দেয়ালে নারীর অর্ধশত রঙিন স্বপ্ন

‘জন্ম দিলাম, স্তন্য দিলাম, তবুও সোনা আমার নয়। এ কেমন আইন দেশের, এ আইন তো মানার নয়।’ দৃক গ্যালারির একটি প্রদর্শনী কক্ষের প্রবেশ দরজার সামনেই লেখা এ দুটি বাক্য। ভেতরে ঢুকতেই দেখি বড় বড় ব্যানারে ঝুলছে বেগম রোকেয়ার কথা— ‘পৃথিবী থেকে দাস ব্যবসা উঠিয়া গিয়াছে শুনিতে পাই, কিন্তু আমাদের দাসত্ব গিয়াছে কি?’ ‘আমরা অকমর্ণ্য পুতুল জীবন বহন করিবার জন্য সৃষ্ট হই নাই, একথা নিশ্চিত’, ‘একবার একই সঙ্গে সকলে স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হও, সময়ে সবই সহিয়া যাইবে’। দেয়ালে দেয়ালে সাঁটা প্রায় অর্ধশত চিত্রশিল্প। ছবির বিষয় ‘নারীর স্বপ্ন’। কারা এঁকেছে ছবিগুলো? এই প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই লুকিয়ে, কেন এই প্রদর্শনী আর দশটা প্রদর্শনী থেকে আলাদা। কেননা, ছবিগুলোর জন্ম কোনো পেশাদার চিত্রশিল্পীর হাতে হয়নি। হয়েছে, দেশের বিভিন্ন বয়সের নারীদের রংতুলিতে।

ছবিগুলোর জন্ম কোনো পেশাদার চিত্রশিল্পীর হাতে হয়নি। হয়েছে, দেশের বিভিন্ন বয়সের নারীদের রংতুলিতে
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

উপস্থিত দুই দর্শককে তুমুল আগ্রহে একটি ছবির মানে বুঝিয়ে দিচ্ছেন একজন নারী। নাম জানতে চাইলে বললেন সামিহা নদী। থাকেন রাজধানীর ঝিগাতলায়। প্রায় প্রতিদিনই সময় করে একবার ঢুঁ দিয়ে যাচ্ছেন। এই প্রদর্শনীতে তাঁর তিনটি চিত্রকর্ম ঠাঁই পেয়েছে। যে ছবিটি নিয়ে আলাপ চলছে, এর নাম ‘মেটাসাইকোসিস’। ছবিটি দেখিয়ে আবার বলা শুরু করলেন গোড়া থেকে, ‘জীবনানন্দ দাশের একটা কবিতা আছে না, ‘আবার আসিব ফিরে’? ছবিটি সেখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে একজন নারীর ভাবনা আর বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে আঁকা। এই যে দেখছেন দুটো হাত দুটিকে টানছে...একটি হাত নারীকে ওপরে তুলতে চায়। আরেকটি হাত নিচে নামাতে চায়। প্রায়ই নিচে নামানোর হাতটিই থাকে শক্তিশালী। নারীর অবস্থান এই দুই হাতের মাঝখানে।

এই যে নারী মা, মেয়ে, বউ...নানা সত্তা। এর বাইরেও তাঁর একটি সত্তা আছে। সেখানে সে কেবলই তার মতো হতে চায়

এই যে নারী মা, মেয়ে, বউ...নানা সত্তা। এর বাইরেও তাঁর একটি সত্তা আছে। সেখানে সে কেবলই তার মতো হতে চায়। সেও মা, মেয়ে, বউয়ের বেশ ছেড়ে একটা স্বাধীন শঙ্খচিলের বেশে ফিরতে চায়। কলমির গন্ধভরা জলে ভেসে ভেসে ফিরতে চায়। এই অন্যভাবে ফিরে আসার স্বপ্ন আর বাস্তবতার উপস্থিতিকে পাশাপাশি রেখে আমি জন্মাতরবাদের মাধ্যমে প্রকাশ করেছি।’ প্রদর্শনীতে তাঁর আরও দুটো ছবি আছে, তবে সেই দুটো ডিজিটাল পেইন্টিং। একটার নাম ‘দ্য স্ট্রেচ মার্কস’, আর তৃতীয়টি ‘হিপ্পি গার্ল’। ‘দ্য স্ট্রেচ মার্কস’–এ নারীর সন্তান জন্ম দেওয়ার পর শরীরে যে দাগ হয়, সেটির ভেতরেই নদী এঁকেছেন সোনালি বাংলাদেশের মানচিত্র। আর ‘হিপ্পি গার্ল’–এ নারী কোনো ‘মেল গেজ’ (পুরুষের দৃষ্টি), প্রশ্ন, দুশ্চিন্তা বা ভ্রুকুটির সম্মুখীন না হয়ে নিজের মতো স্বাভাবিকভাবে ঘুরে বেড়াতে চায়, সেই বিষয়টি উপস্থাপিত হয়েছে।

প্রতিটি ছবিই এ রকম নানা মানে নিয়ে দর্শকদের সঙ্গে কথা বলেছে। সেসব কথার মানে খুব সহজেই বুঝে যাওয়ার কথা নারী দর্শকের। তাই তো উপস্থিত দর্শকদের আড্ডায় শোনা গেল—একজন পুরুষ বলছেন, ‘নারীর জীবন কত বর্ণময়। আমাদের গল্পে এত রং, বাঁক থাকে না।’

যে ছবি যেখানে রাখলে এর মানে সবচেয়ে সহজভাবে বোঝা যায়, সেটাকে সেখানেই স্থান দেওয়া হয়েছে

এই প্রদর্শনীর কিউরেটর তাইরায়া ফারহানাও এক পাশে বন্ধুদের সঙ্গে আলাপে মেতেছেন। জানালেন, যে ছবি যেখানে রাখলে এর মানে সবচেয়ে সহজভাবে বোঝা যায়, সেটাকে সেখানেই স্থান দেওয়া হয়েছে। এ রকমও হয়েছে, কয়েকটি ছবি পাশাপাশি রাখায় সেগুলো এককভাবে ছাড়াও সম্মিলিতভাবে গভীর কোনো বার্তা দিচ্ছে। পেশায় আলোকচিত্রী আহাদুল সিরাজ এসেছিলেন প্রদর্শনী দেখতে। তাঁর কাছে জানতে চাইলাম প্রদর্শনী কেমন লাগল? বললেন, ‘ভালো। বিদেশি নারীবাদীদের ইংরেজি উক্তির বদলে বেগম রোকেয়ার কথাগুলো থাকায় বেশি ভালো লেগেছে। এর মানে হলো, আয়োজকেরা তাঁদের শিকড় ভোলেননি। ছবিগুলো বৈচিত্র্যময়। পেশাদার হাতে হয়নি। তাই ছবিগুলোর সঙ্গে সাধারণ দর্শকের যোগাযোগ সহজ হয়েছে।’

নারীপক্ষ আয়োজিত ‘নারীর স্বপ্ন প্রদর্শনী’টি চলে ৯ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত। অনেক ছবি থেকে সেরা ৫০টি ছবি বাছাই করেছে চারজনের একটি দল। সেই দলে ছিলেন খুশি কবির, লিজা হাসান, নাসরিন সুলতানা মিতু ও রোকেয়া সুলতানা।

আজ শেষ হয়ে যাচ্ছে বছরটা। এই প্রদর্শনীটি শেষ হয়েছে আরও আগে। কিন্তু নারীর এসব বর্ণিল গল্প শেষ হবার নয়।

নারীর এসব বর্ণিল গল্প শেষ হবার নয়