কক্সবাজারের সমুদ্র উপকূলের বিভিন্ন রাখাইন পল্লিতে এখন নাপ্পি তৈরির ধুম পড়েছে। সাগর থেকে ধরে আনা ছোট জাতের চিংড়ি রোদে শুকিয়ে বিশেষ কায়দায় তৈরি হচ্ছে নাপ্পি। কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতি কেজি নাপ্পি বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকায়। জেলার রাখাইন সম্প্রদায়ের মানুষের পাশাপাশি স্থানীয় লোকজনও নাপ্পি তৈরি ও বিক্রি করে সচ্ছলতার মুখ দেখেছেন।
কক্সবাজারের রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকজন জানান, রাখাইন ও পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী লোকজন শুঁটকির মতো তরকারিতে নাপ্পি দেয়। আবার তরকারির স্বাদ বাড়াতে ব্যঞ্জন হিসেবেও এটি ব্যবহূত হয়। ঐতিহ্যবাহী এই খাবারের একটা বড় অংশ তৈরি হয় কক্সবাজারের চৌফলদণ্ডী, খুরুশকুল, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, টেকনাফসহ বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকার রাখাইনপল্লিতে। জেলার আট হাজার রাখাইনসহ অন্তত ৩০ হাজার মানুষ নাপ্পি উৎপাদন ও বিপণনে জড়িত। গত ২৬ সেপ্টেম্বর সদর উপজেলার চৌফলদণ্ডী ইউনিয়নের মগপাড়ায় গিয়ে দেখা গেছে, সাগর ও নদীর তীরবর্তী বেড়িবাঁধের ওপর কয়েক শ মণ ছোট চিংড়ি শুকাতে দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে এটি মিম চিংড়ি হিসেবে পরিচিত। এই এলাকায় ২০টির বেশি স্থানে রাখাইন নারী-পুরুষ দল বেঁধে নাপ্পি তৈরি করছেন। শুকনো চিংড়ি চূর্ণ করে লবণ ও পানি মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে নাপ্পি। এরপর পাতা দিয়ে মুড়িয়ে বাঁশের ঝুড়িতে ভরে ট্রাকে বোঝাই করা হচ্ছে। প্রতিটি ঝুড়িতে থাকে ২০ কেজি নাপ্পি।
কারিগরেরা জানান, পার্বত্য জেলা বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটির পাশাপাশি চট্টগ্রাম, বরিশাল, বরগুনা ও পটুয়াখালীতেও যাচ্ছে এখানকার নাপ্পি। টেকনাফ ও পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্ত দিয়ে প্রতি মাসে অন্তত কয়েক কোটি টাকার নাপ্পি ভারত ও মিয়ানমারে সরবরাহ করা হচ্ছে।
চৌফলদণ্ডী ইউনিয়নের সাবেক সদস্য থোয়াইংগা রাখাইন বলেন, রাখাইনদের অনেকে নাপ্পি তৈরি করে দেওয়ার বিনিময়ে দৈনিক ২০০ থেকে ২৫০ টাকার পারিশ্রমিক পান। নাপ্পি না হলে এই জনপদের আট হাজার রাখাইন বেকার হয়ে পড়ত।
নাপ্পি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িতরা জানান, সাগর থেকে ধরে আনা কাঁচা চিংড়ি খোলা মাঠে ১২ ঘণ্টা রোদে শুকিয়ে শুঁটকি করা হয়। ওই শুঁটকি ঘরে নিয়ে ঢেঁকিতে চূর্ণ করা হয়। তারপর ওই শুঁটকির গুঁড়া আরও ২৪ ঘণ্টা রোদে শুকানো হয়। এই গুঁড়া করা শুঁটকির সঙ্গে পানি, লবণ ও নানা দ্রব্য মিশিয়ে তৈরি করা হয় নাপ্পি। এরপর ২০ কেজি ওজনের ঝুড়ি বোঝাই করে ওই নাপ্পি গুদামজাত করা হয়। চৌফলদণ্ডীর নাপ্পি ব্যবসায়ী সামো রাখাইন (৪০) বলেন, ২০ কেজি ওজনের এক ভার মিম চিংড়ি এখন কিনতে হয় ৫০০-৭০০ টাকায়। সাগরে এই মিম চিংড়ি ধরার নৌকা রয়েছে প্রায় ৪০০টি। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, চৌফলদণ্ডী গ্রামে নাপ্পি ব্যবসায়ী রয়েছেন পাঁচ শতাধিক।প্রতি সপ্তাহে এই এলাকা থেকে অন্তত ৫০০ মণ নাপ্পি বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করা হচ্ছে। মাঝরপাড়ার বাসিন্দা মংলাচি রাখাইন বলেন, ৩০-৩৫ কেজি ওজনের দুই ঝুড়ি চিংড়ি কেনেন ৩৫০-৫০০ টাকায়। এ রকম চার ঝুড়ি কাঁচা মিম চিংড়ি থেকে পাওয়া যায় এক মণ নাপ্পি। সাগরে মিম বেশি ধরা পড়লে প্রতি ঝুড়ি মিমের দাম ১০০-১২০ টাকায় নেমে আসে। তখন নাপ্পিতে বেশি লাভ করা যায়।
চৌফলদণ্ডী ছাড়াও জেলার মহেশখালী, কুতুবদিয়া, চকরিয়া, টেকনাফ ও পেকুয়া উপজেলার বিভিন্ন উপকূলেও বিপুল পরিমাণ নাপ্পি তৈরি হচ্ছে।