ঈদ এলে কথা একটাই, বাড়ি যেতে হবে। এই শহর তাঁকে আর তখন টানে না। বাড়ি ফেরার পথের ঝক্কি আর তাঁকে ভাবায় না। যে শুটিং শেষে বিশ্রাম চাই-ই চাই, ঈদের আগে সেই শুটিং শেষে প্রতিদিন চলে একটু একটু করে কেনাকাটা, গোছগাছ। প্রতিদিন একটু একটু করে ভরতে থাকে স্যুটকেস। মন পড়ে থাকে বাড়িতে। শুটিং শেষের অপেক্ষা...কখন কপোতাক্ষপাড়ের গ্রামের বাড়ির উঠানে গিয়ে দাঁড়াবেন। ৩০০ কিলোমিটার দূর থেকেও নাকে এসে লাগে মায়ের বাড়া ভাত আর শষে৴র তেলের আলুভর্তার ঘ্রাণ। সেসব মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করেন অভিনেত্রী মৌসুমী হামিদ। বাড়ি গিয়েই সঙ্গে সঙ্গে মায়ের রান্না করা গরম ভাত তাঁকে খেতেই হবে, প্রতিবার। তারপর মাকে জড়িয়ে ঘুম। এসব ইচ্ছা পূরণ করতে গত বছর বাড়ি ফেরার জন্য কত কি–না করেছেন। এসব বাড়ির প্রতি টান আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু কী হয়েছিল গত বছর?
করোনার কারণে গত দুই বছর তাঁর মনটা ভীষণ খারাপ ছিল। বাড়ি কি যেতে পারবেন, এই সংশয়ে কাটত প্রতিটি মুহূর্ত। প্রথম বছর মন খারাপ করে ঢাকাতেই থেকে যেতে হয়েছিল। গত বছরও ঈদের বেশ কিছুদিন আগেই শুরু হয় লকডাউন। শেষ মুহূর্তে লকডাউন তুলে নেওয়া হলে আশার আলো দেখতে পান মৌসুমী, যাক মা–বাবা, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে গ্রামে ঈদ করা যাবে। কেনাকাটা শেষ, লাগেজ গোছানোও কমপ্লিট।
ঈদের আগের দিন নিজেই গাড়ি চালিয়ে সাতক্ষীরার পথে বেরিয়ে পড়লেন মৌসুমী হামিদ। সঙ্গে ছোট ভাই। গাড়িতে বাজতে থাকে ‘গ্রামছাড়া ওই রাঙামাটির পথ’। মনটা আনন্দে ভরে ওঠে, ভুলে যান তিনি একজন অভিনেত্রী। বদলে হয়ে ওঠেন গ্রামের সেই ছোট্ট কিশোরী, সারা দিন যে সাইকেল চালিয়ে গ্রামের এপাশ থেকে ওপাশে দাপিয়ে বেড়াত, বন্ধুদের নিয়ে ঝাঁপ দিত কপোতাক্ষের জলে, নদী থেকে মাছ ধরে রান্না করত, বন্ধুদের সঙ্গে নৌকা, সাইকেল চালানো নিয়ে মারামারি করত, খেলত গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্ধাসহ কত খেলা। ঠিক করে ফেলেন, বাড়ি গিয়ে সেই নদীর পাড়, চিংড়ির ঘের, আমবাগান, রাতে চড়ুইভাতি আর বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে শৈশবে ফিরবেন। জ্যাম ঠেলে ঠেলে ততক্ষণে পৌঁছে গেছেন মাওয়া রোডে। কিন্তু তারপর আর গাড়ি চলে না। এক জায়গায় আটকে থাকেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বসে থাকতে থাকতে একসময় কান্না চলে আসে। তখনো চিন্তা একটাই, যেভাবেই হোক বাড়ি যেতে হবে। সঙ্গে থাকা খাবারগুলো শেষ। তার সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে শত শত মোটরসাইকেল। ‘অভিমানে একসময় মনে হয়েছিল হেঁটে রওনা দিই। আম্মার কাছে ফোন দিয়েও মন খারাপ করেছিলাম। বাড়ি যেতে না পারলে মানসিকভাবেই আমি ভেঙে পড়ব। অনেকটা সময় ধৈর্য ধরে বসে থাকি। কাল ঈদ আর আমি ট্রাফিক জ্যামে আটকা। মনে হচ্ছিল, ইশ্, যদি ঘুম থেকে উঠে দেখতাম আমি বাড়িতে। কিন্তু আমাকে হতাশ হতে হয়,’ সেদিনের স্মৃতিচারণা করছিলেন মৌসুমী। প্রায় অর্ধেকটা দিন জ্যামে আটকে ছিলেন। ফেরি না পেয়ে ঘাটের পাশ থেকে ফিরে আসতে হলো। ছোট ভাই করোনার সময়ে তার কাছে এসে আটকে পড়েছিল। ভাইকে নিয়ে গ্রামে যাবেন, ঈদ করবেন সেই স্বপ্নটাই মাটি হয়ে গেল। কাল ঈদ। ঢাকা ফেরার পথে মনটা গ্রামেই পড়ে রইল। মা মেয়ে কে কাকে সান্ত্বনা দেবেন, বুঝে উঠতে পারছিলেন না।
ঢাকায় ফেরার পর প্লেনের টিকিট বিক্রেতাদের কাছেও ধরনা দিলেন। যশোরের কোনো টিকিট নেই। একপর্যায়ে আশাই ছেড়ে দিলেন। শেষে অনেক কষ্টে দুটি টিকিট পাওয়া গেল। ঈদের দিন ভোরে বাড়ির উদ্দেশে উড়াল দিলেন।
এই অভিনেত্রী বলেন, ‘অভিনয়ে যখন সেভাবে পরিচিতি পাইনি, তখন পাবলিক বাসে বাড়িতে যেতাম। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাসে বসে থাকতে হতো। এই অপেক্ষার মধ্যেও মজা ছিল। বাড়িতে গেলে আর কোনো ক্লান্তি থাকত না। কষ্টকে কষ্ট মনে হত না। এ যেন এক শান্তির নিশ্বাসের অপেক্ষা। হাঁপিয়ে ওঠা শুটিং থেকে বিরতি আর মায়ের সান্নিধ্য এনে দেয় অপার সুখ। কিন্তু গতবার ভীষণ ভয়ে ছিলাম আমি কি বাড়ি যেতে পারব? যদি ফ্লাইট মিস হয়ে যায়? মাওয়া থেকে ফিরে সারা রাত আর ঘুমাইনি। গ্রামে ফেরার আগপর্যন্ত চিন্তিত ছিলাম। এমনটা আমার কখনোই হয়নি।’
বাড়ি ফেরার জন্য কেন এই আকুলতা? এমন প্রশ্নের জবাবে মৌসুমী হামিদ বলেন, ‘মাটির টান, শিকড়ের টান। আমার পরিবার, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব—সবাই তো সেখানে থাকে। শুটিংয়ের ব্যস্ততায় বাড়ি যেতে পারি না। ঈদেই সবার সঙ্গে দেখা হয়। এই সময় বাড়ি ফেরাটা তাই আমার কাছে মনে হয় দায়িত্ব। এই যে পুরো দুটি লাগেজ ভর্তি করে সবার জন্য উপহার নিয়ে নিয়ে যাই আর আসার সময় লাগেজভর্তি করে সবজি, পছন্দের চাল, মাংস, মায়ের রান্না করা খাবার নিয়ে আসি—এটাই আমার জীবনের আনন্দ। যে কদিন থাকব কপোতাক্ষের পাড়ে সময় কাটাব, নদীতে মাছ ধরব, বন্ধু, ভাই, ভাবিসহ সবার সঙ্গে দারুণ সময় কাটবে। ফিরে পাব শৈশবের আনন্দ। এই আনন্দে বাধা দেওয়ার সাধ্য কারও নেই। এই টানেই এবারও বাড়ি যাওয়ার অপেক্ষায় আছি।’