>রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি—চারটি ক্ষেত্রে চার তরুণ লিখছেন ভবিষ্যতের বাংলাদেশ সম্পর্কে। আজকের বিষয় সমাজ
বদলাচ্ছে সমাজ, বদলাচ্ছে রাষ্ট্র, বদলাচ্ছে দেশ। গড়ে উঠছে আকাশচুম্বী দালান, শপিং মল, আলোয় উজ্জ্বল খাবারের দোকান। নক্ষত্র ছুঁয়ে ছুটে যাচ্ছে উড়ালসেতু। কারখানার দিকে ছুটে যাচ্ছে শ্রমিকের দল। ধানখেত ভেঙে কোমর সোজা করে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে ফ্ল্যাট বাড়ির বহর। মানে, পরিবর্তন এসেছে।
তারপরও প্রশ্ন থাকে, কোন উচ্চতায় দাঁড়াতে যাচ্ছে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ? কীভাবে ঘটছে আমাদের সমাজের রূপান্তর? খুব সহজ নয় এসব প্রশ্নের জবাব। পঞ্জিকা মিলিয়ে নিশ্চয়তা দিয়ে কেউ কি বলতে পারেন, হ্যাঁ, ঠিক এ রকমই ঘটবে? পারেন না। আমরা তবু সমাজ ও রাষ্ট্রের রূপান্তরের কথা ভাবি; ভাবতে গিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রকে নানা অভিধায় চিহ্নিত করি। আমাদের মনের চোখে দুলতে থাকে ভবিষ্যৎ। এই ভবিষ্যৎ সমাজকে ঘিরে। সমাজকে ঘিরে বলেই তা রাষ্ট্রকে ঘিরেও। কেননা, সমাজের রূপান্তর ছাড়া রাষ্ট্রের রূপান্তর ঘটে না।
রাষ্ট্র কখনো কখনো আইন ও নীতি দিয়ে সামাজিক রূপান্তরের ধারাকে বাঁধতে চায়। কিন্তু সব সময় তা পেরে ওঠে না। যদি তা পারত, তাহলে বাংলাদেশের জন্ম হতো না। সমাজে তৈরি হওয়া অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। এই রাষ্ট্রের ভেতর দিয়েই কৃষক চেয়েছেন জোতদারদের হাত থেকে মুক্তি, শ্রমিক চেয়েছেন শ্রমের যথার্থ মূল্য ও মর্যাদা, শহুরে মধ্যবিত্ত চেয়েছেন চাকরি, চিন্তা ও কাজের স্বাধীনতা, ধনিক শ্রেণি চেয়েছে আপন পুঁজির বিস্তার। মধ্যবিত্তের মন থেকে গড়ে ওঠা জাতীয় চেতনার পাটাতনে প্রায় সব শ্রেণি শামিল হয়ে তৈরি করেছে নতুন রাষ্ট্র—বাংলাদেশ।
প্রশ্ন হলো, প্রায় অর্ধশতকের কোঠায় পৌঁছে যাওয়া এখনকার এই বাংলাদেশের সমাজে কী ধরনের রূপান্তর ঘটছে? এই রূপান্তর কোন সম্ভাবনা ধারণ করে? মনে রাখতে হবে, একই রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে থাকা সত্ত্বেও সমাজের চেহারা এক নয়, বহু। বাঙালি কৃষক, নাগরিক মধ্যবিত্ত ও আদিবাসী সমাজের মধ্যকার পার্থক্য তাই চোখে পড়ে। সব সমাজের রূপান্তর একইভাবে ঘটছে না। শিক্ষা, বিত্ত ও সামাজিক অবস্থানের ভিন্নতা সামাজিক রূপান্তরেও ভিন্নতা তৈরি করছে। তবে সব ধরনের সমাজের রূপান্তরে প্রভাববিস্তারী হয়ে উঠেছে সম্ভবত প্রযুক্তি। যার ছায়াপাত ঘটেছে কৃষকের সংস্কৃতিতে, চাষাবাদে। মধ্যবিত্তের বড়ো অংশের মনন ও চিন্তার চর্চা এখন প্রযুক্তিনির্ভর। যা কিছু তারা প্রকাশ করছে, ভাবছে, তার সবকিছুই প্রযুক্তির সহায়তায় সমৃদ্ধ। শিক্ষা ও পাঠদানের সামগ্রিক পদ্ধতিতে প্রযুক্তি এনেছে পরিবর্তন। শিক্ষাদানের জন্য বাংলাদেশের অপরাপর ভাষাভাষীর জন্য তৈরি হচ্ছে বইপুস্তক ও ডিজিটাল কনটেন্ট। ধারণা করা যায়, প্রযুক্তির প্রয়োগ আরও বাড়বে।
মূলত বিশ্বজুড়েই প্রযুক্তি জাঁকিয়ে বসেছে। সেই ধারাতেই এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় ভার্চুয়াল সমাজও একধরনের সমাজ। এটি কেবল সমাজের ধারণাগত রূপান্তর নয়। কেননা এই সমাজ প্রভাবিত করছে দৃশ্যমান সমাজকেও। ভার্চুয়াল সমাজে তৈরি হওয়া আন্দোলন ও আলোড়নের প্রভাব দেখতে পাচ্ছি দৃশ্যমান সমাজে। অর্থাৎ চিন্তা ও মতপ্রকাশের বড়ো একটি জায়গা হয়ে উঠেছে অনলাইন স্পেস। যেখান থেকে সহজে কথা বলা যায়, চিন্তাকে ভাগ করা যায়। এ অর্থে সাইবারজগৎ অনেক বেশি গণতান্ত্রিক। রাজনীতির গণতন্ত্রে এর একটি প্রভাব ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই পড়বে।
