নতুন নকশায় জাদুঘর গণগ্রন্থাগার

প্রতিযোগিতায় বিজয়ী নকশায় জাতীয় জাদুঘর ও গণগ্রন্থাগারের ভবিষ্যত রূপ
প্রতিযোগিতায় বিজয়ী নকশায় জাতীয় জাদুঘর ও গণগ্রন্থাগারের ভবিষ্যত রূপ

প্রামাণ্যচিত্রটি পর্দায় প্রাণ পেতেই ভেসে এল জনাকীর্ণ রাজধানীর শাহবাগ এলাকা। নবাবি আমলের নন্দনকানন হিসেবে পরিচিত জায়গাটি কীভাবে প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা এক সড়ক চত্বর হয়ে উঠল, কীভাবে জড়িয়ে পড়ল বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসের সঙ্গে—সেসব তথ্যই জানানো হলো ধারাবর্ণনায়। এক ফাঁকে পাখির চোখে দেখানো হলো প্রাচীর ঘেরা জাতীয় জাদুঘর ও গণগ্রন্থাগার। তারপরই শুরু হলো এই জাতীয় প্রতিষ্ঠান দুটি ঘিরে আধুনিক স্থাপত্য নকশার উপস্থাপনা।

কর্পূরের মতো উড়ে গেল জাতীয় প্রতিষ্ঠান দুটির সীমানাপ্রাচীর। গণগ্রন্থাগারের চিত্র বদলে গেল। প্রথমে গড়ে উঠল সড়ক থেকে সবুজ ঢাল বেয়ে উঠে আসা উঁচু উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ। খোলা প্রাঙ্গণ মধ্যে রেখে, দুপাশে স্থাপিত হলো দুটি আয়তাকার ভবন। এই ভবন দুটি হবে গ্রন্থাগার। আর উঁচু এই চত্বরের নিচে থাকবে তিনটি মিলনায়তন এবং প্রশাসনিক কক্ষ।
পাশের চেয়ারে বসা স্থপতি খন্দকার আশিফুজ্জামান বলতে থাকেন, ‘আমরা গণগ্রন্থাগার চত্বর সম্পূর্ণ নতুনভাবে লাইব্রেরি ভবন, শওকত ওসমান মিলনায়তন এবং জাতীয় গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর নিয়ে গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছি। নগর-পরিকল্পনায় শহরবাসীর সমাবেশের জন্য যেমন ‘প্লাজা’ বা চত্বরের ধারণা; তেমনি, আমাদের গ্রামবাংলার প্রেক্ষাপটে আছে বাড়িঘরের খোলা সবুজ উঠোন। গ্রন্থাগার প্রাঙ্গণের নকশায় এই দুই ধারণাকে এক করেই উঁচু প্লাজার মধ্যখানে নিয়ে আসা হয়েছে একটা সবুজ গোল উঠোন, যে উঠোন হয়ে নেমে যাওয়া যাবে মিলনায়তনসহ বিভিন্ন অফিসে।’
জাতীয় জাদুঘর ও গণগ্রন্থাগারের আধুনিকায়নের জন্য গত বছর এপ্রিলে সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট স্থাপত্য নকশা প্রতিযোগিতার আহ্বান করেছিল। সে প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার জেতা স্থাপত্য নকশার ভিডিও উপস্থাপনা এটি। দুই স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান—ডিকন ডিজাইন স্টুডিও এবং কিউব ইনসাইড ডিজাইন লিমিটেড যৌথভাবে ‘ডি-কন-কিউব জেভি’ নামে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রথম পুরস্কারটি জেতে। দলনেতা আবু আনাছ ফয়সালসহ দুই প্রতিষ্ঠানের অন্য স্থপতিরা হলেন—মো. রাকিবুল আলম, খন্দকার আশিফুজ্জামান, মো. শাখাওয়াত হোসেন, আহমেদ ফিরোজ উল হক, শরীফুজ্জামান, আরিফ উজ-জামান ও হাফিজুর রহমান।
ভিডিও উপস্থাপনার আগেই আমরা একপ্রস্থ জেনেছি—ভবিষ্যতে জাতীয় জাদুঘর ও গণগ্রন্থাগারের রূপ কেমন হবে? তাই রাজধানীর লালমাটিয়ার ডিকন ডিজাইন স্টুডিওর কার্যালয়ে বসে যখন ভবিষ্যতের জাতীয় জাদুঘর এবং গণগ্রন্থাগার দেখছিলাম, সুবিধাই হচ্ছিল কাগুজে তথ্যের সঙ্গে মেলাতে।

