বরেণ্য শিল্পী নিতুন কুন্ডুর প্রয়াণ দিবস আজ। ২০০৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ২০১১ সালে শিল্পীর মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রথম আলোর পাতায় এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল। এখানে তা পুনঃপ্রকাশ করা হলো।
পরম, তোমার পরম সৌভাগ্য, তুমি শিল্পী নিতুন কুন্ডুর নাতি। যত বড় হবে, ততই তোমার গর্ব হবে এই জেনে যে তুমি এ দেশের একজন মেধাবী, পরিশ্রমী, সৃজনশীল ‘সেলফ মেইড’ মানুষের উত্তর-প্রজন্ম।
যে মানুষটি আর্ট স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য ১০ টাকা পকেটে নিয়ে গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে দিনাজপুর থেকে ঢাকায় এসেছিলেন। জীবনধারণের জন্য সিনেমার ব্যানার এঁকেছেন প্রতি বর্গফুট এক আনায়। সেই মানুষটিই ছাত্রজীবনে হলেন প্রথম শ্রেণিতে প্রথম। আর সেই মানুষটিই হলেন ‘অটবি’র প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর মেধায়, তাঁর মমতায় অটবি শুধু একটু একটু করে বড়ই হয়নি, হয়েছে বিশাল। নিতুন কুন্ডু স্মারকগ্রন্থ শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী লিখেছেন, ‘একজন শিল্পী যতই বাণিজ্যিক সফলতা অর্জন করুক, তার মধ্যে নান্দনিকতার ছাপ অবশ্যি থাকবে। নিতুনের প্রতিষ্ঠান সেই নান্দনিকতা দিয়ে একটা রুচি গড়ে দিয়েছে।’
২০০৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর সকালবেলায় বারডেমের কার্ডিয়াক ইউনিটের সামনে। নিতুন কুন্ডু চলে যাওয়ার খবর পেয়ে শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিকসহ অটবিতে কর্মরত শত শত মানুষের ঢল আর চোখের জল দেখে বুঝতে অসুবিধা হয়নি, নিতুন কুন্ডু বেঁচে থাকবেন তাঁর সৃষ্টি আর কাজের মধ্যেই। নাটকের সেট থেকে একুশের সংকলন, মেডেল-ট্রফি, প্যাভিলিয়ন থেকে আসবাব-নকশা, লোগো থেকে চিত্রকলা—কোথায় নেই তিনি?
এই তো সেদিন, ঢাকায় এলেন ভারতের (সাবেক) প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং। রাষ্ট্রীয় অতিথির আগমনে ঢাকার সোনারগাঁও হোটেলের সামনে অবস্থিত সার্ক ফোয়ারায় দেখা গেল আলোর ঝিলিক আর পানির নাচন। পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম; বারবার কাকুর (নিতুন কুন্ডুকে ‘কাকু’ ডাকতাম) কথা মনে হচ্ছিল। এই ফোয়ারা যখন তিনি তৈরি করেন, তখন এক দিন বেশ রাতে গেলাম কাকুর কর্মযজ্ঞ দেখতে। ঘুরে ঘুরে তিনি দেখাচ্ছিলেন আর বোঝাচ্ছিলেন তাঁর কাজের বিস্তৃতি। তা দেখে যে কারও মনে প্রশ্ন জাগবে—মানুষটা কি আসলে চারুকলার শিল্পী, নাকি স্থপতি! নাকি প্রকৌশলী! এই কাজ করতে গিয়েই তাঁর হার্ট অ্যাটাক হয়। কিন্তু অসম্ভব প্রাণশক্তির মানুষটি সুস্থ হয়ে আবার ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন কাজে। যে মানুষটি মুক্তিযুদ্ধের সময় পোস্টার এঁকে মনে সাহস জাগিয়েছিলেন, ‘সদা জাগ্রত বাংলার মুক্তিবাহিনী’। স্বাধীন দেশে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক হিসেবে সে মানুষটির সৃষ্টি থাকবে না, তা কি হয়? রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সাবাস বাংলাদেশ’ তাই ভাস্কর নিতুন কুন্ডুর সৃষ্টিনিদর্শন।
নিতুন কুন্ডুর দুই সন্তান। অমিতি কুন্ডু ও অনিমেষ কুন্ডু। কন্যা অমিতির সন্তান পরম। পরমের সৌভাগ্যের কথা বলেছিলাম শুরুতেই। তবে পরমের জন্য বড় ‘না পাওয়া’ হয়ে থাকল দাদুর আদর। শিশুদের অসম্ভব ভালোবাসতেন। সেই ভালোবাসার যে কী টান আর কী শক্তি, তা বুঝতে পারে শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তীর দুই সন্তান গৌতম ও রুশো। কাকুময় শৈশব তাদের। নিতুন কুন্ডু স্মারকগ্রন্থ গৌতম লিখেছিল, ‘নিতুন কুন্ডুকে আমি এবং রুশো আবাল্য “কাকু” বলে ডেকেছি। এর কোনো দ্বিতীয় সংস্করণ আমার জীবনে নেই।’
আসলেই নিতুন কুন্ডুর দ্বিতীয় সংস্করণ হওয়া কঠিন। সৃজনশীল কর্মী এই মানুষটির জীবন-অভিধানে ‘ইমপসিবল’ বলে কোনো শব্দ ছিল না। কাকুর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললেই কর্মশক্তি বেড়ে যেত।
পাঁচ বছর (২০০৬ সাল) আগে বারডেম হাসপাতালের কার্ডিয়াক ইউনিটে অনেকেই জড়ো হয়েছিলেন, কারও নিতুন, কারও বা নিতুনদা...। সবাই বিমর্ষ। একটা ম্যাজিকের অপেক্ষায় যেন। যদি সব আগের মতো হয়ে যেত! যদি মেদহীন শরীরটা নিয়ে বিছানা থেকে উঠে পড়তেন! চেইন লাগানো বন্ধ কালো জুতাটা পায়ে গলিয়ে যদি এখনই ছুটে যেতেন শ্যামপুরের কারখানায়!
সবাই অপেক্ষা করছেন। সিঙ্গাপুর থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স আসতে দেরি হচ্ছে। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী বলেছিলেন, ‘এই অপেক্ষা নিতুন মানত না। বলত, এয়ার অ্যাম্বুলেন্স? কী আর এমন হাতি-ঘোড়া? একে ডাক, ওকে ডাক, একটা এয়ার অ্যাম্বুলেন্সই বানাব...।’
ইশ্! কাকু যদি আরও কয়েকটা বছর থাকতেন!