরেও পাড়ি জমিয়েছেন অনেকে।