সাফল্যের পথেই এগোচ্ছেন দোয়েল
সাফল্যের পথেই এগোচ্ছেন দোয়েল

দোয়েলের জীবন হার মানায় সিনেমার গল্পকেও

বিনোদনজগতে যত কুসংস্কার প্রচলিত, সেগুলোর অন্যতম—বিয়ের পর নারীদের ক্যারিয়ার থাকে না। আর যদি বাচ্চা হয়েছে, তো ক্যারিয়ারের কফিনে শেষ পেরেকটিও পোঁতা হয়ে গেল। কিন্তু চন্দ্রাবতী কথা সিনেমার অভিনেত্রী দিলরুবা দোয়েল নামের আগে ডিভোর্সি ও সিঙ্গেল মাদারের ট্যাগ লাগিয়েই যাত্রা শুরু করেছেন বিনোদন অঙ্গনে। পেশাজীবনে এগয়ে চলেছেন নিজের মেধা দিয়ে

‘কোত্থেকে শুরু করি বলুন তো? উচ্চমাধ্যমিক পড়ার সময় পালিয়ে বিয়ে করেছিলাম। সংসার সুখের হয়নি। যৌথ পরিবারে থাকতাম। নিয়মিত কিল–ঘুষি খেতাম। তারপর ঘর থেকে বের হয়ে সুখী সুখী মুখ করে সবার সঙ্গে কথা বলতাম। আসলে বলতে বাধ্য হতাম। হঠাৎ টের পেলাম আমি অন্তঃসত্ত্বা। তখন আমার জীবনের একটাই লক্ষ্য, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে পাস করা।’

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে দোয়েল যখন এসব বলছেন, বারবার চোখ ভরে উঠছে জলে। মুখের রেখায় রেখায় ফুটে উঠছে ব্যথার ছাপ। সন্তান পেটে নিয়ে রংপুরে হোস্টেলে থেকেছেন, পরীক্ষা দিয়েছেন। মা হয়েছেন। আর সহ্য করতে না পেরে যেদিন সন্তান নিয়ে সেই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসছেন, সেদিন গেটে তাঁর ব্যাগ চেক করা হয়েছিল। শ্বশুরবাড়ি থেকে কিছু চুরি করে নিয়ে যাচ্ছেন কি না, তা দেখতে।

দোয়েল চাকরির পাশাপাশি সমানতালে চালিয়ে যাচ্ছেন অভিনয় ও মডেলিং

এরপর দোয়েলের বাবার বাড়িতেই বড় হতে থাকল তাঁর ছেলে মাশরিক। স্কুলে ভর্তি হলো। স্কুলে বন্ধুরা, বন্ধুর মা–বাবারা তার বাবার কথা জিজ্ঞেস করত। তাই ২০১২ সালে ছেলের পঞ্চম জন্মদিনে দোয়েল ছেলের বন্ধু ও অভিভাবকদের সঙ্গে ছেলের বাবাকেও দাওয়াত দিলেন। ছেলের বাবা এলেন, দাওয়াত খেলেন, পরদিন ছেলেকে চুরি করে নিয়ে চলে গেলেন ঢাকার সাভারে। ছেলেকে না পেয়ে পাগলের মতো হয়ে গেলেন দোয়েল। নানা লোকের নানা পরামর্শ। যে যা বলে তাই করেন দোয়েল। তবু ছেলে ফোন করে না, ফিরে আসে না। একজন বোতলের পানিতে ‘মন্ত্র পড়ে’ ফুঁ দিয়ে বলল সেটা যমুনা নদীতে ফেলতে। নির্ঘুম রাত কাটিয়ে ভোরে দোয়েল ৫০০ টাকা নিয়ে এলাকার একজনের মোটরসাইকেলে চড়ে যমুনা সেতুর ওপর থেকে সেই বোতল ফেললেন নদীতে। দোয়েল ঢাকায় চলে এলেন। উঠলেন বড় বোনের বাসায়। সারা দিন ঘরে দরজা বন্ধ করে থাকেন, চিৎকার করেন, কাঁদেন, কারও বাচ্চা দেখলে দৌড়ে যান, অদ্ভুতভাবে জড়িয়ে ধরেন।

