সময় নাকি সবকিছুর ওপরই প্রলেপ বুলিয়ে দেয়। তাহলে আমার ক্ষেত্রে উল্টোটা হচ্ছে কেন! যত সময় যাচ্ছে, আরও বেশি ঝাঁপিয়ে পড়ছে ভয়াল সেই শুক্রবারের স্মৃতি। যেদিন মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। আমার চেয়ে অনেক বেশি কাছ থেকে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা।
সাদা চামড়ার মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের মোহে আচ্ছন্ন এক অস্ট্রেলিয়ানের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ একটা দুপুরেই কেড়ে নিয়েছে ৫০ জন মানুষের প্রাণ। মনকে বিকল করে দেওয়ার জন্য এটিই যথেষ্ট। সারা বিশ্বের সুস্থ, স্বাভাবিক সব মানুষই তো এই অনুভূতিতে আচ্ছন্ন। কিন্তু আমার কাছে যে এখানেই সেটির শেষ নয়। সর্বজনীন এই অনুভূতির সঙ্গে যোগ হচ্ছে ভয়াবহ এক কল্পনা—আরও কত কী–ই না হতে পারত!
মনকে যতই বোঝাচ্ছি, যা হয়নি, কী দরকার তা নিয়ে ভাবার; কোনো কাজ হচ্ছে না। মনে বাসা বাঁধা দুঃস্বপ্নটাকে তাড়াতে পারছি না কিছুতেই। ঘুরেফিরে বারবারই শুধু মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের জন্য কেমন চিরকালীন এক দুঃস্বপ্ন হয়ে যেতে পারত ক্রাইস্টচার্চে শুক্রবারের সেই দুপুর! মাত্র কয়েক মিনিটের এদিক–ওদিকই তো! সংবাদ সম্মেলনে আসতে যদি একটু দেরি না করতেন অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ, সেটিতে যদি একটি–দুটি প্রশ্ন কম হতো, যদি সংবাদ সম্মেলন শেষে ড্রেসিংরুমে শখের ফুটবল খেলায় আরও দু–তিন মিনিট নষ্ট না হতো…না, যতবার ভাবি, পাগল–পাগল লাগে!
পুরো দেশের মানুষের সঙ্গে এখানে আমার কোনো পার্থক্য নেই। পার্থক্য হয়ে যাচ্ছে একখানেই—ঘটনাচক্রে ঠিক সেই সময়টাতেই রক্তবন্যায় ভেসে যাওয়া আল নুর মসজিদের খুব কাছ থেকে ঘুরে আসা। আমরা তিন সাংবাদিক—ক্রিকইনফোর বাংলাদেশ প্রতিনিধি মোহাম্মদ ইসাম, ডেইলি স্টার–এর মাজহারউদ্দিন আর আমি তামিমের ভয়ার্ত বিপন্ন কণ্ঠ শুনে পরিণতি কী হতে পারে, তা না ভেবেই ছুটে গেছি ওই মসজিদের দিকে। যেখানে তখন চলছে নারকীয় এক হত্যাযজ্ঞ। একজন, শুধুই একজন ব্যক্তির ব্যাখ্যাহীন নিষ্ঠুরতায় ইতিহাসের নারকীয়তম হত্যাযজ্ঞও কি!
আমরা তিনজন যখন সেদিকেই ছুটে যাচ্ছি, তখন তো সেটি আমাদের কল্পনাতেও নেই। আমরা জানিও না, আমরা যেদিকে যাচ্ছি, সেই রাস্তা দিয়েই একটু আগে আল নুর মসজিদ থেকে লিনউড মসজিদের দিকে ছুটে গেছে ঘাতকের গাড়ি। আর কয়েক মিনিট আগে হলেই আমরা যার মুখোমুখি হয়ে যেতাম! গায়ের রংই যেখানে একমাত্র বিবেচনা, বুলেটের ‘সদ্ব্যবহার’ আমাদের গায়েও হতো!