এই স্থপতিদের করা নকশা প্রতিযোগিতায় পেয়েছে প্রথম পুরস্কার। ছবি: খালেদ সরকার

গণমানুষের মিলনমেলা
স্থাপত্য প্রতিযোগিতায় নানা দিকনির্দেশনার মধ্যে অন্যতম একটি বিষয় ছিল—জায়গাটা হবে গণমানুষের, নাগরিকদের উন্মুক্ত সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। সে ভাবনা মাথায় নিয়েই পুরো নকশা করেছে স্থপতিদের দল। আবু আনাছ ফয়সাল বলছিলেন, ‘দাঁড়িয়াবান্ধা বা গোল্লাছুটের মতো আমাদের গ্রামীণ খেলার আদলে থাকবে ছক-কাটা প্লাজা। তার সঙ্গে থাকবে বাংলা গান বা কবিতা শোনার ডিজিটাল যন্ত্র, বসার জায়গা আর চত্বরের কেন্দ্রে প্রস্তুত হবে সবুজ ছায়া ঘেরা উঠোন। বইমেলা, জাতীয়-আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব কিংবা লেখক-পাঠকদের বিকেলের আড্ডামুখর হবে এই প্রাঙ্গণ।’
বর্তমান গ্রন্থাগারের আড্ডা–মুখর সিঁড়িটির কথা পাড়তেই রাকিবুল আলম বললেন, এই সিঁড়ির আদলেই নতুন লাইব্রেরি ভবনের প্রবেশপথটির নকশা করা হয়েছে। এ ছাড়া আলো–বাতাসের প্রাচুর্য, আধুনিক বইসজ্জা ও বিভিন্ন ধরনের পড়ার জায়গা নিয়ে করা হয়েছে লাইব্রেরির নকশা। দক্ষিণের ভবনটিতে থাকবে প্রথাগত লাইব্রেরির পাশাপাশি শিশু-প্রবীণ-প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষায়িত ব্যবস্থা।
আবার চোখ রাখি ভিডিওচিত্রে। গ্রন্থাগারের বহিঃসজ্জার বর্ণনা চলছিল তখন। সেখানে ব্যবহার করা হয়েছে বাংলা ব্রাহ্মলিপি–খচিত কাচের দেয়াল। গণগ্রন্থাগার থেকে আমরা চলে যাই জাতীয় জাদুঘরে।

