কিংবদন্তি হওয়া প্রেমের গল্পগুলোর একটা মিল আছে সারা পৃথিবীতে। এই মিলটা বিরহের। লাইলী-মজনুই হোক বা দেবদাস-পার্বতী কিংবা রাধা-কৃষ্ণই হোক, সবার প্রেমই বিরহে মধুর হয়ে উঠেছে। মালয়েশিয়ার লঙ্কাউইয়ের বিখ্যাত ‘দায়াং বান্টিং’ বা গর্ভবতী নারী নামের দ্বীপটিও এই বিরহের সাক্ষী।
সবুজ দ্বীপের স্বচ্ছ জলের হ্রদের তীরে মেত তেজার সঙ্গে ঘটনাক্রমে দেখা হলো পরি রাজকন্যা মেম্বেং সারির। প্রথম দেখাতেই অপরূপ সুন্দরী রাজকন্যার প্রেমে পড়ে গেল মেত তেজা। পরি রাজকন্যা মেম্বেং সারিকে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল সে। কিন্তু পরির সঙ্গে মানুষের মিলন তো হতে পারে না! নাছোড়বান্দা প্রেমিক তেজা গেল এক সাধুর কাছে। মৎস্যকুমারীর অশ্রু দিয়ে মুখ ধুলেই কেবল তেজা তার প্রেমিকাকে আপন করে পেতে পারে বলে জানালেন সাধু। প্রেমিক তেজা তা-ই করল। অবশেষে তাদের মধ্য গড়ে উঠল প্রেমের সম্পর্ক। একদিন বিয়েও হয়ে গেল মানুষ মেত তেজা আর পরি রাজকন্যা মেম্বেং সারির।
বিয়ের পর যথারীতি সন্তানসম্ভবা হলো সারি। নির্দিষ্ট সময়ে সে জন্ম দিল এক পুত্রসন্তানের। কিন্তু জন্মের পর পুত্রটি বাঁচল না। সারি তার সন্তানকে হ্রদের পানিতে সমাহিত করল। সারি আর তেজার মৃত শিশুপুত্র সাদা কুমির হয়ে হ্রদের জলে ঘুরে বেড়াতে লাগল। এখনো শোনা যায়, খুব ভাগ্যবান মানুষজন এই সাদা কুমির দেখতে পায়। সন্তান হারানোর শোকে পাগলিনী মা মেম্বেং সারি প্রকৃতির কাছে বলে রাখল, যেসব দম্পতি বন্ধ্যা বা নিঃসন্তান, তাঁরা এই লেকে স্নান করলে সন্তান লাভ করবেন।
এর কিছুদিন পরেই মানুষ দেখতে পেল, পাহাড়ের গায়ে এক নারীর আকৃতি ফুটে উঠেছে, যাকে দেখে মনে হয় সন্তানসম্ভবা একজন নারী আকাশের দিকে তাকিয়ে চিত হয়ে শুয়ে আছে। সেই থেকে লঙ্কাউইয়ের এই দ্বীপ, জঙ্গল আর লেকের নামকরণ হয়ে গেল ‘দায়াং বান্টিং’ বা গর্ভবতী নারী।
এই প্রেম আর দুঃখিনী মায়ের গল্প মাথায় নিয়ে আমরা চলেছি লঙ্কাউইয়ের দায়াং বান্টিং বা গর্ভবতী নারী নামের বিখ্যাত পর্যটনকেন্দ্রটি দেখতে। যেতে হয় জলপথে। আমাদের স্পিডবোটচালক এক অল্পবয়সী ছেলে—খুব তিড়িংবিড়িং ভাব, চলনে, বলনে এবং কাজেও। নানা কায়দায় মিনিট ত্রিশ ধরে স্পিডবোট চালিয়ে সে সমুদ্রের মাঝেই এক জায়গায় বোটটাকে দাঁড় করিয়ে দিল। আকাশের দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলল, সো, হিয়ার ইস দা প্রেগন্যান্ত লেদি!