ইসাম এগিয়ে যাচ্ছে, একটু পেছনে মাজহার, পিছু পিছু আমি। কেউই জানি না, যেখানে যাচ্ছি, সেখানে আসলে কী হচ্ছে। তবে আভাস তো পাচ্ছিই। মসজিদের দিকে এগোতে এগোতে রাস্তায় পুলিশের গাড়ি দেখছি, অ্যাম্বুলেন্স, পাশেই একটা মৃতদেহ, উল্টো দিক থেকে রাস্তার মাঝখান দিয়ে হেঁটে আসা রক্তাক্ত এক যুবক, লাইটপোস্টে হেলান দিয়ে মোবাইলে কথা বলতে বলতে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকা রক্তলাল টি–শার্ট পরা এক তরুণ, আর্তনাদের মতো বাজতে থাকা সাইরেন...অথচ আমরা তিনজন ঘোরে পাওয়া মানুষের মতো এগিয়ে চলেছি। মসজিদে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে আর বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা বাসে আটকা পড়ে আছেন মসজিদের সামনে—তামিমের ফোন শুধু এটুকুই জানিয়েছে। বন্দুকধারী একজন না একাধিক, তারা এখনো মসজিদেই আছে না বেরিয়ে এসেছে রাস্তায়, এদিকেই আসছে কি না—কিছুই না জেনে, কিছুই না ভেবে আমরা কোন সাহসে ওভাবে এগিয়ে গিয়েছি, সেটির কোনো ব্যাখ্যা নেই। পৃথিবীতে সবকিছুর ব্যাখ্যা হয়ও না।
সেদিন অনেক রাতে, রুদ্ধশ্বাস এক দিনের পর মোটেলের রুমে যখন একা, তখন হঠাৎই চিন্তাটা জলোচ্ছ্বাসের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল মনে। আমরাও তো লাশ হয়ে যেতে পারতাম! ওপারে ক্রিকেটারদের দেখে রাস্তা পেরিয়ে তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়ে যখন আমরা বিশাল হ্যাগলি পার্কের মাঝখান দিয়ে ত্রস্ত পায়ে হেঁটে পার্কের এক কোনায় হ্যাগলি ওভাল মাঠের দিকে ফিরছি, তখনো তো আমরা সবাই খোলা মাঠে সহজতম টার্গেট। যেকোনো কিছুই তো হতে পারত! পরদিন দেশে ফেরার বিমানে উঠতে উঠতে তামিম ইকবাল যে বললেন, ‘আজ আমরা নয়, দেশে ফিরতে পারত আমাদের মৃতদেহ’—কথাটা তো খুবই সত্যি। যেটি গিয়ে একেবারে বুকে বিঁধে! লিখতে লিখতে আবারও চোখ ভিজে যায়।
ভয়াল সেই শুক্রবারকে যতই মন থেকে মুছে ফেলতে চাই, বারবার সেই দিনটিতেই ফিরে যায় মন। বেলা ১১টার দিকে ক্রাইস্টচার্চের মোটেল থেকে ট্যাক্সিতে মিনিট দশেকের পথ হ্যাগলি ওভালে রওনা হওয়ার সময় তো কল্পনাও করিনি, শান্ত–সুন্দর–নিস্তরঙ্গ এই শহর ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে পরিণত হবে এমন নরকে! মৃতের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে বাড়তে সন্ধ্যা নাগাদ সেটি বিমূঢ় করে দেবে সবাইকে। শুধু ওই নরপিশাচকে ছাড়া।
সেই শুক্রবার টেস্ট ম্যাচের আগের দিন। প্রথামাফিক দুই দলের অধিনায়কের সংবাদ সম্মেলন আর ঐচ্ছিক অনুশীলন—বাংলাদেশের সঙ্গে নিউজিল্যান্ডের সময় পার্থক্যের কারণে যে দিনগুলো খুব ঢিলেঢালা হয়। দুই অধিনায়কের সংবাদ সম্মেলন শেষ হয়ে যাওয়ার পরও দেখা যায়, বাংলাদেশে তখন মাত্রই সকাল হচ্ছে! সকাল থেকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি সেই দিনটিকে আরও শিথিল বানিয়ে দিয়েছে। ঘুম থেকে উঠেই নিউজিল্যান্ডের প্র্যাকটিস বাতিলের খবর জানানো নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের মিডিয়া ম্যানেজারের খুদে বার্তা পেয়েছি। সঙ্গে দুপুর ১২টায় সংবাদ সম্মেলনের ঘোষণা। কিছুক্ষণ পর সেটি দুপুর সাড়ে ১২টায় পিছিয়ে যাওয়ার কথাও। সেই সংবাদ সম্মেলন শেষে নিউজিল্যান্ডের মিডিয়া ম্যানেজারকে অনুরোধ করে না হওয়া সেই টেস্টের অধিনায়ক টিম সাউদির ছোট্ট একটা ইন্টারভিউ করতে পারায় আমার মনে যুদ্ধজয়ের আনন্দ। আরেকটা এক্সক্লুসিভ হয়ে গেল!
