দুর্গম পথে ইচ্ছাপূরণের যাত্রা

নাফাখুম–অমিয়াখুম যেতে পার হতে হয় এমন অনেক পাহাড়ি নদী। ছবি: ফারিহা জান্নাত
নাফাখুম–অমিয়াখুম যেতে পার হতে হয় এমন অনেক পাহাড়ি নদী। ছবি: ফারিহা জান্নাত

বান্দরবানের নাফাখুম-অমিয়াখুম ঝরনা ঘুরে আসার ইচ্ছা অনেক দিনের। একদল ভ্রমণসঙ্গী, অর্থ আর সময়—এই তিনের চক্করে যাওয়াটাই যেন দুষ্কর হয়ে উঠেছিল। অবশেষে সেই তিনের সম্মিলন হলো অক্টোবরে! 

ঢাকা থেকে রাতের বাসে উঠেছিলাম আমরা ১২ জন। ভোরে বান্দরবান। নাশতাটাশতা সেরে সেখান থেকে রওনা দিলাম বান্দরবানের থানচির উদ্দেশে। অর্ধেক রাস্তা যাওয়ার পর বাস নষ্ট হয়ে যায়৷ পাহাড়ি রাস্তায় বাস থেকে নেমে বোধ হচ্ছিল, অ্যাডভেঞ্চারের শুরুটা হয়েই গেল! নষ্ট গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আমরা অপেক্ষা করতে থাকি থানচিগামী বাহনের। অপেক্ষা যখন বাড়ছিল, তখনই হইচই করে ওঠেন যাত্রীরা। কাছে গিয়ে দেখি, অপেক্ষমাণ বাসযাত্রীরা থানচিগামী একটা খালি ট্রাক থামিয়েছেন। ভাড়া নিয়ে কোনো রকম দর-কষাকষি না করে হুড়মুড় করে সবাই উঠে পড়ি ট্রাকে। ট্রাক চলতে শুরু করে। পাহাড়ি পথে ট্রাকচালক নিজের সর্বোচ্চ প্রতিভা দেখালেন! মানে ট্রাকটাকে তিনি উড়োজাহাজের গতি দিলেন। তাঁর প্রতিভায় আমাদের প্রাণ যায় যায় অবস্থা! অবশ্য থানচি পৌঁছে এই যাত্রাকেও রোমাঞ্চের খাতায় লিখে রাখলাম।
দলবলে দুপুরে এদিক-ওদিক ঘুরে খাবারের ব্যবস্থা হলো। মাংস, বাঁশকোড়লের তরকারি দিয়ে ভাত খেয়ে ইচ্ছা করছিল বিছানায় গা এলিয়ে দিতে। কিন্তু মনকে তালিম দিলাম, সবে তো শুরু, এটুকুতেই ক্লান্ত হওয়া চলবে না!
থানচিতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ক্যাম্পে জাতীয় পরিচয়পত্র কিংবা জন্মসনদ দেখিয়ে অনুমতি নেওয়ার পর্বটা সেরে নিলাম। থানচি পর্যন্তই পিচঢালা পাকা রাস্তার যেমন শেষ, তেমনি মুঠোফোনের নেটওয়ার্কের আওতায় এটুকুই। তাই বাসায় ফোন দিয়ে নাটকীয়ভাবে মাকে বলি, ‘নেটওয়ার্কের বাইরে যাচ্ছি, ফোনে পাবে না, টেনশন কোরো না!’
ফের যাত্রা শুরু করি রেমাক্রির উদ্দেশে। এই যাত্রা ট্রলারে। এবার আমাদের দলে ভিড়েছেন গাইড করিম ভাই। তিনিই আমাদের পথপ্রদর্শক।

নৌকা ছুটছে দূর পাহাড়ে

আমরা এগিয়ে যাই সাঙ্গু নদের বুক বেয়ে। অপার্থিব সুন্দর আর ভীতিকর এক নদীপথ। নদীজুড়ে আট-দশ ফুট উঁচু পাথর যেন প্রকৃতির নিজস্ব খেয়ালে গড়ে তুলেছে। ঘণ্টা দেড়েক পর রেমাক্রিপাড়ায় পৌঁছালাম আমরা। রাতটা এখানেই কাটানোর বন্দোবস্ত করা হয়েছে।