ওয়াও! দেখ্ দেখ্ কিতনা সুন্দার—বলে যখন আমার সামনে বসা ভারতীয় মেয়েগুলো চাপা উচ্ছ্বাসে চেঁচিয়ে উঠল, তখনো আমি বুঝিনি, দ্বীপে না পৌঁছাতেই এখানে প্রেগন্যান্ট লেডি কীভাবে? পরে অবশ্য বুঝেছি, দ্বীপের আরেকটা দিক এটা। এ পাশের সমুদ্র থেকেই আসলে গর্ভবতী নারীকে ভালোভাবে দেখা যায়। তাই ছোকরা আমাদের এখানে ছবি তোলার সুযোগ করে দিতেই একটু থামিয়েছে।
আমি ঝটপট মুঠোফোন ক্যামেরা অন করলাম। পটাপট কিছু ছবি তুলে নিলাম। মূল দ্বীপে প্রেগন্যান্ট লেডির যে লেক আছে, সেখান থেকে তার অবয়ব বোঝা দুষ্কর। পরে জেনেছি, একমাত্র গাইডই পারে লেকের পন্টুন থেকে ঠিকমতো গর্ভবতী নারীকে খুঁজে বের করতে। পর্যটকেরা ঠিকমতো ধরতে পারে না।
ভাগ্যিস সমুদ্র থেকেই ছবিগুলো তুলেছিলাম। যা হোক, খুব অল্প সময়ই পেলাম। কয়েকটা স্ন্যাপ নিতে নিতেই স্পিডবোট স্টার্ট নিল। দেড়-দুই মিনিট পরেই আমরা দায়াং বান্টিং মার্বেল জিও ফরেস্ট পার্কের জেটিতে ভিড়লাম। দায়াং বান্টিং মানে হচ্ছে ‘গর্ভবতী নারী’, এখানে দায়াং বান্টিংয়ের নামেই পাহাড়, লেক এবং জিও ফরেস্টের নাম।
আমরা যে দ্বীপে নামলাম সেটা হচ্ছে, লঙ্কাউইয়ের তিনটি জিও ফরেস্টের একটি। সরু জেটিপথ ধরে এগোলেই টিকিট কাউন্টার। সেখান থেকে টিকিট কেটে নিলাম। বিদেশিদের জন্য টিকিটের একটু বেশি দাম। স্থানীয় লোকজনের জন্য ফ্রি। লেকে যেতে ২০ মিনিটের হাঁটাপথ। সেই হাঁটাপথ দেখে আমার বুকে ধড়ফড় শুরু হলো। সিঁড়ি! পাহাড় বাইতে হবে! ‘উপায় নাই গোলাম হোসেন’ ভেবে হাঁটা ধরলাম। চওড়া চওড়া কম উচ্চতার সিঁড়ি। তাও ভাঙতে জান বেরিয়ে যাচ্ছে। দু-তিন ধাপ উঠি আর থেমে হাঁ করে দম নিই। এভাবে উঠতেই থাকলাম। বনের মধ্য দিয়ে পথ, পথের দুই পাশে অসংখ্য বানর ছানাপোনা আত্মীয়-পরিজন নিয়ে হাজির।
দেখতে দেখতে এগোই। বুকভরে শ্বাস নিচ্ছি, নেশা ধরানো বনজ ঘ্রাণ। চিকচিকে বৃষ্টিধোয়া গাছপালা, কক কক করে কোনো পাখি ডাকছে একটু পরপর। সত্যি বলতে, সেই অর্থে তেমন করে পাখির দেখা সারা লঙ্কাউইতেই পেলাম না। তবে হ্যাঁ, অজস্র রংবেরঙের প্রজাপতি আছে। তারা আমাদের চারপাশ ঘিরে নেচে নেচে উড়ছে অবিরাম।
