মাথার চুল কায়দা করে সিঁথি কাটা, পরনে হাফ হাতা চেক শার্ট আর লুঙ্গি, বাঁ হাতের কবজিতে সোনালি রঙের ঘড়ি। এসব ছাপিয়ে দৃষ্টি কাড়ে তরুণ যোদ্ধার হাতে থাকা স্টেনগান আর তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। যে দৃষ্টি শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করার নেশায় উন্মত্ত। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর প্রকাশিত বিশ্বখ্যাত মার্কিন সাপ্তাহিক সাময়িকী নিউজউইক–এর প্রচ্ছদ এটি। প্রচ্ছদের শিরোনাম ‘বাংলা দেশ গেরিলাস’। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের দলিল হয়ে ওঠা প্রচ্ছদটি অনেকেরই চেনা। কিন্তু ঝোপঝাড়ে যুদ্ধাবস্থায় থাকা একাত্তরের সেই গেরিলাযোদ্ধা কে?
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে এই প্রশ্ন মনে বেশ কয়েকবার উঁকি দিয়েছে। দিন কয়েক আগে ফেসবুকে একটি পোস্ট ব্যাপক আগ্রহী করে তুলল এ ব্যাপারে জানতে। বিরল ও ঐতিহাসিক ছবির ফেসবুক গ্রুপটির নাম ‘বাংলাদেশের দুষ্প্রাপ্য ছবিসমগ্র’। প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ সদস্যের এই গ্রুপেই সুলতান মাহমুদ নামের একজন নিউজউইক সাময়িকীর প্রচ্ছদ দিয়েছিলেন। সঙ্গে লিখেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম হেবজুল বারী এবং তাঁর সঙ্গে সুলতান মাহমুদের সম্পর্ক নানা-নাতির। রোমাঞ্চকর ব্যাপার। পরিচিত হই সুলতান মাহমুদের সঙ্গে। সেই পরিচয়সূত্রেই যোগাযোগ বীর মুক্তিযোদ্ধা হেবজুল বারীর সঙ্গে। তারপর ফোনালাপ।
২০ জানুয়ারি দুপুর। আগেই সময় নেওয়া ছিল। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের টঙ্গী এলাকায় একটি বিপণিবিতানে হেবজুল বারী আসবেন। প্রতীক্ষা যখন দীর্ঘ হতে শুরু করল, তখন তিনি এলেন। কালো কোটের সঙ্গে লাল টাই পরা। দাড়ি রাঙিয়েছেন মেহেদিতে, লম্বাটে মানুষ হালকা–পাতলা গড়নের। ছবিতে যে ২১ বছরের তরুণের দেখা মেলে, এখন তিনি প্রায় ৭১ বছরের প্রৌঢ়। বয়সের ছাপ চোখেমুখে। কিন্তু কথাবার্তা, চালচলনে যেন সেই প্রদীপ্ত তরুণকেই খুঁজে পাওয়া গেল।
কুশল বিনিময়ের পর হেবজুল বারী আমাদের নিয়ে চললেন টঙ্গী পাইলট স্কুল অ্যান্ড কলেজের দিকে। যেতে যেতে জানলাম টঙ্গীতে তিনি প্রায় ২৫ বছর ধরে থাকছেন। তাঁর পাঁচ সন্তান। চার ছেলেমেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। পরিবার নিয়ে ভালোই আছেন।
১৯৬৯ সালে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন হেবজুল বারী। পদায়ন হয়েছিল চট্টগ্রামে। মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে যোগ দেন চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। ২৫ থেকে ২৮ মার্চ বেলুচ রেজিমেন্টের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। চার দিন যুদ্ধ চলতে চলতে খাবার, গোলাবারুদ একপর্যায়ে শেষের দিকে। কিছুতেই যখন মুক্তিযোদ্ধা আর কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না, তখন তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমানের নির্দেশে কিছুদিনের জন্য মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ বন্ধ রাখেন। ওদিকে গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের ব্রাহ্মণহাটার বাড়িতে থানা থেকে খবর জানায়, হেবজুল বারী মারা গেছেন।