সমস্যা দেখা দেয় তখনই, যখন ভার্চুয়াল জগৎটিকে ভাবা হয় ‘খেয়াল-খুশির’ জগৎ, যা খুশি তা-ই বলার ও লেখার দুনিয়া। তখন সেটি আর ইতিবাচক থাকে না, তর্ক গড়িয়ে পড়ে কুতর্কের খাপছাড়া সড়কে। নিজেকে প্রদর্শনের বাতিক তৈরি করে চূড়ান্ত ব্যক্তিকতা। এই ব্যক্তিকতা সমাজকে বিভক্ত করে। আমরা যদি সত্যিকার অর্থে রাষ্ট্রের কথা ভাবি, তাহলে ভাবতে হবে প্রত্যেক ব্যক্তির নিজস্ব ভূমিকার কথা।
আমাদের কেউ বলতেই পারেন, আজকের সমাজ উন্নয়নমুখী—আয় বাড়ছে, ক্ষুধার অবসান ঘটছে, দারিদ্র্য বিমোচন ঘটছে। অপর কেউ হাজির করতে পারেন এর উল্টো ছবি। বলতে পারেন, এ সমাজে বৈষম্য বাড়ছে; দেখাতে পারেন, দুর্নীতির রাশি রাশি প্রমাণ। আর কেউ বলতে পারেন, এ সমাজ পণ্যের ভোগের। পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, বিনোদন, শিক্ষা, অবসর—সবকিছুই আজ ভোগ্যপণ্যের সারিতে শামিল। তাঁদের সবাই কিন্তু কথা বলছেন একটি মাত্র রাষ্ট্রকে ঘিরে, কথা বলছেন রাষ্ট্রের ভেতরে থাকা বহু বহু সমাজকে ঘিরে। প্রতিটি পক্ষ সমাজ ও রাষ্ট্রকে যার যার মতো করে বুঝতে চাইছে। তাদের নিশ্চয়ই সমাজ ও রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আকাঙ্ক্ষাও আছে। বাসনার বাস্তবায়নের পথ হয়তো ভিন্ন। কিন্তু বাসনার কেন্দ্রে কে? রাষ্ট্র ও জনগণ আছে তো?
রাষ্ট্র একটি ‘রাজনৈতিক ব্যবস্থা’ বলে রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বের ভূমিকা এখানে প্রবল থাকে। ফলে সেখানে রাজনৈতিক মতাদর্শের পার্থক্যে নীতিগত দ্বন্দ্বও তৈরি করে। আর তখনই দরকারি হয়ে ওঠে সমাজের ভূমিকা। সমাজে থাকা প্রতিটি ব্যক্তিমানুষের সম্পর্ক সব সময় রাজনৈতিক মতাদর্শে নিয়ন্ত্রিত থাকে না। সমাজ চলে পরস্পরনির্ভরতায়। তাই সমাজের ভেতর থেকে নতুন আকাঙ্ক্ষার গন্তব্য ও কণ্ঠস্বর প্রস্তুত করা সম্ভব।
কিন্তু আজকের সমাজে নির্ভরতা কি কমে আসছে? ভার্চুয়াল সমাজকেই প্রত্যক্ষ সমাজ বলে ভুল করছি না তো? দুটো সমাজের লক্ষ্য কি রাষ্ট্রকে সমৃদ্ধ করার দিকে নিয়ে যাচ্ছে? অনেকাংশে মনেই হয়, সমাজে নির্ভরতার জায়গা কমে যাচ্ছে। একলা চলার নীতিতে ঢুকে যাচ্ছি আমরা। ভার্চুয়াল সমাজের হিংসা ও অহমিকাগুলোকে ঢেলে দিচ্ছি প্রত্যক্ষ সমাজে। সম্ভবত ভুলে যাচ্ছি, আধুনিক সমাজের বড় একটি কাজ রাষ্ট্রের পুনর্গঠন। এটাও ঠিক যে বাংলাদেশ রাষ্ট্র নিয়ে আমাদের নানা আক্ষেপ আছে। জনযুদ্ধের ফসল এ দেশে রাজনৈতিক বাসনার অনেক কিছুর বাস্তবায়নই বাকি আছে। তাই বলে রাষ্ট্রের সমালোচনা করতে গিয়ে রাষ্ট্রকেই উপেক্ষা করে বসছি না তো? মনে রাখার ব্যাপার এই যে সমাজ ও রাষ্ট্রের রূপান্তরে ব্যক্তি-আমিরও ভূমিকা আছে।
সমাজ একা একা বদলায় না। বদলায় না রাষ্ট্রও। ব্যক্তিমানুষের সামষ্টিক কর্মকাণ্ডের যোগফলেই রূপান্তর ঘটে থাকে। বাংলাদেশে সামাজিক শক্তির সবচেয়ে বড় উৎস এ দেশের তারুণ্য। তারুণ্যের ব্যক্তি-আমির ভেতরে নিহিত স্বপ্নগুলো জাগিয়ে তোলা একটি বিশেষ কর্তব্য। কেননা প্রত্যক্ষ ও ভার্চুয়াল দুই ধরনের সমাজে তাঁরাই সবচেয়ে বেশি সোচ্চার। সমাজ রূপান্তরের আকাঙ্ক্ষা তরুণদের মনে দানা বাঁধে সবচেয়ে আগে। তরুণ শক্তিকে ব্যবহার করা তাই সমাজ রূপান্তরের জন্য জরুরি। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে যেসব প্রশ্ন, আমরা তখনই তার মোকাবিলা করতে পারব, যখন সমাজ রূপান্তরে তারুণ্যের অংশগ্রহণকে ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করতে পারব।
সুমন সাজ্জাদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।