কদিন আগেই বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাসে বড় ঘটনা ঘটল। ১১ দফা (পরে নারী ক্রিকেটারের প্রসঙ্গসহ যোগ হয় আরও দুটি) দাবিতে ক্রিকেটারদের ডাকা ধর্মঘটে তোলপাড় হয় পুরো ক্রিকেট-বিশ্ব। ক্রিকেটারদের এই দাবিতে ভীষণ চাপে পড়েন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) শীর্ষ কর্তারা। তবে এই আন্দোলনে অনেক কিছু নিয়ে আলোচনা বা অনেক প্রসঙ্গ সামনে এলেও ‘নেতৃত্বে নারী’ প্রসঙ্গটি সেভাবে উচ্চারিত হয়নি।
সবেধন নীলমণি ‘মিনু’
বর্তমানে বিসিবিতে এই মুহূর্তে ২৪ জন পরিচালক থাকলেও নেই কোনো নারী সংগঠক। বিসিবির পরিচালনা পর্ষদেও নেই কোনো নারী সদস্য। শুধু এই পরিচালনা পর্ষদই নয়, আগের বা তার আগের বোর্ডেও ছিলেন না কোনো নারী। বিসিবির সভাপতির পদ দূরে থাক, পরিচালক হওয়াটাও তাঁদের কাছে বহু দূরের পথ। বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাসে মাত্র একজন নারী আসতে পেরেছেন বোর্ডের নীতিনির্ধারণী কমিটিতে। সেই সবেধন নীলমণি ছিলেন মনোয়ার আনিস খান; ক্রিকেটাঙ্গনে যিনি পরিচিত ‘মিনু’ নামে। ২০০৭ সালের ২৯ জুলাই সরকার মনোনীত ১১ সদস্যের অস্থায়ী কার্যনির্বাহী কমিটিতে ঠাঁই হয়েছিল সাবেক এই নারী ক্রিকেটারের। বিসিবির বর্তমান-সাবেক বেশ কয়েকজন পরিচালক নিশ্চিত করেছেন, মনোয়ারের আগে-পরে আর কোনো নারী সংগঠক আসেননি বা আসতে পারেননি বিসিবির নীতিনির্ধারণী কমিটিতে।
বিসিবির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, একটা সময় বোর্ড চালাত সরকার মনোনীত কার্যনির্বাহী কমিটি। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত দেশের ক্রিকেট নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি প্রায় তিন দশক এভাবেই চলেছে। সরকার মনোনীত এসব কমিটিতে কখনোই কোনো নারী সদস্যের ঠাঁই হয়নি। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে ভোটাভুটির মাধ্যমে নির্বাচিত হওয়ার নীতি চালু হলেও এ ধারায় কোনো বদল আসেনি। বোর্ডে পুরুষ সংগঠকদের দাপট থেকেছে সব সময়ই।
২০০৭ সালে মনোয়ার আনিস খান বোর্ডের পরিচালক হয়েছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মনোনীত হয়ে। দায়িত্ব পালন করেছেন ক্রিকেট বোর্ডের নারী বিভাগের প্রধান হিসেবে। ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে আগের কমিটির মেয়াদ শেষ হলে নির্বাচনের মাধ্যমে যে কমিটি ছিল, সেটিতে ঠাঁই হয়নি কোনো নারী সদস্যের। ২০০৯, ২০১২, ২০১৩, সবশেষ ২০১৭ পরিচালনা পর্ষদেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। শুধু পরিচালনা পর্ষদ কেন, বিসিবির গত নির্বাচনে ১৬৭ জন ভোটারের মধ্যে নারী ছিলেন মাত্র দুজন। মনোয়ার আনিসের পর গত ১১ বছর বিসিবির নারী বিভাগের দায়িত্ব পাচ্ছেন পুরুষ সংগঠকেরাই। গত বোর্ডে এই বিভাগের প্রধান ছিলেন এম এ আউয়াল। ২০১৭ থেকে এই বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ করছেন শফিউল আলম চৌধুরী। ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন নাজীব আহমেদ। যেহেতু পরিচালনা পর্ষদ নারীশূন্য, আর ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, বিসিবির ২২টি স্ট্যান্ডিং কমিটিতে তাই পুরুষ সংগঠকদেরই একচ্ছত্র দাপট।
কেন এ শূন্যতা?