সবাইকে অবাক করে হেবজুল বারী পরদিনই বাড়িতে উপস্থিত হন। ১১ ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট তিনি। দেশের সেই পরিস্থিতিতে দিন কয়েক বাড়িতে কাটিয়ে চলে যান ২ নম্বর সেক্টরের সদর দপ্তর ভারতের মেলাঘরে। সেখান থেকে এক মাসের থ্রি মর্টার শেল ছোড়ার প্রশিক্ষণের জন্য অম্পিনগরে যান। প্রশিক্ষণ শেষে ঢাকা শহরে মেজর হায়দার, কমান্ডার মোহাম্মদ আবদুল আজিজ বীর প্রতীকের গ্রুপে মর্টার শেলিংয়ের জন্য পাঠানো হয় হেবজুল বারীকে। মোহাম্মদ আবদুল আজিজের নেতৃত্বে ঢাকার বিভিন্ন অভিযানে অংশ নেন তিনি। এ সময় ল্যান্স নায়েক ও সেকশন কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন হেবজুল বারী। তাঁর উল্লেখযোগ্য আক্রমণগুলোর মধ্যে অন্যতম ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনীর সদর দপ্তর, ইছাপুরা আক্রমণ, গাউছিয়া আর্মি ক্যাম্প, ডেমরা ফেরিঘাট অপারেশন, তেজগাঁও থানার অন্তর্গত ত্রিমোহিনী নাসিরাবাদ গুদারাঘাট অপারেশন, বাসাবো, রামপুরা, বাড্ডা, গুলশান, শাহজাদপুর, রামপুরা টেলিভিশন কেন্দ্র প্রভৃতি।
হেবজুল বারীর সঙ্গে কথা এগিয়ে চলে। ঢাকার বিভিন্ন যুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে অংশ নেওয়ার স্মৃতিতে ডুবে যান তিনি। জানতে চাই নিউজউইক–এর সেই প্রচ্ছদের ছবি সম্পর্কে। হেবজুল বারী বলেন, ‘তখন ১৯৭১ সালের অক্টোবর কি নভেম্বর মাস হবে। সকাল ১১টায় ইছাপুরা ক্যাম্পে বিদেশি দুজন সাংবাদিক ও একজন আলোকচিত্রী আসেন। কমান্ডার মোহাম্মদ আবদুল আজিজ নির্দেশ দেন সহযোগিতা করতে। আমরা প্রস্তুত হয়ে যাই।’ ইছাপুরা নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপপুর উপজেলার একটি এলাকা। এখানে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পটি। সেখানেই বিদেশি সাংবাদিকেরা হাজির হন। তাঁদের নিয়ে ছবি তোলেন।
‘তখন ১৯৭১ সালের অক্টোবর কি নভেম্বর মাস হবে। সকাল ১১টায় ইছাপুরা ক্যাম্পে বিদেশি দুজন সাংবাদিক ও একজন আলোকচিত্রী আসেন। কমান্ডার মোহাম্মদ আবদুল আজিজ নির্দেশ দেন সহযোগিতা করতে। আমরা প্রস্তুত হয়ে যাই।’হেবজুল বারী, বীর মুক্তিযোদ্ধা
হেবজুল বারী বলেন, ‘যুদ্ধের সময় ভারত থেকে লুঙ্গি আর শার্ট দেওয়া হয়েছিল। যেগুলো আমরা বেশির ভাগ সময় পরতাম। এমন অবস্থায় আমরা ১২-১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিকের কথামতো যুদ্ধের অবস্থান নিয়ে মহড়া দিলাম। আমাদের ছবি তোলা হলো।’ হেবজুল বারী যে স্টেনগান হাতে নিয়ে প্রতীকী যুদ্ধাবস্থা নিয়েছেন, সেই অস্ত্র ছিল এক সহযোদ্ধার। হেবজুল বারী যোগ করেন, ‘আমার পাশে আরও একজনকে আবছা দেখা যায়। তিনি হলেন কুমিল্লার মুরাদনগরের এম এ আক্কাস।’ খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বীর মুক্তিযোদ্ধা এম এ আক্কাস এখন গুরুতর অসুস্থ।
মুক্তিযুদ্ধের পর হেবজুল বারী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। সৈনিক হিসেবে অবসর নেন ২০০০ সালে। তাঁর ছবিটি যে নিউজউইক–এর মতো বিশ্বখ্যাত সাময়িকীতে প্রচ্ছদ হয়েছে এটা তিনি জানেন না। তবে এটা জানেন, তাঁর ছবিটি বইয়ে ব্যবহার করা হয়েছে, যা বিশ্বের অনেকে দেখেছে। তিনি বলেন, ‘১৯৭২ সালে আমার সহযোদ্ধা আলবার্টের কাছে জানতে পারি ছবিটা দাউদ হোসেন ও ফজলুল কাদের কাদেরী সম্পাদিত বাংলাদেশ জেনোসাইড অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড প্রেস বইয়ে ছাপা হয়েছে। এরপর বইটি সংগ্রহ করি। সাদাকালো ছবি। ৪৯৩ পৃষ্ঠায় ছাপা হয়।’ ১৯৭২ সালে প্রকাশিত বইটি সংগ্রহ করে সেই ছবিটি দেখতে পান। ছবিটি দেখে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে যান। তাঁর ভাষায়, ‘খুবই ভালো লাগে।’
হেবজুল বারীর সহযোদ্ধা ছিলেন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধা সুরুজ মিয়া। তিনি বলেন, ‘হেবজুল বারী, মো. আবু আক্কাস, মো. আবদুল হান্নান ও আমি একই গ্রুপে ছিলাম। আমরা চারজন থ্রি মর্টার শেলিংয়ের কাজ করতাম। ওই ছবিতে অনেকের মধ্যে আমিও ছিলাম। অনেক ছবি তোলা হয়েছিল।’
হেবজুল বারীর এখন বেশি সময় কাটে নাতি-নাতনির সঙ্গে। তবে দেশের ভালোমন্দ নিয়ে চিন্তিত হন। সেদিন যেমন বলছিলেন, ‘দেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছি। দেশকে স্বাধীন করেছি। এটা বড় প্রাপ্তি। জীবনে আর কোনো চাওয়া–পাওয়া নেই। দেশটা যেভাবে চলছে, আরও ভালো চলুক।’