সেই আনন্দের অনুভূতিকে সঙ্গী করে দাঁড়িয়ে আছি বাংলাদেশ দলের জন্য। বৃষ্টি ততক্ষণে একটু ধরে এসেছে। মাহমুদউল্লাহর সংবাদ সম্মেলন শুরু হওয়ার কথা বেলা ১টায়। কই, মাহমুদউল্লাহ কই! সময় ঠিক না রাখার জাতিগত বদভ্যাস নিয়ে আলোচনা চলছে। আমরা সাংবাদিকেরা এমনিতেই একটু অসহিষ্ণু। লম্বা ট্যুরের শেষ প্রান্তে বলে সেদিন আরও একটু বেশি। অবশেষে বাংলাদেশ দলের বাস হ্যাগলি ওভালে ঢুকল। তখনই তো ১টা বেজে গেছে।
খবর পেলাম, ড্রেসিংরুমে লাঞ্চ করে তারপরই প্রেস কনফারেন্সে আসবেন মাহমুদউল্লাহ। যা শুনে নিউজিল্যান্ডের চার–পাঁচজন সাংবাদিকের মধ্যে একজন ছাড়া বাকি সবাই চলে গেলেন। যাওয়ার আগে বাংলাদেশ দলের সময় না–মানা নিয়ে প্রকাশ করে গেলেন একটু উষ্মাও। যাতে একটু বিব্রত হয়ে আমি ম্যানেজার খালেদ মাসুদকে ফোন দিয়ে বললাম, ‘নিউজিল্যান্ডাররা খুব সময় মেনে চলে। আপনারা ১টায় প্রেস কনফারেন্সের কথা বললেন, অথচ এখনো খবর নেই।’ খালেদ মাসুদ বললেন, ‘আমি তো বলেছি একটা থেকে দেড়টার মধ্যে। একটু ওয়েট করেন, রিয়াদকে (মাহমুদউল্লাহ) নিয়ে আমি আসছি।’
একটু পরই দেখতে পেলাম, মাহমুদউল্লাহ ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে আসছেন। হ্যাগলি ওভালের পেছনে যে বিশাল হলরুমটাতে প্রেস কনফারেন্স হয়, আমি সেটির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। মাহমুদউল্লাহর সঙ্গেই ভেতরে ঢুকলাম। ঢুকতে ঢুকতে মাহমুদউল্লাহ বললেন, ‘দাদা, আমাকে আজ একটু তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেবেন, প্লিজ। নামাজ পড়তে যেতে হবে। দেরি হয়ে গেছে।’
তাহলে দেরি করলেন কেন?