গণগ্রন্থাগারের উঠানের নকশা

অটুট থাকবে ঐতিহ্য
জাদুঘরের নকশা নিয়ে কথা উঠতেই, আশঙ্কামিশ্রিত প্রশ্ন করেছিলাম। তবে কি জাদুঘর ভেঙে নতুনভাবে গড়ে তোলা হবে? সমস্বরে স্থপতিরা বলে উঠলেন, ‘না না!’ সবার পক্ষ থেকে তখন খন্দকার আশিফুজ্জামান বলতে থাকেন, বর্তমান জাদুঘরকে সম্পূর্ণ ভেঙে নয়, বরং মূল কাঠামো অটুট রেখেই রেট্রোফিটিং বা বাহ্যিক পরিবর্তনের মাধ্যমে চেষ্টা করা হয় একটি নতুন রূপ দিতে।
বাহ্যিক রূপ পরিবর্তনের সে দৃশ্যই দেখা গেল ভিডিওচিত্রে। অনেকটা জাতীয় সংসদ ভবনের মতো নকশায় দেখা গেল, জাতীয় জাদুঘরের প্রবেশপথ হবে জলবেষ্টিত চত্বর নিয়ে। হাঁটা পথে প্রধান সড়ক থেকে আসবেন দর্শনার্থীরা, অন্যদিকে যানবাহনে আসা দর্শনার্থীদের জন্য থাকবে জাদুঘর ও লাইব্রেরির মধ্যের সড়কটি। গাছের ছায়া, বসার জায়গা আর হাঁটা পথ নিয়ে জাদুঘরের জল-সবুজ প্রাঙ্গণ উন্মুক্ত হবে সবার জন্য।
ভেতরের নকশায় মধ্যখানে অব্যবহৃত আঙিনা থেকে মিলনায়তনটি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। সরিয়ে ফেলা হয়েছে দাপ্তরিক কাজে ব্যবহৃত কক্ষগুলোও। এর ফলে জাদুঘরের কেন্দ্রে একটা বিশাল জায়গা দর্শনার্থীদের অভ্যর্থনা উন্মুক্ত হবে। টিকিট নিয়ন্ত্রিত প্রবেশপথ অতিক্রম করলেই জাদুঘরের এই প্রাণকেন্দ্র, আর এখান থেকেই বিভিন্ন তলায় অবস্থিত গ্যালারি, গ্রন্থাগার, অভিলেখ্যাগার বিভিন্ন আকর্ষণগুলো এক নজরে দেখা যাবে।
তাহলে জাদুঘরের মিলনায়তন, দাপ্তরিক কাজগুলো কোথায় হবে? আহমেদ ফিরোজ উল হক বলছিলেন, স্বতন্ত্র প্রবেশপথ মিলনায়তন স্থানান্তরিত হবে জাদুঘরের পেছনের পুকুরপাড়ে। এই নতুন মিলনায়তনের ছাদের ঢালে তৈরি হবে একটি অ্যাম্পিথিয়েটার। পুকুর ঘিরে এই অডিটরিয়াম প্রাঙ্গণের এক পাশে মূল ভবন ও সংলগ্ন গাছের সারি থাকবে অপরিবর্তিত, আর অন্য পাশে তৈরি হবে একটি নতুন অ্যানেক্স ভবন। মূল ভবনের প্রশাসনিক অফিস, স্টোরসহ অন্য কার্যক্রমগুলো এই অ্যানেক্স ভবনে স্থানান্তর করা হবে।

জাদুঘরের অ্যাম্পিথিয়েটারে যখন সন্ধ্যা নামে

পরামর্শ পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর
কথায় কথায় স্থপতিরা জানালেন এই প্রকল্প নিয়ে নিজেদের স্বপ্নের কথা। বললেন পেশাগত কাজ হিসেবে এমন অনেক কাজই তাঁরা করেন, তবে জাতীয় এমন একটি কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকার আলাদা আনন্দ রয়েছে। তাহলে কবে নাগাদ শুরু হচ্ছে জাতীয় জাদুঘর, গণগ্রন্থাগার এবং তার সমন্বিত চত্বর নিয়ে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কাজ? প্রশ্নটা শুনে দলের হাফিজুর রহমান বলছিলেন, ‘চূড়ান্ত দিনক্ষণ আমরা জানি না। এই তো প্রতিযোগিতায় সেরা হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের নকশা, এই ভিডিও উপস্থাপনা দেখেছেন। তিনি বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা আশাবাদী শিগগিরই হয়তো প্রকল্পের কাজ শুরু হবে।’
ঢাকাবাসীর সাংস্কৃতিক জীবনে একটি অনন্য প্রাণকেন্দ্র শাহবাগ। ঐতিহ্য আর তারুণ্যের শাহবাগকে নতুনভাবে প্রাণ দিতে স্থপতিদের দলটা এখন শুভক্ষণের অপেক্ষায়।