‘স্বপ্নপুরী’-তে তরুণ-তরুণীরা আসেন তাঁদের স্বপ্নের কথা জানাতে, স্বপ্ন পূরণের পথ খুঁজতে। বড় কক্ষটি জুড়ে আছে ২০টি ল্যাপটপ, গ্রন্থাগার, মহামানবদের নানা ছবি ও বাণী, বিভিন্ন দেশের মানচিত্র। এখানে তরুণেরা পড়েন, ইন্টারনেটে সার্চ করেন, বিভিন্ন প্রোগ্রাম শেখেন, নিজেরা কথা বলেন।
এই স্বপ্নপুরীর নির্মাতা কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মোছা. সুলতানা পারভীন বললেন, ‘কাউকে চাকরি দেওয়ার কথা বলি না। বলি, নিজের শক্তির সন্ধান করো। নিজের সমৃদ্ধির জায়গা খুঁজে নাও। যতটুকু সহায়তা লাগবে আমরা দেব।’
কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়েই এই স্বপ্নপুরী। এখানে শুধু শিক্ষিত তরুণ-তরুণী নন, রিকশাচালক থেকে শুরু করে নিম্ন আয়ের মানুষদের নিয়েও কর্মশালা হয়। সমস্যার কথা শোনা হয়। একেক জনের ভেতরে যে সম্ভাবনা আছে, সেই সম্পর্কেও জানানো হয়।
জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নিচতলা থেকে ওপরে উঠতে বিভিন্ন নদীর ছবি দেওয়ালে লাগানো। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে মৃদু শব্দে বাজে ভাওয়াইয়া গান, যা এ অঞ্চলের ঐতিহ্য। এসব নানা উদ্যোগ এলাকায় সাড়া ফেলেছে। সুলতানা পারভীন এ জেলায় এসেছেন গত বছরের মার্চে। জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের কাছেই চার একরের একটি মজাপুকুর ছিল। এটি ছিল মাদকসেবীদের আড্ডা। নিজ উদ্যোগে এ পুকুর পুনঃখনন করেছেন। পাড় বাঁধানো হয়েছে। এখন সকাল-বিকেল মানুষ এখানে হেঁটে বেড়ায়। জায়গাটি বিনোদনের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
বর্তমানে দেশের যে আট জেলায় নারী জেলা প্রশাসক (ডিসি) আছেন, কুড়িগ্রাম তার একটি। স্বপ্নপুরীর মতো বিভিন্ন জেলায় নারী প্রশাসকদের ব্যতিক্রমী উদ্যোগ স্থানীয়ভাবে প্রশংসিত হচ্ছে।
সুলতানা পারভীন বললেন, ‘জেলা প্রশাসক হিসেবে দাপ্তরিক যে দায়িত্ব সেটা তো আমার অনুপস্থিতিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্যরাও করতে পারেন। কিন্তু একজন ডিসি হলেন “চেঞ্জ মেকার”। তাঁকে অবশ্যই পরিবর্তনে ব্রতী হতে হবে।’
দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক সাবিনা ইয়াসমিন। বাবা শেখ মাহতাব উদ্দিন যখন যুদ্ধে যান, সাবিনা ইয়াসমিন তখন মাতৃগর্ভে। সাবিনা ইয়াসমিনের জন্ম হলো, দেশ স্বাধীন হলো। কিন্তু নবীন দেশ আর ঔরসজাত সন্তানের মুখ দেখতে পেলেন না মাহতাব উদ্দিন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি শহীদ হন। বাবার বীরত্বের গল্প শুনতে শুনতে বড় হওয়া সাবিনা ইয়াসমিন জেলার প্রতিটি স্কুল-কলেজ, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে একটি করে মুক্তিযুদ্ধ কর্নার করেছেন নিজ উদ্যোগে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলছে মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত বইয়ের পঠন-পাঠন, কুইজ প্রতিযোগিতা।
সাবিনা ইয়াসমিন বললেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সবচেয়ে গৌরবের বিষয়। নতুন প্রজন্ম সেই ঘটনাকে হৃদয়ে ধারণ করুক, এটাই লক্ষ্য। স্কুল-কলেজে যদি এর পঠন-পাঠন থাকে, তবে একটি প্রজন্ম গড়ে উঠবে সেই আদর্শ নিয়ে।’
পঞ্চগড়ে ভ্রাম্যমাণ স্বাস্থ্য পরিষেবা স্থানীয় মানুষের মধ্যে সাড়া ফেলেছে। পাথর ভাঙার শ্রমিক, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা এবং দরিদ্র মানুষ এই সুবিধা পায়। জেলা সিভিল সার্জন ও অন্যরা এতে সহযোগিতা করেন। সপ্তাহের একটি দিন জেলা প্রশাসক সাবিনা ইয়াসমিনের নেতৃত্বে এ দল পৌঁছে যায় সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কাছে।
গ্রামে গ্রামে উঠান বৈঠকসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে শ্রেণি-বর্ণনির্বিশেষে সব মানুষের কাছে যান মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক নাজিয়া শিরিন। এর আগে নীলফামারীর জেলা প্রশাসক ছিলেন তিনি। গত জুনে যোগ দিয়েছেন চা-বাগানের এ জেলায়। নাজিয়া শিরিন বললেন, ‘অনেক সময় আমাদের কাজের সিদ্ধান্ত হয় ওপর থেকে। যাদের জন্য কাজ, তাদের কথা শোনা হয় না। তাই মানুষের কাছে যাই।’
কোনো মাধ্যম ব্যবহার না করে সরাসরি মানুষের সমস্যা জানা গেলে সমস্যার প্রকৃত স্বরূপ জানা যায়—এমন বিশ্বাস নড়াইলের জেলা প্রশাসক আনজুমান আরার। আনজুমান আরা বলেন, ‘আমাদের প্রত্যন্ত এলাকার মানুষ এখনো ততটা সচেতন না। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাদের সচেতনতার বার্তা দিই।’ বর্তমানে প্রতি জেলায় উন্নয়ন মেলা হয়। নরসিংদীর জেলা প্রশাসক সৈয়দা ফারহানা কাউনাইন এই উন্নয়ন মেলায় ‘জব কর্নার’ করেছেন। সেখানে চাকরিপ্রার্থীরা তাঁদের জীবনবৃত্তান্ত জমা দেন। গত বছর থেকে এ উদ্যোগ শুরু, এ পর্যন্ত ৪০০ তরুণ চাকরি পেয়েছেন।
শেরপুরের জেলা প্রশাসক আনার কলি মাহবুব দায়িত্ব নেওয়ার পর গজনীর অবকাশ কেন্দ্র উন্নত করার উদ্যোগ নিয়েছেন। গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক শাহিদা সুলতানা দায়িত্ব নিয়েছেন মাস তিনেক হলো। প্রথমেই জেলার প্রায় সব সাংবাদিকের সঙ্গে বসে জেলার সমস্যা শুনেছেন। স্থানীয় সাংবাদিকদের অনেকেই বলেছেন, এভাবে উদ্যোগী হয়ে সমস্যার কথা শোনার রেওয়াজ ছিল না।
দুই মাস হলো রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক হয়েছেন দিলসাদ বেগম। জেলার নদীভাঙন রোধকে প্রাধান্য দিচ্ছেন শুরু থেকেই। জেলার বিনোদনকেন্দ্র ও পার্ক উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছেন। প্রাথমিক শিক্ষকেরা যাতে ডিজিটাল সামগ্রী ব্যবহার করতে পারেন, সে বিষয়ে যত্নবান হবেন বলে জানালেন এ জেলা প্রশাসক।