একটা ভয়াবহ সময় কাটাচ্ছি আমরা। একদিকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ভয়, অন্যদিকে ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা। কবে করোনার হুমকি থেকে আমরা রেহাই পাব, জানি না। কবে নিরাপদে বের হওয়া যাবে, জানি না। কবে আমাদের জীবনযাপন স্বাভাবিক হবে, জানি না।
বুঝতে পারছি যে আমাদের জীবন ও জীবিকার ক্ষতি হবে। কিন্তু সেটা কতটুকু বা কত দিনের জন্য, সেটা বোঝার কোনো উপায় নেই। প্রচণ্ড মানসিক চাপের মধ্যে দিন কাটাচ্ছি আমরা কমবেশি সবাই। এমন একটা পরিস্থিতি, যার ওপর আমাদের প্রায় কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। করোনাকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না। কিন্তু নিজেদের পারব এবং নিজের স্বাস্থ্যের জন্য, শান্তির জন্য, পরিবারের জন্য, সমাজের জন্য আমাদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা এখন খুবই জরুরি।
কিছুদিন আগে খবরে পড়লাম, একজন বৃদ্ধার পরিবার তাঁর করোনা হয়েছে এই আশঙ্কায় তাঁকে জঙ্গলে ফেলে এসেছে। আমি নিশ্চিত যে বেশির ভাগ মানুষই এ রকমটা করবে না। তবে এ–ও সত্য, প্রচণ্ড সংকটের মুখোমুখি না হলে আমরা সেই পরিস্থিতিতে কী করব, সেটা বলা কঠিন। আমার বাসায় দুজন অতিবৃদ্ধ সদস্য আছেন। তাঁদের কিছু হলে আমি কী করব? তাঁদের আমি এখন নিরাপদে রাখছি তো? তাঁদের মানসিক ও শারীরিক দেখভাল করছি তো?
কীভাবে নিজের অজান্তেই আমরা আমাদের কাছের মানুষকে কষ্ট দিই তার একটা উদাহরণ দিই। সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক জানাজায় মানুষের ভিড় নিয়ে টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক আলোচনা হচ্ছে। অনেকেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লোকজনকে নিয়ে হাসাহাসি করছে। আবার অনেকে রাগও প্রকাশ করছে। আমার বাড়িতেও এ নিয়ে অনেক সমালোচনা হচ্ছে। এই সমালোচনার মধ্যে দেখলাম বাবার মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। রতনপুর গ্রামকে বাবা যারপরনাই ভালোবাসেন। আগে প্রায় প্রতি মাসে এক–দুবার যেতেন। সম্প্রতি শরীর খারাপ হয়ে যাওয়ার পর আর তেমন যেতে পারেন না। করোনার সময় তো আর নয়ই। তবে মন পড়ে থাকে সেখানে। প্রায় প্রতিদিন একবার করে ঘোষণা দেয় আমি কালকে রতনপুর যাচ্ছি। আমরা অনেক বুঝিয়ে–সুঝিয়ে তাঁকে ঠেকাই। তারপরও বাবার মন পড়ে থাকে রতনপুরে কৃষ্ণচূড়ার নিচের উঠানে।
বাবার সামনে ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে নিয়ে কথা বললে তাঁর মন চলে যায় রতনপুরে। মন খারাপ হয়ে যায়। গ্রামের জন্য মন কাঁদে। বুঝলাম যে আমার জন্য বিষয়টা একটা বস্তুগত হলেও বাবার জন্য অত্যন্ত আবেগময়। বাবার সামনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া নিয়ে কথা বলে তাঁর মনটা খারাপ করে দিচ্ছি। এই মানসিক চাপের মধ্যে এসব ব্যাপারে আমার আরও সতর্ক থাকতে হবে। আরেকটু সংবেদনশীল হতে হবে।
তবে ভালো লাগছে যে এ সময় অনেকেই কাছের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে দিচ্ছে। শারীরিক দূরত্ব বেড়ে যাওয়ার কারণে মানসিক দূরত্ব কমে আসছে অনেক ক্ষেত্রেই। অনেকেই ফোন করছে, মেসেজ করছে আমার খোঁজখবর নিতে। অনেক বন্ধু, আত্মীয়স্বজন, যাঁদের সঙ্গে বলব বলব করে অনেক দিন কথা হয় না, তাঁদের সঙ্গে কথা হচ্ছে।
পয়লা বৈশাখে আমার সহধর্মিণী আমাদের দুই পরিবারের সবাইকে নিয়ে একটা গ্রুপ ভিডিও কল করল। সবাই আমরা দাওয়াতের পোশাক পরে ফোনেই অনেক হইহুল্লোড় করলাম। মনে হলো আমরা সবাই একসঙ্গে আছি। আমার এক প্রিয় বন্ধু ম্যানিলায় থাকে। ওখানে লকডাউনের পর ও নিয়মিত বিভিন্ন দেশে থাকা বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে ভিডিও কলে আড্ডার আয়োজন করছে। করোনার পরের এক মাসে ওর সঙ্গে যত আড্ডা হয়েছে, তার আগে এক বছরে হয়েছে কি না, আমার সন্দেহ।
এ ছাড়া দেখে ভালো লাগছে যে অনেকেই তাঁদের নিজ নিজ জায়গা থেকে বিপদে পড়া মানুষের জন্য হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। কেউ আর্থিক সাহায্য করছেন। কেউ খাদ্য অনুদান দিচ্ছেন। কেউ স্বাস্থ্যকর্মীদের সাহায্য করছেন। তবে এখানে একটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, সেটা হলো বাইরের মানুষের পাশাপাশি আমরা যাতে আমাদের নিজেদের আত্মীয়স্বজনের আর্থিক কষ্টের কথাটাও মাথাই রাখি। পড়শির খোঁজ নেই। এমন হতে পারে যে আমাদের অনেক আত্মীয়স্বজন আর্থিক কষ্টে আছেন। তাঁদের উপার্জন বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু সেটা তাঁরা বলতে পারছেন না। সমাজের সব স্তরের দুরবস্থা দেখে হয়তো নিজের পরিবারের ভেতর কষ্ট উপেক্ষিত হতে পারে। এ রকম হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে এ রকম যাতে না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
সাময়িকভাবে হলেও করোনা আমাদের শিখিয়ে দিচ্ছে পরস্পরের প্রয়োজনীয়তা। আমরা বুঝতে পারছি আমাদের একে অপরকে কতটা প্রয়োজন। এই টান এই সংবেদনশীলতাই হয়তো আমাদের এই বিপদের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখবে। তবে বিপদ কেটে যাওয়ার পরও যাতে আমরা এই অনুভূতি, এই উপলব্ধি কিছুটা হলেও ধরে রাখি।
সবার সুস্থতা কামনা করছি।
লেখক: অভিনেতা