হোক অলিম্পিক, আন্তর্জাতিক বিতর্ক প্রতিযোগিতা কিংবা ডায়ানা অ্যাওয়ার্ডের মতো বড় আয়োজন—ভিনদেশে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে যান যে তরুণেরা, বিদেশযাত্রায় তাঁদের অনেকেরই সঙ্গে সব সময় থাকে লাল-সবুজ পতাকা। কীভাবে এই পতাকাই তাঁদের পরিচয় হয়ে ওঠে? কেমন করে পতাকা থেকে প্রেরণা পান তাঁরা?
নিশানায় ছোড়ার পর তিরন্দাজরা সাধারণত নিজের তির নিজেরাই কুড়িয়ে আনেন। ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক সব প্রতিযোগিতাতে এটাই নিয়ম। কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা চলার সময় দূর থেকে দেখলে ঠিক বোঝার উপায় থাকে না বাংলাদেশের কোন তিরন্দাজ কোন তিরটা ছুড়ছেন। সবার জার্সির রং একই রকম। প্রায় সমবয়সী হওয়ায় সাধারণত বাংলাদেশ দলের একজন তিরন্দাজের থেকে আরেকজনকে আলাদা করাও একটু কঠিন। তবে দিয়া সিদ্দিকী ব্যতিক্রম। বাংলাদেশ জাতীয় দলের তিরন্দাজদের মধ্যে তাঁকে সহজেই চিনে নেওয়া যায়।
তিরন্দাজদের কাঁধে তির রাখার একটা ঝুলি থাকে। দিয়ার ঝোলায় থাকে বাড়তি একটা তির। আর ওই বিশেষ তিরের মাথায় বাঁধা থাকে বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা। দূর থেকে লাল-সবুজ পতাকা চোখে পড়লেই বোঝা যায়, তির ছুড়তে আসছেন দিয়া সিদ্দিকী। শুধু আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা নয়, ঘরোয়া সব টুর্নামেন্টেও দিয়া এই অলিখিত নিয়ম মেনে চলেন। সাধারণত সব তিরন্দাজের জার্সির বুকের ডান পাশে বাংলাদেশের পতাকার ছবি থাকে। কিন্তু দিয়া এতটুকুতেই সন্তুষ্ট নন। বাড়তি একটা পতাকা সঙ্গে নিয়ে খেলতে ভালোবাসেন তিনি।
২০১৯ সালে বাংলাদেশে হওয়া আইএসএসএফ আন্তর্জাতিক সলিডারিটি আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপে অভিষেকেই সোনা জেতেন দিয়া। তিরে বাঁধা পতাকাটা আছে তখন থেকেই। ক্যারিয়ারের প্রথম আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে সোনা জেতার ম্যাচে সেই যে পতাকাটা লাগিয়েছিলেন, সেটা এ পর্যন্ত আর খুলে রাখেননি।
নিজের তিরে দেশের পতাকা রাখার পেছনে বিশেষ কোনো রহস্য আছে? দিয়া সিদ্দিকীর হাসিমাখা উত্তর, ‘কুইভারে (তির রাখার ঝুলি) পতাকা বেঁধে রাখতে ভালো লাগে আমার। যেদিন আইএসএসএফ সলিডারিটি চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জিতি, সেদিন ওই পতাকা আমার সঙ্গে ছিল। পতাকাটা আমার সঙ্গে থাকলে ভেতর থেকে অন্য রকম একটা শক্তি টের পাই।’
বাংলাদেশের ক্রীড়াজগতের অনেক খেলোয়াড় নিশ্চয়ই দিয়ার সঙ্গে একমত হবেন। পতাকার শক্তি তাঁরাও জানেন। কেউ মাথায় পতাকা জড়িয়ে খেলেন। কেউ বুকের ভেতরে পতাকাটা যত্নে রেখে মাঠে নামেন। ২০১৬ দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে ভারতের গুয়াহাটিতে ভারোত্তোলক মাবিয়া আক্তারের সেই কান্নার দৃশ্য নিশ্চয় এখনো অনেক দর্শকের মনে আছে। সোনা জয়ের পর নিয়ম অনুসারে তখন জাতীয় সংগীত বাজছিল ভেন্যুতে। সঙ্গে ওড়ানো হয়েছিল বাংলাদেশের পতাকা। ওই পতাকা ওড়ানোর পরপরই কান্নায় বুক ভাসিয়েছিলেন মাবিয়া। এই পতাকার জন্যই তো ভালো খেলতে মুখিয়ে থাকেন দিয়া সিদ্দিকী, মাবিয়া আক্তাররা।
দিয়ার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার খুব বেশি দিনের নয়। মাত্র তিন বছরের মধ্যেই আর্চারি খেলায় নজর কেড়েছেন নীলফামারীর তরুণী। আন্তর্জাতিক আর্চারিতে বাংলাদেশের বড় বিজ্ঞাপন হয়ে ওঠা রোমান সানার সঙ্গে জুটি গড়ে বিশ্বকাপে দিয়া সিদ্দিকী জিতেছেন রুপার পদক। গত মে মাসে সুইজারল্যান্ডে বিশ্বকাপ আর্চারির স্টেজ টুতে রিকার্ভ মিশ্র ইভেন্টের ফাইনালে ওঠে বাংলাদেশ। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সোনা জেতা হয়নি। তবে রোমানকে সঙ্গী করে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাসে বিরল এক কীর্তিই গড়েছিলেন দিয়া। বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের ফাইনালে যে কালেভদ্রেই ওঠেন বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা!
এরপর দিয়া আরেকটি ইতিহাস গড়েন আগস্টের টোকিও অলিম্পিকে। বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসে এ পর্যন্ত অলিম্পিকের আসরে কোনো খেলোয়াড় বাছাইপর্ব পেরিয়ে চূড়ান্ত পর্বে খেলতে পারেননি। দিয়া সেটি করে দেখিয়েছেন অলিম্পিকে প্রথম আসরে খেলার সুযোগ পেয়েই!
গত নভেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশিয়ান আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপে হাকিম আহমেদকে সঙ্গী করে রিকার্ভ মিশ্র দ্বৈত ইভেন্টে প্রথমবার ফাইনালে ওঠেন দিয়া। জিতে নেন রুপার পদক। অথচ এর আগে ১৮ বছরে এশিয়ান আর্চারিতে বাংলাদেশ কোনো পদকই জিততে পারেনি!
ক্রিকেট, ফুটবলারদের তুলনায় সুযোগ-সুবিধায় অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশের আর্চাররা। তবু কোনো দুঃখ নেই দিয়ার। তিরের ঝুলিতে যখন পতাকা নিয়ে খেলতে নামেন, অন্য রকম একটা শক্তি আসে দিয়ার, ‘আমি সব সময় দেশের জন্যই খেলি। যেখানেই খেলতে যাই না কেন, সবার আগে মনের মধ্যে একটা কথাই উঁকি দেয়—আমি এখানে দেশের প্রতিনিধিত্ব করছি।’