একসময় ওঠার পর্ব শেষ হলো। এবার নামার পালা। আবার নামতে হবে। ওঠা আর নামার সংযোগস্থলে অনেক বানর। কেউ কেউ একেবারে সুবোধ সেজে বসে আছে। এর মধ্যেই এক মাস্তান টাইপের বানর আমার সামনের এক মেয়ের ব্যাগ ধরে টানাটানি শুরু করল। আমি তো তিরবেগে ছুটে কয়েক ধাপ নিমেষেই নেমে গেলাম। চাচা আপন প্রাণ বাঁচা বুঝি একেই বলে। জিল্লুর ভিডিও করতেই থাকল। বানরও ঝুলেই রইল, মেয়েটার ব্যাগের চেইন খোলার চেষ্টা করছে, দাঁত খিঁচাচ্ছে। কেউ একজন তেড়ে যেতেই সে খচরমচর কিচকিচ করে কিছু বলল, অমনি নিচ থেকে বেশ কয়েকটি স্বজাতি ছুটে এল। ক্যাডার বাহিনী একেবারে। অবশেষে মেয়েটির ব্যাগপ্যাক থেকে ঝোলজাতীয় জিনিসের একটা পোঁটলা বের হলো। সেটি ফেলে দিতেই বানর মাস্তান তাকে ছেড়ে দিল।
এখানে এবং সব বনেই দেখলাম নিষেধ করা আছে সঙ্গে খাবার নিয়ে চলাচল করার। আরও শ-খানেক সিঁড়ি ভেঙে অবশেষে তাসিক দায়াং বান্টিংয়ের দেখা পেলাম। ‘তাসিক’ মানে লেক। ‘পুলাও’ মানে দ্বীপ। এই তাসিক দায়াং বান্টিং মানে হচ্ছে গর্ভবতী নারীর লেক। এই লেকের সামনে দাঁড়িয়ে চোখ জুড়িয়ে গেল। গাঢ় নীল পানির রং। চুনাপাথর জমে শক্ত হয়ে নিরেট পাথর হয়েছে। সেই পাথরের খাড়া পাহাড় লেককে ঘিরে। আসলে এটি নাকি একটি গুহা ছিল। কালের পরিক্রমায় পাহাড় ভেঙে ভাগ হয়ে লেকে পরিণত হয়েছে। সমুদ্র থেকে মাত্র ৩০ মিটার দূরে মিষ্টি পানির এই গোলাকৃতির লেক। ডানে তাকালে দেখা যায়, দুই পাশ থেকে পাহাড় নিচু হয়ে এসে একটুখানি জায়গায় সমতল ভূমির মতো হয়ে গেছে। ওই সমতল সরু পাথুরে রিজটাই দায়াং বান্টিং তাসিককে সমুদ্র থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে এবং আশ্চর্যজনক হলো, সমুদ্রের এত কাছে হওয়া সত্ত্বেও লেকের পানি নাকি একদম নোনতা নয়।
এখানে জনশ্রুতি আছে, যেসব দম্পতির সন্তান হয় না, এই লেকের পানিতে ডুব দিলে অথবা সাঁতার কাটলে তাঁরা সন্তান লাভ করবেন। আর পাহাড়ের গায়ে যে গর্ভবতী নারীর অবয়ব দেখা যায়, সে এই লেকের রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে।
বর্তমানে কেউ এই কাহিনি বিশ্বাস করে কি না কিংবা সত্যই কেউ এই লেকে নেমে প্রেগন্যান্ট হয়েছে কি না, তা জানা যায় না। অনেকে বলে থাকেন, বেড়াতে গেলে দম্পতিরা এমনিতেই পরস্পরের ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে এসে থাকেন, তখন তাঁদের শরীর ও মনে স্বাভাবিকভাবেই কিছু পরিবর্তন আসে, যা থেকে হরমোন বা শারীরবৃত্তীয় কার্যক্রম পরিপূর্ণভাবে কাজ করে এবং সে ক্ষেত্রে গর্ভধারণ ঘটতে পারে সহজেই।
লোকে যা-ই বলুক, অসাধারণ সৌন্দর্যমণ্ডিত এই দ্বীপে গেলে এমনিতেই মন ভালো হয়ে যায়। মনপ্রাণ ভরে ওঠে।