বাংলাদেশ ক্রিকেটে সবচেয়ে বড় সাফল্য এসেছে মেয়েদের হাত ধরেই। ভারতকে হারিয়ে ২০১৮ এশিয়া কাপ জিতে নারী ক্রিকেটাররা প্রমাণ করেছেন, বড় মঞ্চে তাঁরা আলো ছড়াতে জানেন। অথচ সংগঠক পরিচয়ে নারীদের অবস্থান ঠিক ততই হতাশাজনক। এমনকি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) কার্যনির্বাহী কমিটিতেও একজন নারী আছেন—মাহফুজা আক্তার কিরণ।
নারী সংগঠকদের পিছিয়ে থাকাটাকে ‘দুঃখজনক’ বলছেন অভিজ্ঞ ক্রিকেট সংগঠক ও বিসিবির পরিচালক আহমেদ সাজ্জাদুল আলম। তিনি বললেন, নির্বাচনের মাধ্যমে বিসিবির পরিচালনা পর্ষদে যে কেউ সদস্য হতে পারেন। ক্লাবগুলো যে নীতিতে চলে, বিভাগ-জেলা ক্রীড়া সংস্থা যেভাবে চলে, প্রতিটি জায়গায় নারীদের প্রতিনিধিত্ব খুব কম। বোর্ডের কাউন্সিলর (ভোটার) হিসেবেও নারী অনেক কম। মানসিকতা ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা আছে। এগুলো ডিঙিয়ে এখন পর্যন্ত পরিচালক হিসেবে কোনো নারী নির্বাচিত হতে পারেননি।
দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের একমাত্র নারী পরিচালক মনোয়ারা আনিস নিজের অভিজ্ঞতায় বললেন, ‘বোর্ড পরিচালনায় নারীদের আসার প্রক্রিয়াটা খুবই জটিল ও কঠিন। এত জটিলতা আর বাধা পেরিয়ে আসা খুবই কঠিন। পুরুষ আধিপত্যসহ নানান সমীকরণ মিলিয়ে একজন নারীর আসাটা কঠিন হয়ে যায়।’
প্রায় তিন দশক ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন রাইসউদ্দিন। বিসিবির সাবেক এই সাধারণ সম্পাদক ক্রিকেটের আইনপ্রণেতা মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাবের (এমসিসি) আজীবন সদস্য। রাইসউদ্দিন আহমেদ উদাহরণ হিসেবে টানলেন এমসিসির পুরোনো নিয়মটা। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়েও লর্ডসের প্যাভিলিয়নে কোনো নারীর প্রবেশাধিকার ছিল না! সেই নিয়ম বদলেছে। বাংলাদেশ ক্রিকেটে কেন ছবিটা বদলাবে না?
রাইসউদ্দিন বললেন,‘ পুরুষ নীতিনির্ধারকেরা নারীদের সব সমস্যা অনুধাবন করতে পারেন না। বিভাগের প্রধান নারী হলে নারী ক্রিকেটাররা যতটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন, একজন পুরুষ পরিচালকের ক্ষেত্রে তা হওয়ার কথা না। নারীরা অন্তত ভাবতে পারেন যে, আমাদের একজন অভিভাবক আছেন, যাঁর কাছে সব খুলে বলা যায়। ক্রিকেট বোর্ডেও নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো জরুরি।’
পথ উন্মুক্ত হবে কীভাবে?
বিসিবির পরিচালনা পর্ষদে আসা যায় তিনটি ক্যাটাগরিতে (জেলা-বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থা, ঢাকার ক্লাব এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংস্থা ও সাবেক ক্রিকেটার) নির্বাচন করে। বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের প্রধান আকরাম খান বোর্ডে এসেছেন ক্যাটাগরি-১, চট্টগ্রাম বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার হয়ে। আকরাম খানও মানছেন ক্রিকেট সংগঠক হিসেবে বোর্ডে আসার পথটা মসৃণ নয় নারীদের জন্য। তবে তাঁর মতে, দুয়ারটা সবার জন্যই খোলা। ক্রীড়াঙ্গনে যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সংগঠক হতে হয়, সেটা হয়তো নারীদের উৎসাহিত করে না। ঢাকার ক্লাবে সংগঠক হিসেবে কাজ করার আগ্রহও সম্ভবত কম। তবে ঝামেলায় যেতে পারবেন না, এসব ভাবলে সংগঠক হতে পারবেন না। এসব পেরিয়েই সংগঠক হতে হবে।
তবে ইচ্ছা-চেষ্টা-পরিশ্রম থাকলেই যে এসব বাধা পেরিয়ে যাওয়া যাবে, সেটির কোনো নিশ্চয়তা নেই। মনোয়ার আনিস যেমন বললেন, ‘আমাদের ক্রীড়া রাজনীতির পরিবেশ খুব একটা নারীবান্ধব নয়।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাবেক এক বোর্ড পরিচালক বলছেন, গঠনতন্ত্রে কিছুটা সংশোধন এনে নারীদের পথ কিছুটা মসৃণ ও প্রক্রিয়াটা সহজ করা যায়। বিসিবির অধীনে শিক্ষা বোর্ডগুলো আছে, যাদের ক্রিকেটীয় কার্যক্রম খুবই অনিয়মিত। অথচ গঠনতন্ত্র বলছে, কাউন্সিলরশিপ রাখতে হলে নিয়মিত ক্রিকেটীয় কার্যক্রম থাকতে হবে। অনিয়মিত থাকার পরও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাটাগরি আছে। এসব জায়গায় নারীদের জন্য আলাদা কিছু করা যেতে পারে। দেশে একেবারেই নারী ক্রিকেট সংগঠক নেই, তা নয়। ফ্র্যাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট বিপিএলে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসের কর্ণধার হিসেবে নাফিসা কামাল কিন্তু দেখিয়েছেন, নারীরাও পারেন।