২২ আগস্ট সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার সলপ রেলস্টেশনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষায় থাকা এক গৃহবধূকে তুলে নিয়ে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। স্বামী স্টেশন চত্বরের একটি চায়ের দোকানের সামনে স্ত্রীকে বসিয়ে ভ্যানের ভাড়া পরিশোধ করতে গেলে তাঁর স্ত্রীকে তুলে নিয়ে পাশের আমবাগানে ধর্ষণ করা হয়। মধ্যরাতে এলাকাবাসী গৃহবধূকে উদ্ধার করেন। ঘটনাটি গণমাধ্যমেও এসেছে, কিন্তু তা ২৬ বছর আগে দিনাজপুরের ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যা, গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণ, সিলেটের এম সি কলেজে স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে আসা তরুণীকে ছাত্রলীগের কর্মীদের ধর্ষণ বা নোয়াখালীতে নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও প্রকাশের ঘটনার মতো প্রতিক্রিয়া তৈরি করেনি মানুষের মধ্যে। এ রকম আরও নারী নির্যাতনের ঘটনা প্রতিক্রিয়াহীন হয়ে পড়ছে সমাজে, এমনকি বিচারপ্রক্রিয়ার মধ্যেও। কিন্তু কেন? অপরাধের আধিক্যে নির্লিপ্ততা চলে আসা এবং খাপ খাইয়ে বা মেনে নেওয়ার প্রবণতা তৈরি হওয়া, বিচারহীনতা, স্বার্থসংশ্লিষ্ট চিন্তায় ডুবে থাকা, নাকি অন্য কোনো কারণে প্রতিক্রিয়া কমে যাচ্ছে? এই কারণ খুঁজতে প্রথম আলো কথা বলেছে শিক্ষাবিদ, নারীনেত্রী ও মনোবিজ্ঞানীদের সঙ্গে। তাঁরা জানিয়েছেন তাঁদের মতামত।
ফওজিয়া মোসলেম
সভাপতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
গণমাধ্যমে এ ধরনের ঘটনা প্রকাশ পেলে আমরা বিবৃতি দিই। তবে ধর্ষণসহ নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রথম অবস্থায় স্থানীয় জনগণের সাড়া দেওয়াটা জরুরি। সব ঘটনায় এই সাড়া আসছে না। এ ছাড়া প্রতিক্রিয়া না হওয়া বা কম হওয়ার অন্যতম কারণ, বিচারের দীর্ঘ প্রক্রিয়ার জন্য মানুষের ভরসা উঠে যাওয়া। ভুক্তভোগীরা বিচার পান না বলে অন্যদের মধ্য একধরনের অনাস্থা তৈরি হয়। ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে পুলিশ মিলমিশ করিয়ে দিতে চায়। উচ্চ আদালতও ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার আদেশ দেন। এভাবে বিচার পাওয়ার অধিকারগুলো স্বীকৃতি পাচ্ছে না। ধর্ষণসহ নির্যাতনের বিরুদ্ধে নারী–পুরুষকে সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। নারীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে।
মেখলা সরকার
সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল
একই ধরনের ঘটনা বারবার প্রকাশ হতে থাকলে মানুষের মধ্যে ঘটনার সঙ্গে একধরনের খাপ খাইয়ে নেওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দেশে শুরুতে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে দু–একজনের মৃত্যুসংবাদে বড় প্রতিক্রিয়া হতো। এখন আড়াই শ মৃত্যুও মানুষকে ততটা মর্মাহত করছে না। ধর্ষণ–নির্যাতনের এত ঘটনা ঘটছে যে মানুষের মন ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে প্রতিক্রিয়াও কম। এই প্রবণতার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যার মধ্যে ধর্ষণের মতো অপরাধ করার প্রবণতা রয়েছে, সে–ও ভাবতে শুরু করে, ‘আমিও তো করতে পারি।’ ধর্ষণের ঘটনায় প্রতিক্রিয়া হওয়ার চেয়েও জরুরি হচ্ছে তা রোধ করার ব্যবস্থা নেওয়া। শুধু আইন কঠোর করলেই হবে না, গোড়ায় যেতে হবে। শিক্ষাপদ্ধতিতে শিশুদের অন্যের প্রতি দায়িত্ববোধের ভাবনা ঢোকাতে হবে। নিষ্ঠুরতা–সহিংসতা রয়েছে, এমন অনলাইন গেমে যুক্ত হওয়া বন্ধ করতে হবে।
বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে ৮১৮ জন নারী ধর্ষণ, ৪১৯ জন পারিবারিক নির্যাতন, ১৪৭ জন যৌতুকের কারণে নির্যাতন, ৮৩ জন যৌন হয়রানি, ১২ জন অ্যাসিড সহিংসতা এবং ৯ জন সালিস ও ফতোয়ার মাধ্যমে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। গত তিন বছরে ধর্ষণ বেড়েছে ১২২ শতাংশ। গৃহবধূ ধর্ষণের সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে ২৯ আগস্ট মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে উল্লাপাড়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দীপক কুমার বলেন, ২৪ আগস্ট গৃহবধূর স্বামী বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ১০-১২ জনকে আসামি করে মামলা করেন। প্রাথমিক তদন্তে ধর্ষণে জড়িত পাঁচজনকে শনাক্ত করা গেছে। সবাই পলাতক। পুলিশ তাঁদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালাচ্ছে।
তাসলিমা ইয়াসমীন
সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শহরে-গ্রামে প্রতিদিন ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে কয়টা মনোযোগ পাচ্ছে? বড় বড় ঘটনার আড়ালে সেসব চাপা পড়ে যায়। ধর্ষণের যেসব ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে, সেগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তা গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার পেয়েছে। আবার যেসব ঘটনায় বিভৎসতা ও নিষ্ঠুরতা তুলনামূলক বেশি অথবা যেসব ঘটনার পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে মানুষ নিজেকে সম্পর্কিত করতে পারছে, সেসব ঘটনায় প্রতিক্রিয়া বেশি হচ্ছে।
রাজধানীতে সড়কের পাশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় এই শহরে বাস করা মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাবোধের অভাব তৈরি হয়েছিল, ‘আমিও ঘটনার শিকার হতে পারি।’ বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে আলাদা গুরুত্ব পেয়েছে। এমসি কলেজের ঘটনায় ছাত্রলীগ জড়িত থাকায় তা প্রচারে গুরুত্ব পেয়েছে। নোয়াখালীর ওই নারী প্রত্যন্ত অঞ্চলের হলেও ঘটনাটির ভিডিও থাকায় বিভৎসতা দেখে মানুষের মধ্যে প্রতিক্রিয়া হয়েছে। যত দিন পর্যন্ত নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নারীর প্রতি সহিংসতা অগ্রাধিকার না পাবে, তত দিন নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনায় সমান প্রতিক্রিয়া আসবে না।
খন্দকার ফারজানা রহমান
চেয়ারম্যান, অপরাধবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
করোনাকালে মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক টানাপোড়েন বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে মানসিক অশান্তি। নির্দিষ্ট কোনো উপাত্ত হাতে না থাকলেও অনুমান করা যায়, এই সময়ে মানুষের মনোযোগ খুব সীমিত হয়ে পড়েছে। স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় ছাড়া অন্যের বিষয় মাথায় নিতে চাইছে না। এর মধ্যেও যেসব সহিংসতার ঘটনায় প্রতিক্রিয়া হয়, সেসবের মধ্যেও একধরনের শ্রেণিবিভাগ করা হচ্ছে। কোনোটাতে রাজনীতিকে যুক্ত করা যাচ্ছে, কোনোটায় চাকচিক্য বেশি। ক্ষমতাকাঠামোর বাইরে মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তদের মধ্যে যারা অপরাধের শিকার হচ্ছে, তাদের অনেকেই মনোযোগ পাচ্ছে না। এই পরিস্থিতি কাম্য নয়। ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুকে ন্যায়বিচার পাইয়ে দিতে বিচারপ্রক্রিয়া ও সমাজ গঠনের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির সাক্ষ্য–প্রমাণ সংগ্রহ থেকে বিচারপ্রক্রিয়া এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। এই সমাজ সম্ভাব্য ধর্ষকের জন্য উর্বর জায়গা। এ কারণে আইনে সাজা কঠোর করেও লাভ হচ্ছে না। ভূমি দুর্বল, এতে কীটনাশক দিয়ে লাভ কী!