বেশির ভাগ সময় দাবার বোর্ডে মগ্ন থাকেন ওয়ালিজা আহমেদ
বেশির ভাগ সময় দাবার বোর্ডে মগ্ন থাকেন ওয়ালিজা আহমেদ

দাবায় রানী হামিদকে হারিয়ে দিয়েছিলেন এই তরুণী

বসার ঘরের শোকেস ভর্তি ট্রফি, মেডেল। শোকেসের এক কোনায় রাখা গ্র্যান্ডমাস্টার ববি ফিশারের ছবিসংবলিত মগ। টি-টেবিলের ওপরে রাখা সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন রুশ গ্র্যান্ডমাস্টার ভাসিলি স্মাইসলভের জীবনী। পড়ার ঘরের বইয়ের তাকভর্তি নানা রকম দাবার বই। যে বয়সে ইউটিউব আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বুঁদ হয়ে থাকে বেশির ভাগ তরুণ–তরুণী, সেই বয়সে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম ওয়ালিজা আহমেদ। ইন্টারনেট দুনিয়ার অন্য কোনো বিনোদনই তাঁকে টানে না। বেশির ভাগ সময় দাবার বোর্ডে মগ্ন থাকেন মহিলা ক্যান্ডিডেট মাস্টার আহমেদ ওয়ালিজা। ২৩ ফেব্রুয়ারি শেষ হওয়া জাতীয় জুনিয়র দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে বালিকা বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন ওয়ালিজা।

বাবা মাঈনুদ্দিন আহমেদ ছিলেন জাতীয় দাবাড়ু। জীবিকার টানে ১৯৯০ সালে ইতালিতে চলে যান মাঈনুদ্দিন। সেখানেই ওয়ালিজার জন্ম। দাবায় হাতেখড়িও সেখানেই। কিন্তু বাবা নয়, মা তাসলিমা খাতুনের কাছে দাবা খেলা শিখেছেন ওয়ালিজা। সেই গল্পটা বলছিলেন তাসলিমা, ‘দাবা খেলে জেতা ওর বাবার অনেক ট্রফি, মেডেল মাঝেমধ্যে শোকেস থেকে বের করে পরিষ্কার করতাম। পাশে বসে দেখত ওয়ালিজা। আর জানতে চাইত, সত্যি বাবা দাবা খেলত কি না। একদিন মেয়েও দাবা খেলা শিখতে চাইল। আমি সব ঘুঁটি চেনালাম। চাল দেওয়া শিখিয়ে দিলাম।’

বাবাকে চমকে দিতে এক রাতে দাবার বোর্ড হাতে বসে পড়ে ওয়ালিজা, বাবাকে ডেকে বলে, ‘আমি দাবা খেলতে পারি। শুনে বাবা অবাক। আমার আগ্রহ দেখে বাবা বললেন, খাতা-কলম নিয়ে আসো। এরপর বাবা আরও কিছু নিয়মকানুন শিখিয়ে দিলেন। অনেক দাবার বই হাতে ধরিয়ে দিলেন।’

ইতালির মিলান শহরে থাকতেন ওয়ালিজারা। সেখানে স্কুলে দাবা খেলা শেখানো হতো না। কিন্তু বাবার কাছ থেকে শিখেই বিভিন্ন বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টে খেলতেন। ইতালিয়ান ছেলেমেয়েদের হারিয়ে দেওয়ার পর স্থানীয় আয়োজকেরা বিস্ময়চোখে তাকিয়ে থাকতেন ওয়ালিজার দিকে। সেই গল্পটা বলছিলেন ওয়ালিজা, ‘ওরা সব সময় বাংলাদেশিদের অবহেলার চোখে দেখত। কিন্তু আমি যখন জিততে শুরু করলাম, সবাই আমাকে সমীহ করত। দেখে আমার খুব ভালো লাগত।’

দাবা খেলে ওয়ালিজা পদকও জিতেছেন অনেকগুলো

এখনো ইতালিতেই থাকেন মাঈনুদ্দিন। তবে ২০১৫ সালে মায়ের সঙ্গে বাংলাদেশে চলে আসেন ওয়ালিজা ও তাঁর ছোট বোন ওয়াদিফা আহমেদ। ভর্তি হন ইস্পাহানি গার্লস স্কুলে। এরপর সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন ভিকারুননিসা নূন স্কুলে। বর্তমানে সেই স্কুলেরই দশম শ্রেণির ছাত্রী।

