বান্দরবান জেলার প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও অবকাঠামো উন্নয়ন—সরকারি প্রায় সব কাজই চলছে নারীদের নেতৃত্বে। জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, নির্বাহী প্রকৌশলী তিনজনই নারী; তিনটি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাও নারী। জেলা ও উপজেলা মিলিয়ে প্রশাসনের শীর্ষ পদে এখন ১২ নারী কর্মকর্তা। তাঁদের নিয়ে লিখেছেন বুদ্ধজ্যোতি চাকমা
আড়াই বছর আগে বান্দরবান জেলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে আসেন পুলিশ সুপার (এসপি) জেরিন আখতার। তারপর থেকে সাফল্যের সঙ্গেই জেলার সাতটি উপজেলার পুলিশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। এসপির কার্যালয়ে জেরিন আখতারের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। জানালেন, সত্য বটে তিনি নারী, তবে দাপ্তরিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে নিজেকে সবার আগে একজন মানুষ মনে করেন।
জেরিন আখতারের কাজেই অবশ্য তার প্রমাণ পাওয়া যায়। ধাপে ধাপে যোগ্যতার পরীক্ষা দিয়ে এই পর্যায়ে এসেছেন তিনি। বললেন, কর্মজীবনে ঊর্ধ্বতন ও অধস্তন সহকর্মী কারও কাছে নারী হিসেবে আলাদা করে কিছু পার্থক্য টের পাননি। তবে পারিবারিক সমর্থন ও সহযোগিতা ছিল, ‘মা, বাবা, স্বামীর কাছে কখনো নারী-পুরুষের বৈষম্য দেখিনি। তা না হলে তো ২৪ ঘণ্টা দায়িত্বের এসপি পদে কাজ করা কঠিন হতো। আমার একমাত্র মেয়ে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ও লেভেলে পড়ছে।’
পুলিশ প্রশাসনের পর বান্দরবানের জেলা প্রশাসন প্রধানের দায়িত্বও পান একজন নারী। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে জেলা প্রশাসক হয়ে আসেন ইয়াছমিন পারভীন। প্রায় দেড় বছর এই দায়িত্বে আছেন তিনি। প্রতিদিন সময়মতো অফিসে হাজির হন ইয়াছমিন। শত ব্যস্ততার মধ্যেও দেখা করতে আসা কাউকে কথা না বলে ফিরিয়ে দেন না। তিনি বলেন, ‘আমার অফিসের দরজা সব সময় সবার জন্য খোলা। সমস্যায় না পড়লে তো আর সাধারণ মানুষ জেলা প্রশাসকের কাছে আসেন না। এ জন্য তাঁদের কথা শোনার ও সমস্যা লাঘব করার চেষ্টা করি।’
ইয়াছমিন পারভীনের মতে, নারী কর্মকর্তা হওয়ার আলাদা কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। যেমন একজন মা হিসেবে ছেলেমেয়েকে গুণগত সময় ও গৃহকর্ত্রী হিসেবে পরিবারের সবকিছু সামাল দিয়ে কর্মক্ষেত্রে আসতে হয়। পুরুষদের জন্য যেটা অনেক শিথিল। জাতি-ধর্ম-শ্রেণি নির্বিশেষে সবার গ্রহণযোগ্যতা অর্জন ও বান্দরবানের পর্যটনকে দেশ-বিদেশে উপস্থাপন করতে পারা তাঁর দেড় বছরের কর্মকালে সবচেয়ে বড় সাফল্য মনে করেন তিনি।
জেলা প্রশাসক ছাড়াও বর্তমানে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট উম্মে কুলসুম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) সুরাইয়া আক্তার, নাইক্ষ্যংছড়ির ইউএনও সালমা ফেরদৌস ও আলীকদমের ইউএনও মেহরুবা ইসলাম বান্দরবানে শীর্ষ পদে কর্মরত রয়েছেন। বান্দরবান সদর উপজেলার ইউএনও সাবরিনা আফরিন সদ্য বদলি হয়েছেন। তাঁর জায়গায় দায়িত্ব পাওয়া সাজিয়া আফরোজ এখনো যোগদান করেননি।
প্রশাসনের বাইরে বান্দরবানে নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আছেন শর্মিষ্ঠা আচার্য, গণপূর্ত বিভাগে শর্মী চাকমা। স্বাস্থ্য বিভাগে বান্দরবান সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ভানু মারমা, জেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা আতিয়া চৌধুরী, পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের উপপরিচালক সুইক্রাচিং মারমা দায়িত্ব পালন করছেন।
অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) উম্মে কুলসুম ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) সুরাইয়া আক্তার দুজনই বললেন, নারী কর্মকর্তা—এই দৃষ্টিভঙ্গিই বদলাতে হবে। কর্মকর্তা, কর্মকর্তাই; এতে নারী বা পুরুষ বলে কিছু নেই। উম্মে কুলসুম বলেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা থাকার সময় মাঠে গিয়ে মাটির মানুষের সঙ্গে কাজ করাটা সবচেয়ে বেশি উপভোগ করেছেন।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সালমা ফেরদৌস দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রায়ই দুর্গম পাহাড়ে হেঁটে ঘুরে বেড়ান। এখানে দায়িত্ব পালনের সময় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠানকেই বড় সাফল্য মনে করেন সালমা ফেরদৌস। তাঁর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল এই নির্বাচন। কিন্তু কোনো বিতর্ক ছাড়া সম্পন্ন করতে পেরেছেন। তিনি জানালেন, ইউএনওদের বাসায় সরকারিভাবে একজন গৃহকর্মী থাকলে আরও বেশি স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করা যেত।
আলীকদমের ইউএনও হিসেবে সম্প্রতি যোগ দেওয়া মেহরুবা ইসলাম উপজেলার প্রথম নারী ইউএনও।
যোগদানের পর নারী-পুরুষ অনেকে তাঁকে দেখতে এসেছেন। নারী ও পুরুষের সমতা অর্জনে এটাও সমাজের জন্য কম বার্তা নয়, বললেন তিনি।
গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শর্মী চাকমা চাকরির শুরু থেকে ঢাকার প্রধান কার্যালয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। মাঠপর্যায়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা না থাকায় নির্বাহী প্রকৌশলীর কাজটা তাঁর জন্য ছিল জটিল ও চ্যালেঞ্জিং। তবে জ্যেষ্ঠ সহকর্মীদের অনুপ্রেরণায় ও পরামর্শ নিয়ে কাজ শিখে নিচ্ছেন। তিনি বলছিলেন, নারী হিসেবে তো বটেই, পাহাড়ি নারীদের জন্য মাঠে কাজ করা আরও কঠিন, তবে অসাধ্য নয়।
মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের উপপরিচালক আতিয়া চৌধুরী জানালেন, পাহাড়ে নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি অনেক উঁচু। এ জন্য নারী হিসেবে সমস্যা হয় না, এখানে কর্মকর্তা–কর্মচারীদের সমস্যায় পড়তে হয় যাতায়াত ও ভাষাগত কারণে। আবার সরকারি দপ্তরগুলোতে জনবলের অভাবও বড় একটি সমস্যা। মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরে জেলা ও সাত উপজেলায় তিনি একজনই কর্মকর্তা।
নারী নেতৃত্বে প্রশাসনিক সেবা নিয়ে মানুষও প্রশংসা করছেন। বিশেষ করে নারীরা বলেছেন, তাঁরা মন খুলে কথা বলতে পারেন। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রতিও তাঁরা অনেক সংবেদনশীল।
মানবাধিকার নেত্রী ডনাইপ্রু নেলী বলেন, ‘বান্দরবানে নারী কর্মকর্তারা যোগদানের পর বুঝতে পেরেছি, প্রশাসনিক পদে নারী থাকলে সেবা অনেক বেশি অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়। নারী, পুরুষ ও শিশু, কিশোর-কিশোরী সবাই তাঁদের কাছে খোলামেলা নিজেদের সমস্যার কথা বলতে পারেন। একইভাবে নারী এসপি থাকায় নারীর ওপর সহিংসতার ঘটনায় দ্রুত সহযোগিতা পাওয়া যায়।’
বান্দরবান ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক বিমলকান্তি দাশ বলেন, ‘ডিসি ও এসপি নারী হলেও যেকোনো কাজে খুব সহজে সহযোগিতা পাওয়া যায়। যা আগে অনেক লম্বা প্রক্রিয়ায় যেতে হতো। জেলা প্রশাসকের সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ে এবার জেলায় সয়াবিন তেলের সংকট হয়নি।’