মাহমুদউল্লাহ বললেন, ‘আগেই আসছিলাম। কোচ হঠাৎ করে একটু কথা বলতে চাইলেন।’
‘একটা’র বদলে ‘একটা থেকে দেড়টার মধ্যে’, হঠাৎই কোচের কথা বলতে চাওয়া—এর সবকিছুই এখন মনে হচ্ছে ভাগ্যের ইশারা। বাংলাদেশ দলের বাস হ্যাগলি ওভাল থেকে মসজিদের দিকে ছাড়ার কথা ছিল দেড়টার সময়। তা ছাড়তে পাঁচ মিনিটের মতো দেরি হয়ে যাওয়াটাই কেমন বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের জন্য জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানে বিশাল সীমান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। আমরা তিন সাংবাদিক আল নুর মসজিদে যাওয়ার সময় মোটেলের সামনে পড়ে থাকা মৃতদেহের আদলে সেই ‘মৃত্যু’কে দেখেছি, ক্রিকেটাররা তো দেখেছেন আরও বেশি। বাসের সামনে পড়ে থাকা রক্তাক্ত লাশ, রক্তে লাল শরীর নিয়ে মসজিদ থেকে টলতে টলতে বেরোনো আহত মানুষ, মৃত্যুভয়ে আতঙ্কিত মানুষের কান্না আর বুকফাটা আর্তনাদ।
দিকচিহ্নহীন হ্যাগলি পার্কে হাঁটতে হাঁটতে ক্রিকেটারদের মুখে শুনছি সেসবের বর্ণনা। তাঁদের কণ্ঠ কাঁপছে, চোখে–মুখে ফুটে বেরোচ্ছে আতঙ্ক। প্রাণপণে দৌড়ানোর ইচ্ছাটা সংবরণ করতে হচ্ছে, পাছে না পুলিশ আমাদেরই সন্ত্রাসী ভেবে গুলি করে দেয়! লিখতে লিখতে আবারও চোখ ভিজে যাচ্ছে। প্রার্থনা করতে গিয়ে লাশ হয়ে যাওয়া ওই মানুষগুলোর জন্য কাঁদছি, কাঁদছি হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়তে থাকা আরও অনেকের জন্য, কাঁদছি নিউজিল্যান্ডের জন্যও।
ক্রীড়া সাংবাদিকতা বিশ্বের কত দেশেই না নিয়ে গেছে! প্রায়ই উত্তর দিতে হয়েছে এই প্রশ্নের—কোন দেশটা আপনার সবচেয়ে ভালো লেগেছে? উত্তরটা দিতে একমুহূর্তও ভাবতে হয়নি—নিউজিল্যান্ড। সাড়ে ১৭ বছরে পাঁচ–পাঁচবার, শুরুর সেই মুগ্ধতা ক্রমেই আরও বেড়েছে। উত্তর–দক্ষিণ দুটি দ্বীপ মিলে গড়া দেশটাকে দুহাত ভরে দিয়েছে প্রকৃতি আর সে দেশের মানুষও যেন প্রকৃতির সন্তান। আদিবাসীদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার ‘রীতি’র বদলে যে দেশ তাঁদের আরও আগলে রেখেছে। এয়ারপোর্টে, হোটেলে, রাস্তার পাশে বিলবোর্ডে মাওরি ভাষায় সম্ভাষণ। যে দেশে হিংসা নেই, রাত–বিরেতে রাস্তায় বেরোতে কোনো ভয় নেই, ওই ঘটনার এক দিন পর দেশে ফেরার সময় এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশন পুলিশ–নিরাপত্তাকর্মী সবাই ছলছল চোখে হাত ধরে বলে ‘সরি মেইট’—শান্তি আর সহিষ্ণুতার সেই দেশে কেন এমন নৃশংসতা?
ভয়াল সেই শুক্রবারের পরদিন বিষণ্ন দুপুরে মেঘাচ্ছন্ন মন নিয়ে মোটেল থেকে হাঁটতে হাঁটতে মসজিদের ওই রাস্তার মাথায়। ফুলে ফুলে স্মৃতিস্তম্ভ হয়ে আছে জায়গাটা। একটা সাদা বোর্ডে কে যেন লিখে রেখেছে ‘দিস ইজ নট নিউজিল্যান্ড’।
না, এটা নিউজিল্যান্ড নয়। ওই নৃশংসতাও কোনো নিউজিল্যান্ডারের নয়। কিন্তু তাতে কি আসে যায়! বাকি সব ছাপিয়ে নিউজিল্যান্ড মানেই আমার কাছে এখন অনন্ত এক আক্ষেপের নাম—‘প্যারাডাইজ লস্ট’!
আমি হারিয়ে যাওয়া সেই নিউজিল্যান্ডের জন্য কাঁদছি!