ঢাকায় এসে শুরুতে বেশ বিপদে পড়েছিলেন ওয়ালিজা। ইতালিয়ান ভাষা ছাড়া আর কিছু জানতেন না তিনি। কিন্তু একটা জিনিস জানতেন, সেটা হলো দাবা খেলা। দাবা ফেডারেশনে গিয়ে খেলতে শুরু করেন। বাবার পরিচয়ে পরিচিত হতে চাইতেন না ওয়ালিজা। কিন্তু তাঁর পারফরম্যান্স দেখে অনেকেই বুঝতে পারতেন এই মেয়ের রক্তে আছে দাবা। শেষ পর্যন্ত বাবার নাম বলতেই ফেডারেশন কর্মকর্তারাও বেশ স্নেহের চোখে দেখতে শুরু করেন ওয়ালিজাকে।

ঢাকায় এসে ২০১৬, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে শেখ রাসেল আন্তস্কুল দাবা টুর্নামেন্টে বালিকা বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন ওয়ালিজা। ২০১৬ সালে জাতীয় সাব-জুনিয়রে অনূর্ধ্ব-১৪ বিভাগে হয়েছেন চ্যাম্পিয়ন। ২০২০ সালে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে খেলে দাবা অলিম্পিয়াডের জাতীয় দলে সুযোগ পান। কিন্তু করোনার কারণে সেবার রাশিয়ায় আর যেতে পারেননি। এরপর অনলাইনে দাবা অলিম্পিয়াডে অংশ নেন। জাতীয় মহিলা দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে এ বছর রানার্সআপ হওয়ায় আবারও দাবা অলিম্পিয়াডের বাংলাদেশ দলে সুযোগ পেয়েছেন ওয়ালিজা। এরই মধ্যে ভারতের ওডিশায় কিডস গ্র্যান্ডমাস্টার টুর্নামেন্ট ও মুম্বাইয়ে মেয়র কাপ আন্তর্জাতিক দাবা টুর্নামেন্টে খেলেছেন তিনি। বাংলাদেশের দাবার রানি আন্তর্জাতিক মহিলা মাস্টার রানী হামিদকে হারিয়ে সবার নজর কাড়েন ঘরোয়া টুর্নামেন্টে।

মাযের সঙ্গে দাবাড়ু ওয়ালিজা

এত এত অর্জনে স্কুলের বন্ধুরা তারকার চোখে দেখেন ওয়ালিজাকে, ‘আমাদের স্কুলে অনেক ছাত্রী। কিন্তু টিফিনের সময় যদি মাঠে হাঁটি, হঠাৎ করে একজন এসে বলে তোমাকে তো টিভিতে দেখেছি। তখন নিজেকে সেলিব্রিটি মনে হয়।’

সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন গ্যারি কাসপারভের খেলা অনুসরণ করেন। ভালো লাগে ববি ফিশারের ব্যক্তিত্ব। অনেক আগে দাবা খেলা ছেড়েছেন ওয়ালিজার বাবা। কিন্তু বাবার স্বপ্ন, মেয়ে তাঁকে ছাড়িয়ে যাক। ওয়ালিজা বলছিলেন, ‘আমি বিভিন্ন টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়ে বাবাকে ফোন করলে বলেন, তোমাকে আরও অনেক দূরে যেতে হবে। আমি স্বপ্ন দেখি, উন্মুক্ত বিভাগে একদিন গ্র্যান্ডমাস্টার হব।’

ইউরোপের সুযোগ–সুবিধা ছেড়ে আসায় আফসোস আছে। কিন্তু আক্ষেপ নেই, ‘ওখানে থাকলে হয়তো বেশি বেশি টুর্নামেন্ট খেলতে পারতাম। কিন্তু এখানে দেশের হয়ে খেলছি, সেটাই ভালো লাগে।’

ছোট বোন ওয়াদিফাও দাবাড়ু। ঘরোয়া টুর্নামেন্টে মাঝেমধ্যে বড় বোনকে হারিয়ে দেয় সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া ওয়াদিফা। রানী হামিদ ছাড়া বাংলাদেশের দাবায় মেয়েদের ধারাবাহিক সাফল্য সেভাবে নেই বললেই চলে। কিন্তু ওয়ালিজা হারিয়ে যেতে চান না। বিশ্বের মানচিত্রে তুলে ধরতে চান লাল-সবুজের পতাকা।