দেশের প্রথম নারী আলোকচিত্রী সাইদা খানম

শুরু ১৩-১৪ বয়সে। এই বয়সে বই ও খেলাধুলায় সময় বয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু এর পাশাপাশি তিনি এই সময়ে হাতে তুলে নিলেন ক্যামেরা। বলা হচ্ছে, সাইদা খানমের কথা, যিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী আলোকচিত্রী।

নিজের তোলা ছবি হাতে দেশের প্রথম নারী আলোকচিত্রী সাইদা খানম। ছবি: জাহিদুল করিম
নিজের তোলা ছবি হাতে দেশের প্রথম নারী আলোকচিত্রী সাইদা খানম। ছবি: জাহিদুল করিম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্য ও লাইব্রেরি সায়েন্সে মাস্টার্স করেন। বাবা আবদুস সামাদ খান, মা নাছিমা খাতুন। পৈতৃক বাড়ি ফরিদপুরের ভাঙায় হলেও জন্ম পাবনায়, ২৯ ডিসেম্বর ১৯৩৭ সালে। স্থিরচিত্রী হিসেবে শুরু করেন কাজ। সেই সময় পূর্ব বাংলায় (বর্তমান বাংলাদেশ) তিনিই ছিলেন একমাত্র ও প্রথম নারী আলোকচিত্রী।

‘বেগম’ পত্রিকার মাধ্যমে সাইদা খানম আলোকচিত্র সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। তাঁর ছবি ছাপা হয় ‘অবজারভার’, ‘মর্নিং নিউজ’, ‘ইত্তেফাক’, ‘সংবাদ’সহ বিভিন্ন পত্রিকায়। আলোকচিত্রী হিসেবে দেশেও দেশের বাইরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশ নেন তিনি।

অস্কারজয়ী সত্যজিৎ​ রায়ের ছবিও তোলেন সাইদা খানম। সত্যজিতের তিনটি ছবিতে আলোকচিত্রী হিসেবেও কাজ করেন তিনি। ছবিটি সাইদা খানমের পারিবারিক অ্যালবাম থেকে নেওয়া হয়েছে।



১৯৫৬ সালে ঢাকায় আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে অংশ নেন সাইদা খানম। ওই বছরই জার্মানিতে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড কোলন পুরস্কার পান তিনি। এর পরই বাংলাদেশে আলোচনায় আসেন। এরপর ভারত, জাপান, ফ্রান্স, সুইডেন, পাকিস্তান, সাইপ্রাস ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী হয়। জাপানে ইউনেসকো অ্যাওয়ার্ড, অনন্যা শীর্ষ দশ পুরস্কার, বেগম পত্রিকার ৫০ বছর পূর্তি পুরস্কার, বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটির সম্মানসূচক ফেলোসহ বিভিন্ন পুরস্কার ও স্বীকৃতি পান তিনি।

১৯৬২ সালে ‘চিত্রালী’ পত্রিকার হয়ে একটি অ্যাসাইনমেন্টে গিয়ে বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার ও অস্কারজয়ী সত্যজিৎ রায়ের ছবি তুলে সমাদৃত হন সাইদা খানম। পরে সত্যজিতের তিনটি ছবিতে আলোকচিত্রী হিসেবেও কাজ করেন তিনি।

১৯৭১ সালে ঢাকার আজিমপুরে অস্ত্র হাতে প্রশিক্ষণরত নারীদের ছবি তোলেন সাইদা খানম। সাইদা খানমের পারিবারিক অ্যালবাম থেকে ছবিটি তোলা।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে দেশের প্রথম নারী আলোকচিত্রী ঢাকার আজিমপুর এলাকায় অস্ত্র হাতে প্রশিক্ষণরত নারীদের ছবি তোলেন। ১৬ ডিসেম্বরে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের (পরে শেরাটন ও রূপসী বাংলা) সামনে পাকিস্তানি সেনারা গোলাগুলি শুরু করে। খবর পেয়ে নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে সেখানকার ছবি তুলতে যান তিনি। প্রচণ্ড গোলাগুলির কারণে সেদিন অবশ্য ছবি তুলতে পারেননি। সেদিন একজন নারী আলোকচিত্রী হিসেবে তাঁর সাহস দেখে সবাই বিস্মিত হন।

সাইদা খানমের বয়স এখন ৭৭। এ বয়সে এসেও ক্যামেরা ছাড়া তাঁর এক মুহূর্তও চলে না। যেখানেই যান, সঙ্গে নিয়ে যান ক্যামেরা। ক্যামেরার সঙ্গে তাঁর সংসার প্রায় ৬০ বছরের। বিয়ে না করা দেশের প্রথম এই আলোকচিত্রী থাকেন রাজধানীর বনানীতে। অবসরে গান শোনেন। ঠুমরি-গজলের সঙ্গে রবীন্দ্রসংগীতও তাঁর খুব পছন্দ।

মাদার তোরেসার এই ছবিটিও সাইদা খানমের পারিবারিক অ্যালবাম থেকে নেওয়া হয়েছে।



কালের বিবর্তনে নানা প্রযুক্তির ক্যামেরা এলেও এখনো সাইদা খানম ফিল্মের ক্যামেরাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। ডিজিটাল ক্যামেরা তাঁর কাছে মনে হয় ‘ফাঁকি দেওয়া’। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘তখনকার দিনে আমরা খেয়াল করতাম কখন রোদ আসবে, কী এক্সপোজার দেব। এখন তো শুধু ক্যামেরা ধরে রাখলেই হয়।’

ক্যামেরার ক্লিকের পাশাপাশি লেখালেখি করতেন সব সময়। উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে ‘ধূলোমাটি’, ‘স্মৃতির পথ বেয়ে’, ‘আমার চোখে সত্যজিৎ রায়’, ‘আলোকচিত্রী সাইদা খানম-এর উপন্যাসত্রয়ী’। তিনি বাংলা একাডেমি ও ইউএনএবির আজীবন সদস্য। ছবি তোলার পাশাপাশি এখন তাঁর দিন কাটে পড়াশোনা ও লেখালেখি করে।