ভয়ের রাজ্যে গলার স্বর উঁচুতে চড়ে না। কেবল ফিসফিসিয়ে বলা, আর সন্তর্পণে চলা। কারণ দেয়ালেরও ‘কান’ আছে। কিছু একটা টের পেলেই খবর ছুটবে কারও কাছে। তাই ঝুঁকি অনেক। অথচ বছর তিনেক আগে এই ‘কান পাতা’ দেয়ালেই ভাষা ফোটানোর স্পর্ধা দেখিয়েছিল ‘সুবোধ’ নামের এক ফেরারি যুবক। কারণ, সময়টা তার পক্ষে যাচ্ছিল না। তাই সে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল। আর চিত্রে–বার্তায় সেই পলায়নের চিহ্ন রেখে যাচ্ছিল নগরের দেয়ালে দেয়ালে।
ঢাকার দেয়ালে প্রতিবাদী দেয়ালচিত্র গ্রাফিতি আঁকার সেই শুরু। প্রথম দিকে ধানমন্ডি, আগারগাঁও ও মিরপুরের দেয়ালে আঁকা সুবোধ কখনো ছিল হাতে বাক্সবন্দী সূর্য নিয়ে পালাতে উদ্যত, কখনো জেলে বন্দী, কখনো হতাশায় নুইয়ে পড়া এক মানুষ। সঙ্গে লিখিত বার্তা ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, সময় এখন পক্ষে না’। আবার কিছুদিনের মধ্যেই সুবোধ হাজির হয় আশাবাদের প্রতীক হিসেবে। সেখানে তাঁর সঙ্গী ছিল এক কন্যাশিশু, একটা মোরগ আর খাঁচাবন্দী সেই সূর্যটা। বন্দী সূর্যটার দিকে তাকিয়ে প্রাণপণে ডেকে যাওয়া মোরগটি জানান দিচ্ছিল ভোরের আকাঙ্ক্ষার। এই সিরিজের প্রতিটি দেয়ালচিত্রের লোগো আকারে ব্যবহার করা হয় একটা শব্দ: ‘হবেকি?’ (HOBEKI?)।
সুবোধের এই দেয়ালচিত্রগুলো প্রকাশের পর থেকেই তা অনেক মানুষের আগ্রহের বিষয়ে পরিণত হয়। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে চিত্রগুলো। সেখানে অনেকেই কৌতূহলী হয়ে ওঠেন সুবোধ এবং এর আঁকিয়ে কিংবা আঁকিয়েদের পরিচয় জানতে। সুবোধ উঠে আসে অনেক তরুণের টি–শার্টে। এদিকে ঢাকার দেয়ালে আঁকা ‘সুবোধ’ সিরিজের গ্রাফিতিগুলোর অনুপ্রেরণায় কলকাতার প্রেসিডেন্সি ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা তাঁদের ক্যাম্পাসে চিত্রিত করেন একাধিক গ্রাফিতি। ওই শিক্ষার্থীরা ঢাকার ‘সুবোধ’কে হাজির করেন তাঁদের দাবি আদায় ও অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতীক হিসেবে। ২০১৭ সালের ২০ আগস্ট সুবোধের দেয়ালচিত্রগুলো নিয়ে ভারতের ইংরেজি দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ তাদের সাময়িকী ‘সেভেন ডেজ’-এ ‘হবেকি? (HOBEKI?)’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদনও প্রকাশ করে।
এই ধারাবাহিকতায় গত বছরের এপ্রিলে কাকলী পদচারী-সেতুর পূর্ব দিকের ফুটপাত-সংলগ্ন সাদা দেয়ালের জমিনে আঁকা হয় লাল–সবুজের পতাকা আঁকড়ে ধরে রাখা বিষাদগ্রস্ত এক কিশোরীর অবয়ব। ছবির পাশে লেখা ছিল ‘দিস ইজ মাই মাস্টারপিস (এটা আমার শ্রেষ্ঠ কর্ম)’। এই দেয়ালচিত্রে বিরূপ সময়ের বার্তা নিয়ে হাজির হওয়া সুবোধের উপস্থিতি ছিল না। কিন্তু এর অঙ্কনপদ্ধতি ছিল একই রকম। সুবোধ সিরিজের চিত্রগুলোর মতো এটাও আঁকা হয়েছিল স্টেনসিল (লেখা বা আঁকার জন্য ছিদ্রময় পাত) ব্যবহার করে।
সুবোধের আলোচিত এই সিরিজের পর ঢাকার দেয়ালগুলো ভরে উঠতে থাকে একের পর এক গ্রাফিতিতে। কোনো নির্দিষ্ট ঘটনার পরপর নিশ্চুপ দেয়ালে আঁকা বিষয়ভিত্তিক এই চিত্রগুলো হাজির হয় নতুন নতুন বার্তা নিয়ে। বছরখানেক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল ও রোকেয়া হলের দেয়ালে আঁকা দুটি গ্রাফিতি ব্যক্তিপরিসর ছাড়িয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা ছড়িয়েছিল। এর একটি মূর্ত করে তুলেছিল সিংহাসন ফুটো করে বেরিয়ে আসা একটি পেনসিলের চোখা প্রান্ত। পাশে লেখা ছিল, ‘উফ্!’ আরেকটি চিত্র বাংলাদেশের মানচিত্রের ওপর রাখা ছিল রিমান্ড কক্ষের বাতি। পাশে মোটা হরফে লেখা ছিল, ‘বাংলাদেশ রিমান্ডে’।
কাছাকাছি সময়ে ওই দেয়াল দুটিতেই আঁকা হয়েছিল ‘সহমত ভাই’ ও ‘হেলমেট ভাই’ নামের দুটি আলাদা গ্রাফিতি। দর্শনার্থীরা ‘সহমত ভাই’কে সংযুক্ত করেছিলেন সমাজে বিদ্যমান তোষামোদির চর্চার সঙ্গে। আর ‘হেলমেট ভাই’ সম্পর্কে তাঁদের মূল্যায়ন ছিল, এরা তোষামোদির চর্চাকারীদের পক্ষে কাজ করা পীড়নকারীদের দল। একই সময়ে রোকেয়া হল ও আজিজ কো–অপারেটিভ সুপার মার্কেটের দেয়ালে ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ড ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দাবি করে আঁকা দুটি গ্রাফিতিও আলোচিত হয়।
সর্বশেষ মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দেয়ালে দেয়ালে আঁকা প্রতিবাদী চিত্রে ফুটে ওঠে নির্যাতনে নিহত ও গুরুতর আহত সব শিক্ষার্থীর মুখ। এখন আবু বকর, এহসান রফিক, হাফিজুর মোল্লা ও আবরার ফাহাদের মুখচ্ছবি মনে করিয়ে দিচ্ছে ছাত্ররাজনীতির নামে চলা নির্যাতন–নিপীড়নের নৃশংস সব ঘটনা।