ভোর হলো দোর খোলো
ভোরে পবিত্র ত্রিপিটক পাঠের শব্দে ঘুম ভাঙে আমাদের। সকাল সকাল দলের অসুস্থ দুজনকে থানচি পাঠানোর ব্যবস্থা করে আমরা পথে নামি। রেমাক্রি জলপ্রপাত দিয়ে করিম ভাইয়ের দেখানো পথে আমরা হাঁটতে থাকি। নদীর পাড় দিয়ে এগোচ্ছি সবাই। এগোতে এগোতে যখন সামনে রাস্তা শেষ হয়ে যাচ্ছে, তখন হেঁটে নদী পার হতে হচ্ছে৷ রেমাক্রিপাড়া থেকে তিন ঘণ্টা চলার পর নাফাখুম পৌঁছাই। ফেনিল এই ঝরনার সৌন্দর্য অনেকক্ষণ উপভোগ করে আবার হাঁটা শুরু করি। নাফাখুম পার হওয়ার একটু পরই শুরু হয় বৃষ্টি। নদীর স্রোত বেড়ে গেল মুহূর্তেই। আমাদের সতর্ক করা হলো পাহাড়ি ঢলের ব্যাপারে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর যাত্রা করলাম। সাত ঘণ্টা পর নদী-পাথর-পাহাড়-শৈলপ্রপাত-ঝরনা পাড়ি দিয়ে আমরা থুইস্যাপাড়া পৌঁছাই। এই পথ পাড়ি দেওয়ার বর্ণনা না হয় বাদই থাকল। তবে এটুকু বলি, পিছলে কে কয়টা ডিগবাজি খেয়েছি, সেটার হিসাব রাখা একপর্যায়ে অসম্ভব হয়ে পড়েছিল!

থুইস্যাপাড়া টু অমিয়াখুম
আমরা থুইস্যাপাড়ায় গিয়েছি ১০ জন, ডিগবাজি খেয়ে অনেকের অবস্থাই কাহিল। তাই অমিয়াখুমের জন্য রওনা দিলাম চারজন। রওনা দিয়ে বুঝতে পারলাম ঘুম থেকে গড়িমসি করে ওঠাটা বেশ বোকামিই হয়ে গেছে। সূর্য উঠে গেছে, সামনে খুবই বন্ধুর পথ। অল্প একটু পাহাড় বেয়ে নিচে নামতেই সবাই হাঁপিয়ে পড়ি।
জনশ্রুতি আছে, দেবতার পাহাড় নামা পুরো বান্দরবানের সবচেয়ে কঠিনতম কাজ। আর দেবতার যদি অনিচ্ছা থাকে, তবে এই পাহাড় বেয়ে মানুষ নামতে পারে না।
দেবতার পাহাড়ের ওপর থেকেই অমিয়াখুমের স্রোতের প্রচণ্ড জোরালো আওয়াজ পাওয়া যায়। দেবতার পাহাড়ে নামার সব কষ্ট মিলি সেকেন্ডে সার্থক হয়ে যায় ভীষণ বেগে পড়তে থাকা ঝরনার স্রোতে চোখ পড়তেই। অমিয়াখুম থেকে সামনে দুটি পাহাড়ের মধ্যে ভেলায় করে সাতভাইখুম যাওয়া লাগে। দেবতারা সাত ভাই ছিলেন। খুমের সাতটা পাথরই নাকি সেই দেবতাদের প্রতীক।
দিনমান ঘুরে থুইস্যাপাড়ায় ফিরে আসি রাতে। থুইস্যাপাড়ায় সেই রাতে পূর্ণিমা ছিল। পাহাড়ি পূর্ণিমার সৌন্দর্যে মাতাল হয়ে সেই রাতটা পার করলাম সবাই। পরদিন সকালে শেষবারের মতো গ্রামটা দেখে বের হয়ে গেলাম সবাই থানচির উদ্দেশে।
নৌকায় সাঙ্গু পাড়ি দিয়ে থানচি ফিরে এলাম। চান্দের গাড়িতে ওঠার সময় করিম ভাই কেন বাইরে ভাবছিলাম। তারপর বুঝতে পারলাম, ট্যুর তো শেষ। উনি তো আর আমাদের সঙ্গে ঢাকায় যাবেন না। চার দিনের পরিচয় তাঁর সঙ্গে, অথচ মনে হচ্ছিল কত আপন। যেমন আপন মনে হচ্ছিল ছেড়ে আসা পাহাড়কে।