বলিউড তারকা শাহরুখ খান সম্প্রতি অংশ নিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত ইন্ডিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অব মেলবোর্নে। একই সময় সেখানকার লা ট্রোব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি গ্রহণ করেন। উৎসব ও ডক্টরেট ডিগ্রি গ্রহণ উপলক্ষে শাহরুখ খান অংশ নেন বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে। সেখানে দেওয়া একটি বক্তৃতার অংশবিশেষ থাকছে এবার।
অভিনেতা হিসেবে এটা আমার সৌভাগ্য যে আমি শত শত গল্পের মধ্যে বেঁচে থাকার সুযোগ পাচ্ছি। আমি বুঝতে পারি, প্রতিটা গল্পই এসেছে কল্পনার জগৎ থেকে। এমন অনেক গল্প আমি শুনেছি, সবার সামনে তুলে ধরেছি, যা বাস্তবতার ধারেকাছেও যায় না। আমার অভিনীত গুড্ডু ছবিতে তেমনই একটা গল্প ছিল।
একটা ছেলের গল্প, যে ভালোবাসত সেলিনা নামের এক মেয়েকে। একদিন তারা দুজন গাড়ি নিয়ে ঘুরতে বেরোয় আর সে সময়ই দুর্ঘটনায় চোখ হারায় সেলিনা। এরপর থেকে সেলিনার পরিবার আর তাকে গুড্ডুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেয় না। অন্যদিকে গুড্ডু ভুগতে থাকে অপরাধবোধে। একটা সময় গুড্ডুর মস্তিষ্কে টিউমার ধরা পড়ে। চিকিৎসক জানায়, কয়েক মাসের মধ্যেই সে মারা যাবে। তখন গুড্ডু ঠিক করে, মৃত্যুর পর সে তার চোখ দান করে যাবে সেলিনাকে। কিন্তু বাদ সাধে গুড্ডুর বাবা। তার ধারণা ছিল, ছেলে সুস্থ হয়ে উঠবে। তাই গুড্ডু চক্ষুদানে বাধা দেওয়ায় বাবার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করে। একসময় গুড্ডুর সঙ্গে তার বাবার প্রচণ্ড বাগ্বিতণ্ডা শুরু হয়। উত্তেজনায় গুড্ডুর বাবা হার্ট অ্যাটাক করে। অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় গুড্ডুও। বাবা-ছেলে একই হাসপাতালের বাসিন্দা হয়। এমন সংকটের সময় গুড্ডুর মা নিজেকে একটি ঘরে বন্দী করে ছেলে ও স্বামীর জন্য প্রার্থনা শুরু করে এবং পাঁচ দিন নাওয়া-খাওয়া থেকে দূরে থাকে। শেষমেশ গিয়ে দেখা যায়, গুড্ডুর বাবার হার্ট অ্যাটাক ঠিক হয়ে গেছে, গুড্ডুর ব্রেন টিউমারও সেরে উঠেছে। কিন্তু মারা যায় গুড্ডুর মা। তখন গুড্ডুর মায়ের চোখ সেলিনাকে দান করা হয়। এরপর গুড্ডু-সেলিনা সুখে–শান্তিতে বসবাস শুরু করে। তাদের যমজ সন্তানও হয়।
এর চেয়ে কাল্পনিক আর কী হতে পারে! এমন অদ্ভুত গল্পকেও আমরা অভিনেতারা তুলে ধরি পর্দায়, দর্শক তা দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে ওঠে। এই গল্প বলার একটা কারণ আছে। সেটা হলো, আমরা চাইলেই নিজেদের পরিশ্রম আর কাজকে মনে রাখতে পারি সবচেয়ে সহজ আর সুন্দর দিকে আলোকপাত করে। একটা আজগুবি ছবিতে অভিনয় করেছি, এ নিয়ে আক্ষেপ নেই; বরং সেই কাজের সময় একটা বিশেষ কায়দায় আলোক প্রক্ষেপণ, একটা সংলাপকে একেবারে ভিন্নভাবে বলা, একটা বিশেষ সুর কানে লেগে থাকা—দিন শেষে মনে দাগ কেটে থাকে সেই স্মৃতিগুলোই। অভিজ্ঞতার ঝুলি ভারী হয়, সেই ছোট ছোট দিক থেকেই। হিসাব করলে দেখা যাবে, আমাদের জীবনটাও সে রকম। অনেক অদ্ভুত আর অলৌকিক ঘটনা হয়তো জীবনে ঘটে যায়। ঘটে দুর্ঘটনা। কিন্তু দিন শেষে জীবন পরিপূর্ণ হয় ছোট ছোট অনেক অনুভূতির সম্মিলনে। দিন শেষে মন ভালো হয়ে যায় একটা সুন্দর বিকেল কিংবা একটু স্বস্তির সময় কাটানোর মধ্য দিয়ে। অনেক কঠিন সময়েও জীবনকে সহজ করে দেয় সেই মুহূর্তগুলো। সহজ কথাগুলো আমাদের জীবনের গল্পকে শ্রুতিমধুর করে তোলে।
আমার থিয়েটারের শিক্ষক একবার আমাকে বলেছিলেন, ‘একটা নাটকের জন্য তোমাকে অমানবিক পরিশ্রম করতে হবে। বারবার বারবার একই সংলাপ আওড়াতে হবে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা মহড়া করতে হবে। একসময় গিয়ে ওই নাটক তোমার জন্য বোরিং (ক্লান্তিকর) হয়ে উঠবে। নাটকটা আর কোনো বিশেষ অর্থ বহন করবে না। কিন্তু নাটকের মাঝখানে গিয়ে মঞ্চে একটা সংলাপের এদিক-সেদিক হওয়া, কিংবা নাটক শেষে দর্শকের চিৎকার, মঞ্চে আলোর বিশেষ কোনো কারসাজি তোমার মনে দাগ কেটে যাবে। সেই একটা মুহূর্ত তোমার ওই গল্পে যোগ করবে ভিন্ন স্বাদ। মনে হবে সেই ছোট্ট মুহূর্তটা না থাকলে তোমার গল্পটা বলার মতো হতো না, মনে রাখার মতো হতো না।’
আমার কাছে তাই জীবনের সহজ-সরলতা সবচেয়ে বেশি মূল্যবান। আমি বড় বড় পুরস্কারের কথা ভুলে যাই। ভুলে যাই আয়-ব্যয়ের হিসাব। দিন শেষে যা মনে থাকে সেটা হলো, একটা সুন্দর হাসি, যা কোনো শিশু আমাকে দেখে হাসল; কিংবা অচেনা শহরে চেনা কোনো গানের সুর কানে এসে লাগা। এসবই ওই দিনের সফরকে, আমার যাত্রাকে স্মরণীয় করে রাখে, দিনটা সবার থেকে আলাদা করে রাখে।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আদর রহমান
সূত্র: অনুষ্ঠানের ভিডিও