দুই বছর আগের কথা। মা-বাবা গল্প করছেন মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে। আড়াল থেকে এই গল্প শুনে ফেলে শিশু সামিয়ারা খাতুন। তখন সে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। নিজের বিয়ের কথা শুনে ফেলেছে—বিষয়টি সে বাড়ির কাউকেই বুঝতে দেয়নি। ছুটে গিয়েছে বিদ্যালয়ে। সব শুনে তার সহপাঠীরা বিয়ে বন্ধের অভিযানে নামে। তারা সফল হয়। এই গল্প এখন বিদ্যালয়ের সব মেয়েকে সাহস জোগায়। ইতিমধ্যে তারা আরও কিছু করেছে।
সামিয়ারার বাড়ি রাজশাহীর পবা উপজেলার চর তারানগর গ্রামে। তার বাবার নাম আবদুস সামাদ। মায়ের নাম সখেনা বেগম। পড়ে চর খিদিরপুর নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে।
তারানগর গ্রামে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। পাশের গ্রাম চর খিদিরপুরে রয়েছে আরেকটি। কিন্তু মাধ্যমিক শ্রেণীতে পড়ার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। সে জন্য পঞ্চম শ্রেণী পাস করার পরই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। এলাকায় এটাই নিয়ম হয়ে গিয়েছিল। কয়েক বছর আগে ‘বঞ্চিতি বদল’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন চর খিদিরপুর গ্রামে একটি নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় চালু করেছে। সংগঠনের সদস্যরা গ্রামের মেয়েদের বিয়ে না দিয়ে বিদ্যালয়ে পাঠানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করেন।
বঞ্চিতি বদলের পরিচালক মুরাদুজ্জামান বলেন, এত প্রচার-প্রচারণা চালানোর পরও ষষ্ঠ শ্রেণীর একজন ছাত্রীর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে—ফোন করে বিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী তাঁকে জানায়। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা সীমা খাতুনকে ফোন করে এ বিষয়ে একটি পরামর্শ দেন। তাঁর কথামতো সীমা খাতুন বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীকে নিয়ে সামিয়ারার বাড়ি উপস্থিত হন। শিক্ষার্থীরা সামিয়ারার বাবাকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরে। তারা তাঁকে বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর দিক বোঝায়। তিনি বুঝতেই চান না। তারপর তারা বোঝানোর চেষ্টা করে মেয়ে লেখাপড়া শিখলে তার কী সম্ভাবনা রয়েছে। তাদের পরিবারে জমির কাগজ পড়ার মতো কোনো মানুষ নেই। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র পড়ে দেওয়ার মতোও কেউ নেই। মেয়েটা শিক্ষিত হলে এই সমস্যা থেকে তাঁকে রক্ষা করতে পারবে। কেউ তাঁকে বোকা বানিয়ে জমি লিখে নিতে পারবে না।
আবদুস সামাদ বলেন, মেয়ের বয়স বেশি হলে পাত্র পাওয়া যাবে না। শিক্ষার্থীরা তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করে, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মেয়ের যোগ্যতাও বাড়বে। তখন হয়তো রাখাল পাত্র পাওয়া না গেলেও একজন যোগ্য পাত্র পাওয়া যাবে।
একপর্যায়ে আবদুস সামাদ মেয়ের বিয়ের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে রাজি হন। তবে তিনি শর্ত দেন, ছেলের বাবা যদি আপত্তি না করেন, তাহলে তিনি এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেবেন। সীমা খাতুন সামিয়ারার সহপাঠীদের নিয়ে ছোটেন ছেলের বাড়িতে। তাঁর বাড়িও একই গ্রামে। সেখানে গিয়ে শিক্ষার্থীরা একইভাবে ছেলের বাবাকে চেপে ধরেন। অবশেষে তিনিও সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন।
সামিয়ারা এখন চর খিদিরপুর বিদ্যালয়ে পড়ছে। এখন তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে একটা বাল্যবিবাহের ঝড় তার ওপর দিয়ে গেছে। সামিয়ারাও বিষয়টি প্রায় ভুলে গেছে।
কিন্তু সামিয়ারার বাবার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তিনি মেয়েকে নিয়ে এখনো চিন্তায় রয়েছেন। কারণ, তাঁর নয় বিঘা জমি ছিল। নিজের জমিতে চাষবাস করেই তাঁর সংসার চলত। কিন্তু পদ্মার ভাঙনে এখন তাঁর জমি দুই বিঘার নিচে নেমে এসেছে। জমি ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মনোবলও প্রায় ভেঙে পড়েছে। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ওই গ্রামে গিয়ে তাঁকে অন্যের জমিতে কাজ করতে দেখা যায়। তিনি বলেন, এভাবে তিনি আর পেরে উঠছেন না। তাঁর আরও ছোট দুটি মেয়ে রয়েছে। একটা তৃতীয় ও একটি শিশু শ্রেণীতে পড়ে। ছেলেটা এখনো বিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করেনি। তাঁর কথা হচ্ছে, বড় মেয়েটা তো একটু কিছু শিখল। এখন ছোটদেরও তো কিছু শেখাতে হবে। আস্তে আস্তে খরচ বাড়বে। অন্যের জমিতে কাজ করে বাড়তি খরচ আর মেটাতে পারবেন না। তখন বড়টাকে হয়তো আর ধরে রাখতে পারবেন না।
তবে সামিয়ারার সাহস দেখে বিদ্যালয়ের অন্য মেয়েরাও এখন সচেতন হয়েছে। ২৭ ফেব্রুয়ারি সামিয়ারার মতো করেই তারা তাদের আরেক সহপাঠীর বাল্যবিবাহ ঠেকিয়ে দিয়েছে। মেয়েটির নাম রানু পাখি। সে বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। তারা রানু পাখির বাবাকে বোঝাতে সমর্থ না হয়ে এবার বঞ্চিতি বদলের পরিচালককে ডেকে নিয়ে যায়। রানুর বাবা যখন কিছুতেই বুঝতে চাইছেন না, মুরাদুজ্জামান তখন ষষ্ঠ শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ে ছাপা ‘রোজিনার জীবনে অন্য রকম পাওয়া’ শীর্ষক প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদন পড়ে শোনান। এতে কাজ হয়। রানুর বাবা মহির উদ্দিন রাজি হয়ে যান। সামিয়ারার পথ ধরে আরও একজন শিশু বাল্যবিবাহের হাত থেকে রক্ষা পায়।