সে রকমই একদিনে ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে দোয়েলের ছবি ছাপা হলো প্রথম আলোর মঙ্গলবারের ক্রোড়পত্র নকশায়, মডেল হিসেবে। হল্টার নেকের হাতাকাটা ব্লাউজে কোঁকড়া চুলের দোয়েল। যাঁর দৃষ্টি বাইরের পৃথিবীর দিকে। সেই সন্ধ্যাতেই ফোন করল দোয়েলের ছেলে। ফোন করেই গালাগালি, ‘ছি মা, তুমি এত নোংরা কাজ করো! তুমি নষ্টদের খাতায় নাম লিখিয়েছ!’ আরও নানা কুৎসিত গালি, দোয়েলের সেগুলো মনেও নেই, মনেও রাখেননি। সেসব যে তাঁর স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির মানুষদের শিখিয়ে দেওয়া।

এরপরই দোয়েল তাঁর বাবাকে বলেন, তিনি কাগজে–কলমে বিচ্ছেদ চান। এ রকম সময়েই আসে একটা ফোনকল। ওপ্রান্তে তাঁর স্বামী, ‘তোমার ছেলেকে যদি বাঁচাতে চাও, তো ঝিনাইদহ থেকে নিয়ে যাও।’ পরিবারের লোকজনসহ দোয়েল সেখানে গিয়ে দেখলেন পুরো জায়গাটা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঘিরে রেখেছে। সেখান থেকে ছেলেকে উদ্ধার করে নিয়ে এলেন ঢাকায়। এরপর বিচ্ছেদ প্রক্রিয়া শুরু করলেন।

সন্তান মাশরিকের সঙ্গে মা দোয়েল

নতুন জীবনে ফিরে এলেন দোয়েল। আলফা সিনেমায় দুর্দান্ত অভিনয় করলেন। ‘নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু যখন তাঁর সিনেমার জন্য আমাকে চাইলেন, আমার মনে হয়েছিল, তাঁদের কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে! আমি সত্যি শুনছি তো? এই সিনেমায় অভিনয় করতে গিয়ে আমি প্রথমবারের মতো মাতৃত্ব অনুভব করলাম। কেননা, সত্যি সত্যি যখন মা হয়েছি, তখন এত মানসিক চাপের ভেতর ছিলাম যে ওসব আর অনুভব করার সুযোগ হয়নি। শুধু মনে হতো, কবে বাচ্চা বের হবে, আর কবে আমি ফ্রি হব। এখন ছেলে আমার অভিনয়ের প্রশংসা করে। এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে।’

রাজধানীতে বাসা ভাড়া নিয়ে দোয়েল সন্তানকে নিয়ে থাকা শুরু করলেন। ছেলেকে ভারতের কালিম্পংয়ের বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করালেন। করোনা মহামারির আগে আগে ছেলে চলে আসে ঢাকায়। এই তার পড়াশোনা চলল ঢাকার একটি স্কুলে। শিগগিরই ছেলে আবার চলে যাবে কালিম্পং।

ঢাকায় দোয়েল চাকরি করেন, এর ফাঁকে ফাঁকে চলে অভিনয়। বিজ্ঞাপন, ফটোশুটসহ নানা কাজের ভেতর ব্যস্ত থাকেন। আবার বিয়ে করবেন কি না, এমন প্রশ্ন শুনেই বললেন, ‘আবার! পাগল নাকি? যে অভিজ্ঞতা হয়েছে... আমি এখন কেবল প্রতিদিন আরও শক্তিশালী হয়ে সামনে এগিয়ে যেতে চাই। এখন আমি নিজের গল্প নিজেই লিখব। যে গল্পে পরাজয়ের কোনো জায়গা নেই।’